‘আটলান্টিকজুড়ে বিশাল লাফ’—যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ
টেক্সাসের গ্র্যান্ড পিয়েরে স্টেডিয়াম—২০২০ সালেও এটি ছিল মাইনর লিগ বেসবলের মাঠ। করোনা মহামারিতে বেসবল মৌসুম বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর একপর্যায়ে মাঠটি ইজারা নেয় মেজর লিগ কর্তৃপক্ষ। দুই কোটি মার্কিন ডলারের বেশি খরচে সংস্কার করা হয় গ্যালারি, মাঠ।
নতুন চেহারা পাওয়া সেই মাঠে আজ আলী খান যখন তাঁর প্রথম ডেলিভারিটি করলেন, ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে ফুটল মোক্ষম বর্ণনাটা, ‘আটলান্টিকজুড়েই এ এক বিশাল লাফ।’
বিশাল লাফই। যুক্তরাষ্ট্রের পেসার আলীর ওই ডেলিভারি দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হলো মেজর লিগ ক্রিকেট (এমএলসি)। বাস্কেটবল-বেসবলের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এটি ক্রিকেটের সবচেয়ে জাকজমকপূর্ণ ও পেশাদার লিগ। উদ্বোধনী ম্যাচে আলীর লস অ্যাঞ্জেলেস নাইট রাইডার্স মুখোমুখি হয় টেক্সাস সুপার কিংসের। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসির নেতৃত্বাধীন সুপার কিংস প্রথমে ব্যাট করে ৬ উইকেটে ১৮১ রান তোলে। তাড়া করতে নেমে ১৪ ওভারে ১১২ রানে অলআউট হয় সুনীল নারাইনের নাইট রাইডার্স।
আলী খানের দল ৬৯ রানের বড় ব্যবধানে হেরে গেলেও আসল জয়টা হয়েছে তাঁর দেশের ক্রিকেটের। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার ক্রিকেট লিগ চালুর উদ্যোগ বারবার ধাক্কা খেয়েছে। অবশেষে তা পূর্ণতা পাচ্ছে এবার।
এমএলসি: ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে নতুন টুর্নামেন্ট
মেজর লিগ ক্রিকেট বা এমএলসি টি-টোয়েন্টি ফরমেটের নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট। আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর বাইরে এ বছরের শুরুতে ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দ্বিতীয় দল হিসেবে ২০ ওভার ক্রিকেটে একই ধারার টুর্নামেন্ট চালু করল যুক্তরাষ্ট্র। তবে আইসিসির পূর্ণ সদস্য না হওয়ায় টুর্নামেন্ট দুটি অফিশিয়াল টি-টোয়েন্টির মর্যাদা পাচ্ছে না।
বাস্কেটবল, ফুটবল ও বেসবল জনপ্রিয়তার দেশে ক্রিকেটের পেশাদার লিগ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তবে এবারের মতো কোনোটিই গোছানো ছিল না। বছরের প্রথম দিকে এমএলসির জমকালো প্লেয়ার ড্রাফটের আয়োজন করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নাসার আইকনিক হিউস্টন স্পেস সেন্টারে।
আড়াই সপ্তাহের প্রতিযোগিতায় মোট ১৯টি ম্যাচ রাখা হয়েছে। খেলছে ৬টি দল—এমআই নিউইয়র্ক, টেক্সাস সুপার কিংস, লস অ্যাঞ্জেলেস নাইট রাইডার্স, সিয়াটল অরকাস, সান ফ্রান্সিসকো ইউনিকর্নস ও ওয়াশিংটন ফ্রিডম।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিকেট কতটা ছড়াবে?
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের নামে দল গঠন করা হলেও খেলা হবে টেক্সাসের গ্র্যান্ড পিয়েরে ও নর্থ ক্যারোলাইনায় ছোট ক্রিকেট মাঠে। এমএলসি টুর্নামেন্ট ডিরেক্টর জাস্টিন জায়েল ভবিষ্যতে খেলার ভেন্যু বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন, ‘স্থানীয় দর্শক বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে খেলা হওয়া দরকার। দুটি ভেন্যুতে খেলা চালানো আদর্শ কিছু নয়। আগামী মৌসুমে ৩০ ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা আছে আমাদের। তখন সান ফ্রান্সিসকো যুক্ত হবে। আশা করি, ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ১০ থেকে ২০ হাজার দর্শকের কয়েকটি ভালো মানের স্টেডিয়াম পেয়ে যাব। এটা আমাদের লক্ষ্য।’
বড় নামের ক্রিকেটার কারা আছেন
প্রথম আসরেই ক্রিকেট–বিশ্বের বেশ কিছু ভালো মানের ক্রিকেটারকে আকৃষ্ট করেছে এমএলসি। ইংল্যান্ডের জেসন রয় এ টুর্নামেন্টে খেলতে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। লিয়াম প্লাঙ্কেট আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।
এ ছাড়া আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক, ফাফ ডু প্লেসি, কাগিসো রাবাদা, ডেভিড মিলার, আফগানিস্তানের রশিদ খান, পাকিস্তানের শাদাব খান, ইমাদ ওয়াসিম, হারিস রউফ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুনীল নারাইন, কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল, নিউজিল্যান্ডের ডেভন কনওয়ে, মার্টিন গাপটিল, লকি ফার্গুসন এবং অস্ট্রেলিয়ার অ্যারন ফিঞ্চ, অ্যাডাম জামপা, টিম ডেভিড ও মার্কাস স্টয়নিসের মতো খেলোয়াড়েরা।
সামনের মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ ও ইংল্যান্ডের মঈন আলীরা খেলতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
কিসের আকর্ষণে যাচ্ছেন তারকা ক্রিকেটাররা
টি–টোয়েন্টির মর্যাদা না থাকার পরও কিসের আকর্ষণে বর্তমান ক্রিকেটাররা এমএলসিতে যোগ দিচ্ছেন? এককথায় বললে—অর্থ। এমএলসির মালিকানায় আছে ভারতীয় সংযোগ। এর মধ্যে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দ্য টাইমস গ্রুপ এবং মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আছেন। ছয় দলের মধ্যে চারটির মালিকানায় আছে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি— কলকাতা নাইট রাইডার্স, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, চেন্নাই সুপার কিংস ও দিল্লি ক্যাপিটালস। অন্য দুটির মালিকানা অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ক্রিকেট নিউ সাউথ ওয়েলস ও ক্রিকেট ভিক্টোরিয়া।
প্রতিটি দলকে খেলোয়াড় কেনার জন্য ১১ লাখ ৫০ হাজার ডলার খরচের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। স্কোয়াডে খেলোয়াড় ১৫–১৮ জন।
এটা কি মিনি আইপিএল
ছয় দলের চারটির মালিকানায় আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে প্রভাব কতটা। এমএলসির টুর্নামেন্ট ডিরেক্টর জাস্টিন জায়েলও বলেছেন একই কথা, ‘আইপিএলের দলগুলোর উপস্থিতি থাকায় এখানে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের লোকদের আস্থা তৈরি হয়েছে।’ তবে এমএলসিকে আইপিএলের মিনি সংস্করণ বানাতে চান না আয়োজকেরা।
জায়েলই যেমন বলেছেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে ভারতই ক্রিকেটবিশ্বের কেন্দ্র। তবে এমএলসিকে আমরা মিনি আইপিএল বানাতে চাই না। নিজেদের একটা ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে চাই। এমএলসিকে যতটা সম্ভব আমেরিকান পণ্য হয়ে উঠতে হবে।’
এ জন্য স্থানীয় কমিউনিটি ও স্কুলগুলো পর্যন্ত পৌঁছাবেন বলে জানান এমএলসি ডিরেক্টর। স্থানীয় দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য ম্যাচের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সন্ধ্যায়, যাতে তাঁরা খেলতে পারেন। আপাতত বাইরের দেশের টেলিভিশন দর্শকদের সময়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি।
এমএলসি কি টিকবে
শক্ত আর্থিক ব্যাকআপ আছে এমএলসির। তবে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে, তা এখনই বলা মুশকিল। জায়েল অবশ্য আশাবাদী, ‘“পটেনশিয়াল” শব্দটি আমার অপছন্দ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে এটা প্রচুর ব্যবহৃত হয়। এখানে ক্রিকেটের বড় বাজার আছে। ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে চাইলে কোথায় যাবেন আপনি? চায়না বা রাশিয়া না হলে সেটা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র।’
পাকিস্তান বংশোদ্ভুত যুক্তরাষ্ট্রের পেসার আলী খানও এমএলসি নিয়ে আত্মবিশ্বাসী, ‘আমি তো মনে করি, আইপিএলের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম লিগ হবে এমএলসি।’ কেন এতটা ভাবছেন, তার ব্যাখ্যায় আলীর জবাব, ‘কারণ বাজার এখানে, স্পনসর এখানে, অর্থ এখানে। এটা বড় দেশ। অনেক সুযোগ। আমাদের জন্য জীবন বদলে দেওয়া দেশ।’
এমএলসি যুক্তরাষ্ট্রে সফলতা পেলে ক্রিকেটও যে বদলে যাবে, সে তো সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।