এক দলের চার ম্যাচে পাঁচ সেঞ্চুরি। আরেক দলের একটিও সেঞ্চুরি নেই, সাত হাফ সেঞ্চুরির মধ্যে সর্বোচ্চ ইনিংসটি ৭৬ রানের।
এক দল চার ম্যাচের তিনটিতেই জিতেছে। আরেক দল জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর পর হেরেছে টানা তিনটি ম্যাচ।
পয়েন্ট তালিকায় অবশ্য দুই দলের পার্থক্যটা খুব একটা মূর্ত নয়। এক দল ৩ নম্বরে আছে। আরেক দল ৬ নম্বরে। যদিও এই ‘৬ নম্বর’ হয়তো একটু ভুলই বোঝাচ্ছে। এই বিশ্বকাপে ১০ দলের অর্ধেক, মানে ৫টি দলেরই একটি করে জয়ে ২ পয়েন্ট। পয়েন্ট তালিকার নিচের অর্ধেকের ক্রম নির্ধারিত তাই নেট রান রেটে। যা মোটেই ধ্রুব কিছু নয়, এক ম্যাচেই বদলে যেতে পারে।
দল দুটির নাম ইচ্ছা করেই লিখিনি। আপনার তা জানা আছে ধরে নিয়ে। তারপরও কি বলে দেওয়া ভালো? ঠিক আছে, বলেই দিই। প্রথম দলটির নাম দক্ষিণ আফ্রিকা। দ্বিতীয়টির বাংলাদেশ।
তা এমন দুই দল মুখোমুখি হলে সেই ম্যাচটা কেমন হতে পারে, বলুন তো!
পুনেতে বাংলাদেশের এর আগের ম্যাচটার আগে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছিল। এটাই হয়তো এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ম্যাচ। প্রতিপক্ষ এই বিশ্বকাপের স্বাগতিক, সবচেয়ে ফর্মে থাকা দলও। সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সাম্প্রতিক ইতিহাস যোগ হয়ে ওই ম্যাচটার আগে আবহটা সত্যিই সরগরম হয়ে উঠেছিল। ভারতের আগেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের সঙ্গেও খেলে ফেলেছে বাংলাদেশ। তারপরও এখন মনে হচ্ছে, আগামীকাল মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামেই হয়তো এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এমন মনে হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ তো অবশ্যই এই মাঠে গত পরশুর ম্যাচের স্মৃতি।
ব্যাটে-বলে সেদিন যে তাণ্ডব চালিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তা আর শুধুই একটা ম্যাচে সীমাবদ্ধ নেই। গত চার বছর সাদা বলের ক্রিকেটে রাজত্ব করা ইংল্যান্ডকে ব্যাটে-বলে দুরমুশ করে দেওয়ার ধরন বিস্ময়ে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে এই বিশ্বকাপকেই। ইংল্যান্ড এর আগে ওয়ানডেতে কখনো এত রানের নিচে চাপা পড়েনি। এত বড় পরাজয়ের সঙ্গেও পরিচয় এই প্রথম। এই বিশ্বকাপ শেষ হতে হতে হয়তো ওই ম্যাচকে মনে রাখতে হবে ‘একটা যুগের অবসান’ বলে। সাদা বলে ইংল্যান্ডের আধিপত্যের যুগ।
এমন নয় যে ব্যাট হাতে দক্ষিণ আফ্রিকার রুদ্ররূপ সেদিনই প্রথম। এই বিশ্বকাপে তিন ম্যাচে আগে ব্যাটিং করে সবচেয়ে কম রান ৩১১। বাকি দুই ম্যাচের একটিতে রেকর্ড ৪২৮, অন্যটিতে ৩৯৯। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ছয় ব্যাটসম্যান মিলেই গড়েছেন এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ভীতিকর ব্যাটিং লাইনআপ। সাত নম্বরে যে অলরাউন্ডার নামেন, সেই মার্কো ইয়ানসেনও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মেলে ধরেছেন ‘ক্লিন হিটিং’য়ের অবিশ্বাস্য এক প্রদর্শনী। প্রথম ছয়ে পরিবর্তন হলেও দেখা যাচ্ছে সমস্যা নেই।
অসুস্থতার কারণে অধিনায়ক টেন্ডা বাভুমা খেলতে পারবেন না বলে টস হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে যিনি খেলবেন বলে জেনেছেন, সেই রিজা হেনড্রিকসও খেলে দিয়েছেন ৮৫ রানের এক ইনিংস। আর হাইনরিখ ক্লাসেনের ৬৭ বলে ১০৭ তো নির্ঘাত থাকবে এই বিশ্বকাপের সেরা ইনিংসের তালিকায়। এদিন যাঁরা ব্যর্থ, তাঁদের একজন কুইন্টন ডি কক সেঞ্চুরি করেছেন আগের তিন ম্যাচের দুটিতেই। এই দক্ষিণ আফ্রিকা কীভাবে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরেছে, তা নিয়ে বিস্ময়টা আরও বেড়েছে এই ম্যাচের পর।
এমন একটা দলের বিপক্ষে এলোমেলো ব্যাটিং লাইনআপ আর গড়পড়তা বোলিং আক্রমণের বাংলাদেশের কি আদৌ কোনো সুযোগ আছে? খেলাটা ক্রিকেট বলেই শুধু এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ায় ঝুঁকি থাকে। নেদারল্যান্ডস পারলে আমরা কেন নয়—এটা ভেবে কিছুটা সাহস তো পাবেই বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইতিহাস মনে করে আরেকটু। ২০০৭ বিশ্বকাপে জয় আছে। ২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শুরুই তো ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। বিশ্বাস করতে একটু কষ্টই হতে পারে, বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে দুবার হারানো প্রথম এশিয়ান দলের নাম ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কা নয়, এই কৃতিত্ব বাংলাদেশের।
সেটিও কী দাপুটে জয়! শেষে এসে এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে ২০১৯ বিশ্বকাপ তেমন একটা সমাদর পায় না। অথচ চার ম্যাচ শেষে তুলনা করলে ২০১৯ বিশ্বকাপকে এখন তো অনেকটা স্বপ্নের মতো মনে হয়। প্রথম চার ম্যাচের দুটিতে জয়। তা–ও আবার যেনতেন জয় নয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় ৩৩০ রান করে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩২১ রান তাড়া করে। মাঝখানে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জেতার সম্ভাবনা জাগিয়ে ২ উইকেটে হার। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বেশ বড় পরাজয়েও বাংলাদেশের এক ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি ছিল।
আর এই বিশ্বকাপে বলার মতো পারফরম্যান্স বলতে প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারানো। পরের তিন ম্যাচে শুধু হারলেও কথা ছিল। জয়-পরাজয় নিয়ে কোনো সংশয় জাগাতেও তো ব্যর্থ বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগের দিন কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যা বলেছিলেন, এই ম্যাচের আগে তা হয়তো আরও বেশি সত্যি। দক্ষিণ আফ্রিকা যদি অত ভালো না খেলে, আর বাংলাদেশ খুব ভালো খেলে ফেলে, তাহলেই শুধু সম্ভব। তা না হলে কী হতে পারে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার পারফরম্যান্স তার একটা আভাস তো দিয়ে রেখেছেই।
জয়ের আশা করুন, সমস্যা নেই। তবে ভয়ংকর কিছুর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখাও মনে হয় ভালো।