চট্টগ্রামের গ্যালারিতেও আফগান দাপট
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে যে আফগান সমর্থকেরা দলের জন্য গলা ফাটিয়েছেন, ক্রিকেট তাঁদের কাছে খেলার চেয়ে বেশি কিছু।
‘আফ গা নিস তান!’ ‘আফ গা নিস তান!’—জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের রুফটপ গ্যালারিতে একদল আফগানিস্তান সমর্থক স্লোগান দিয়েই যাচ্ছিলেন। কিন্তু শুধু স্লোগানে কী আর হয়! বাদ্যবাজনাও তো লাগে। গ্যালারির চেয়ার হয়ে গেল ঢোল। ছন্দে ছন্দে হাততালি চলল।
সঙ্গে দুই হাত উঁচিয়ে মাথা নিচু করে আফগান নৃত্য তো আছেই। সেই দর্শকদের গায়েও ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক। নিজেদের মধ্যে কেউ কেউ কথা বলছিলেন পশতুতে, কেউ ইংরেজিতে। আফগান দর্শকদের এমন আরও একটা দলকে দেখা যাচ্ছিল স্টেডিয়ামের পশ্চিম গ্যালারিতে। আফগানদের দাপটের দিনে গ্যালারির বাংলাদেশি সমর্থকেরা যখন নীরব দর্শক, আফগানদের সেই উদ্যাপনই বারবার কানে আসছিল।
গ্যালারির সেই আফগান সমর্থকদের দলটার মধ্যেই রুবিনাকে পাওয়া গেল। তাঁর গায়েও ঐতিহ্যবাহী আফগান পোশাক। আফগানি অলংকারে কপাল ঢাকা, মুখে চওড়া হাসি। কথা বলে জানা গেল, রুবিনা আফগানিস্তানে সাংবাদিকতা করতেন এক টিভি চ্যানেলে। এখন বাংলাদেশে এসেছেন পড়াশোনা করতে। তাঁর বাংলাদেশে পাড়ি জমানোর কারণটা বুঝতে কষ্ট হলো না। আফগানিস্তানে নারীদের কী অবস্থা, তা তো প্রায় সবারই জানা।
চট্টগ্রামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসা কাবুলের মেয়ে ইসমায়ার কথায় আফগানিস্তানের পরিস্থিতিটা কিছুটা হলেও উঠে এল, ‘বাংলাদেশে এসেছি চার মাসের মতো হয়েছে। খুব ভালো দেশ। প্রথমত, আমরা মুসলমান। নিজেকে এখানে আফগানিস্তানের চেয়ে স্বাধীন মনে হয়। আফগানিস্তানে এখন কী অবস্থা, জানেন তো...তালেবানরা সেখানে নারীদের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে। মেয়েদের পড়ালেখা করতে দেওয়া হয় না, বাইরে কাজ করতে দেওয়া হয় না।’
কথাগুলো বলার সময় ইসমায়ার বাঁ হাতের অলংকারে টুন টুন শব্দ হচ্ছিল। তাঁর মুখভর্তি হাসিতে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওড়ার আনন্দ। বাংলাদেশ যেন তাঁর কাছে আনন্দজগৎ, ‘বাংলাদেশ আমার জন্য খুবই নতুন। তবে এরই মধ্যে এখানে খুব ভালো লাগছে। আমি এখানে পড়ালেখা করতে পারছি। যেখানে খুশি যেতে পারছি। নিজের পছন্দে জামাকাপড় পরতে পারি। সব সময় মাথায় স্কার্ফ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।’
ইসমায়ার মতো শাকিলা সুলতানাও চট্টগ্রামে পড়াশোনা করেন। বাহারি সাজ নিয়ে মাঠে গলা ফাটাচ্ছিলেন তিনিও। মাঠে আসা বাংলাদেশ দলের সমর্থকেরা তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন। ‘ইব্রাহিম’, ‘গুরবাজ’—বলে অনেকটা সময় চিৎকার করে করে ক্লান্ত তিনি। দুই আফগান ওপেনারের রেকর্ড জুটিও হয়তো একটা কারণ। ড্রিংকস ব্রেকের সময় শাকিলা কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ পেলেন।
পরিচিত হওয়ার পর জানা গেল, আফগানিস্তানে জাতীয় বক্সিং দলের খেলোয়াড় শাকিলা! তবে তিনি আফগানিস্তান ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই বক্সিং করি। আমি দুই মাস আগে বাংলাদেশে এসেছি পড়ালেখা করতে। এখানে খেলা দেখতে এলাম প্রথমবার। তবে আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের খোঁজখবর রাখি সব সময়। রশিদ খান ও নুর আহমেদ আমার পছন্দের।’
শাকিলা কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন পাশেই দাঁড়িয়ে আফগানিস্তানের বিশাল পতাকা ওড়াচ্ছিলেন রহিম সিদ্দিকি। আফগান ক্রিকেটের খোঁজ যাঁরা রাখেন, তাঁদের রহিমকে চেনার কথা।
আফগান ক্রিকেট বোর্ডের তালিকাভুক্ত ‘সুপার ফ্যান’ এই রহিম। নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী এই আফগান যুবক আফগানদের খেলা দেখতে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে সেই ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫টি দেশে ঘুরেছেন। আফগানদের আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশ থেকে টেস্ট দল হতে দেখেছেন।
তথ্যগুলো দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই রহিমকে ডেকে নিলেন বাংলাদেশের ‘সুপার ফ্যান’ মিলন। গ্যালারির চেয়ারের নিচ থেকে এক প্যাকেট মিষ্টি রহিমের হাতে তুলে দিলেন। রহিম হইচই করতে করতে তা নিয়ে চলে গেলেন আফগান দর্শকদের জটলায়। সেখানেই চলল মিষ্টি বিতরণ। ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা নাসির রাওয়ানও ছিলেন সেখানে।
আটজন আফগানি ছাত্রছাত্রীসহ নাসির চট্টগ্রামে এসেছেন তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ‘লেট আফগান গার্ল লার্ন’ লেখা টি–শার্ট তাঁদের গায়ে জড়ানো। নাসির সে লেখাটার সূত্র ধরে বলছিলেন, ‘আমরা নিজেদের অবস্থান থেকে তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে চাচ্ছি। তারা মেয়েদের স্কুলে যেতে বাধা দেয়। এটি করা উচিত নয়। তাদেরও শিক্ষার অধিকার আছে।’
আফগানিস্তানের ব্যাপারে একটা কথা সব সময় শোনা যায়। খেলাটা নাকি তাদের কাছে শুধু খেলা নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু। নাসিরদের জন্য যেমন ক্রিকেট তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মঞ্চও। ইসমায়া, শাকিলাদের জন্য ক্রিকেট অনেকটা খোলা আকাশের মতো। পাখির মতো ওড়ার জন্য তো আকাশই চাই।
ক্রিকেট আফগানিস্তানের জন্য আরও কত কী!