পাকিস্তানি ক্রিকেটার আমির খান বাংলাদেশের হয়ে খেলতে চান
‘কেমন আছেন, ভাই?’
আমির খানের মুখে পরিষ্কার বাংলায় এ প্রশ্ন শুনে একটু চমকে যেতে হলো! একজন পাকিস্তানি ক্রিকেটারের সঙ্গে বাংলায় কথা বলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমির অবশ্য বাংলাদেশে আছেন দুই বছর হতে চলল। টুকটাক বাংলা এত দিনে শিখে যাওয়ারই কথা। কিন্তু কোনো জড়তা ছাড়া এতটা পরিষ্কার বাংলা বলবেন, তা ভাবিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘ভালো আছি। আপনার বাংলা তো দারুণ!’
কথাটা শুনে আমির হাসলেন। এরপর ভাঙা ভাঙা বাংলায় যা বললেন, তা শোনার পর বিষয়টা পরিষ্কার হলো, ‘আমি বাংলা ভালো পারি না। শেখার চেষ্টা করছি।’ বাক্য দুটি আগের মতো পরিচ্ছন্ন শোনাল না। বিদেশি টান ছিল যথেষ্ট। বুঝতে পারলাম, আমির এখন পর্যন্ত ‘কেমন আছেন’টাই ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। অন্তত যেকোনো বাংলাদেশিকে চমকে দেওয়ার জন্য তো যথেষ্ট।
আমিরের ক্রিকেট-যাত্রার গল্পটাও অনেককে অবাক করবে। লাহোরের যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখানে ক্রিকেট প্রথম পছন্দ ছিল না। কিংবদন্তি স্কোয়াশ খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর খান তাঁদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। পরিবারের সবার মধ্যেই স্কোয়াশের প্রতি আলাদা টান ছিল।
আমির একটু ব্যতিক্রম। তাঁর পছন্দ ছিল ক্রিকেট। স্কুল ক্রিকেট থেকেই পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার যাত্রা শুরু। লাহোরের মুসলিম মডেল স্কুলে আমিরের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন পাকিস্তানের অধিনায়ক বাবর আজম, ফাহিম আশরাফরা। ২৭ বছর বয়সী এই বাঁহাতি স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার স্কুল ক্রিকেটের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় পর্যায়ে যেতে পারেননি। কিন্তু পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন নিয়মিত। লাহোর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে খেলেছেন প্রায় ১০ বছর। খেলেছেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে।
২০২২ সালে আমিরের জীবনে বাঁকবদল আসে। বাংলাদেশে এক বন্ধুর মাধ্যমে আমিরের সঙ্গে পরিচয় হয় রোজি আখতার মিমের। বাংলাদেশের এই মেয়ের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ, এরপর প্রণয়। গত বছর সেই প্রণয় দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েতে পরিণতি পায়। লাহোরের সেই আমির এখন স্ত্রীসহ ঢাকাতেই থাকেন।
তা আমিরের প্রথম প্রেম ক্রিকেটের কী হলো? ঢাকায় এসে কোথায় ক্রিকেট খেলা যায়, সেই খোঁজ করতে করতে ধানমন্ডির শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমির খোঁজ পেয়ে যান আমির। গত বছর থেকে সেখানেই কাটে আমিরের দুপুর-বিকেল। দেশ বদলে গেলেও আমিরের স্বপ্ন বদলায়নি। পাকিস্তানে যে স্বপ্ন নিয়ে ক্রিকেট খেলতেন, সে স্বপ্ন এখানেও লালন করছেন—দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন। আর আমিরের দেশ তো এখন বাংলাদেশও! আমিরও এখন বাংলাদেশের হয়ে খেলার স্বপ্নে বিভোর।
নাগরিকত্ব পেতে এর মধ্যেই আমির কাজ শুরু করে দিয়েছেন, ‘ক্লাব, ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে তো অনেকেই খেলে। দেশের হয়ে খেলাটা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সেটা পাকিস্তান হোক কিংবা বাংলাদেশ, দেশের হয়ে খেলা বিরাট অর্জন। আমিও সে চেষ্টাই করছি। কাজগুলো ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। শেখ জামালকে ধন্যবাদ যে তারা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে এত ভালো সুযোগ-সুবিধার মাঝে অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার। আমি আশা করি, প্রথম বিভাগ, ঢাকা লিগ বা বিপিএল—যেকোনো পর্যায়ে তাদের প্রতিনিধিত্ব করে প্রতিদান দিতে পারব। এখানে বিসিবির অনেক কোচই কাজ করেন। প্রত্যেকেই অসাধারণ! আমি তাঁদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখছি।’
শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব নিয়ে আমিরের রোমাঞ্চের আরেকটা কারণও আছে। এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দলটিতে খেলছেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই মহাতারকার মতো আমিরও বাঁহাতি স্পিনার। কোনো এক দিন শেখ জামালের মাঠে সাকিব অনুশীলনে আসবেন, সেই অপেক্ষায় আছেন আমির, ‘আমি আশায় আছি। কখনো যদি দেখা হয়, তাহলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব। আমার জন্য হবে সেটা বিরাট পাওয়া।’
পাকিস্তানের আমির এখন বাংলাদেশের হওয়ার চেষ্টা করলেও অতীতটাকে একেবারেই মুছে ফেলেননি। ঢাকায় বসে লাহোরে নিজ পরিবারের ৮০ বছর পুরোনো ব্যবসার খোঁজ রাখতে হয় তাঁকে, ‘এখন যেহেতু পরিবারকে দেখতে হচ্ছে, তাই অনলাইনে ব্যবসার খোঁজ রাখি। খুব দরকার হলে পাকিস্তানেও যেতে হয়। গত বছরে যেমন তিনবার গিয়েছিলাম।’
যোগাযোগ আছে খেলোয়াড় বন্ধুদের সঙ্গেও, ‘আমরা যখন ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতাম, তখন মোহাম্মদ আমির নিষিদ্ধ ছিলেন। ওই সময় তিনি কোনো ম্যাচ না খেললেও অনুশীলন করতেন আমাদের সঙ্গে। এখন তো উনি আবার জাতীয় দলে ফিরেছেন। আশা করি ভালো করবেন। বাবরদের পুরো পরিবারেই তো ক্রিকেটারের ভিড়। উমর আকমলরা একই পরিবারের। আমরা সবাই একসঙ্গেই বড় হয়েছি।’
লাহোরের সেই আমির এখন দলছুট। তাঁর নতুন ঠিকানা এখন লাহোর নয়, ঢাকা। কে জানে কোনো এক দিন তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়ে পাকিস্তানি থেকে বাংলাদেশি ক্রিকেটার হতে পারবেন কি না!