ব্র্যাডম্যানের চিঠিতে ওয়ার্ন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এবং আরও যাঁরা আছেন
অন্যলোকে তাঁরা হয়তো এখন চুটিয়ে খোশগল্প করছেন। এদিকে আমরা এই লোকে বসে কিছু চিঠি পড়ে বিস্মিত হচ্ছি। জাগছে আবেগও। ‘আঙুলের মিহিন সেলাই’য়ে মনের যে গোপন দ্বার খুলেছিলেন তিনি, তাতে উঠে এসেছে কত কিছু!
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতন, অস্ট্রেলিয়ার ২৪তম প্রধানমন্ত্রী পল কিটিং, রাজীব গান্ধী হত্যা, মার্গারেট থ্যাচার ও শেন ওয়ার্ন। আহা! ওয়ার্ন! ব্র্যাডম্যান কী মুগ্ধই না ছিলেন প্রয়াত লেগ স্পিন জাদুকরে। অন্যলোকে দুজনের চুটিয়ে খোশগল্প করার কথা সে জন্যই বলা। এদিকে ২০টির বেশি চিঠিতে ব্যাটিংয়ের শেষ কথাকে আমরা আবিষ্কার করছি যেন নতুন করে। শুধু ব্যাটিং নয়, কত কিছুতেই না চোখ ছিল তাঁর!
চিঠিগুলো স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। লিখেছিলেন ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে। প্রাপক তাঁর ইংরেজ বন্ধু ও পঞ্চাশের দশকে রেডিওর বিখ্যাত কণ্ঠ পিটার ব্রাফ। ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে তাঁর পরিচয় বাবা আর্থারের মাধ্যমে, তিরিশের দশকে অস্ট্রেলিয়া দলের ইংল্যান্ড সফরে। পরিচয় থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব চিঠি চালাচালির মাধ্যমে টিকে ছিল বহু বছর। ব্রাফও নিশ্চয়ই সেই লোকে ওয়ার্ন ও ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে বসে আড্ডা দেন! তিনি গেলেন ১৯৯৯ সালে, তার দুই বছর পর ব্র্যাডম্যানও। পরে ব্রাফের পরিবার ব্র্যাডম্যানের চিঠিগুলো অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে দান করে। সেসব পাতা থেকেই জেনে নিন, আঙুলের মিহিন সেলাইয়ে, বয়ানের বুননে ওয়ার্নকে নিয়ে কেমন অনুভবের কেমন নকশিকাঁথা বুনেছিলেন ব্র্যাডম্যান—
১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লেখা চিঠিতে ওয়ার্নের প্রসঙ্গ টানেন ব্র্যাডম্যান। আগের বছর সেপ্টেম্বরে তাঁর স্ত্রী মারা যান। চিঠির শুরুটা সে জন্যই বুঝি ভীষণ মন খারাপের, ‘জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। যেদিকেই তাকাই, শুধু দুঃখ ও স্মৃতি। এমনকি গলফ ম্যাচ কিংবা একদান ব্রিজ খেলার পরও কথা বলার কেউ নেই। তুমি (ব্রাফ) ঠিক বলেছ, রাতগুলোও একাকিত্বের। ক্রিকেট দেখতে আর যাই না, সাংবাদিকদের সহ্য হয় না...আসলে নিঃসঙ্গ এক জীবন কাটাচ্ছি। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে টিভি আছে...।’
এরপরই সে বছর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সিরিজ নিয়ে ওয়ার্নের প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্র্যাডম্যান, ‘আসল পার্থক্য ছিল ওয়ার্ন। সিডনি টেস্টে তাকে বল করতে দেখাটা ছিল দারুণ ব্যাপার, (তার বল) টার্ন করছিল, দারুণ এক প্রদর্শনী। আমাদের ছেলেরা এই সপ্তাহেই ভারতে গিয়ে ওদের ঘরোয়া কন্ডিশনে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। টেন্ডুলকার সম্ভবত এ মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান এবং তার সঙ্গে ওয়ার্নের লড়াইটা হবে ভীষণ চিত্তাকর্ষক।’
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওয়ার্নের অভিষেক ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে সময় লেগ স্পিন–শিল্পের মৃত্যু দেখছিলেন ব্র্যাডম্যান। এর মধ্যে ওয়ার্নের উঠে আসা তাঁকে আন্দোলিত করেছিল। মে মাসে লেখা চিঠিতে দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন, ‘আধুনিক ক্রিকেটের খুব মর্মান্তিক ব্যাপার হলো, স্লো লেগ স্পিনারদের মৃত্যু ঘটছে। শুরুতে মনে হয়েছিল, ওয়ানডে ক্রিকেট এটার কারণ, যেখানে “ইকোনমি”ই শেষ কথা। আউট করার দরকার নেই। রান আটকাতে পারলেই হয়।’
অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে ওয়ার্নের অভিষেক হলো পরের বছর জানুয়ারিতে। ব্র্যাডম্যান তত দিনে ওয়ার্নকে চোখে চোখে রাখা শুরু করেছেন। ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চে লেখা চিঠিতে ব্যাপারটা বোঝা যায়। লেগ স্পিন–শিল্পের মৃত্যুর মাঝে ওয়ার্ন আলোকবর্তিকা হয়ে উঠে আসায় সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্র্যাডম্যান লিখেছিলেন, ‘কিন্তু ধন্যবাদ যে আমরা তরুণ ওয়ার্নের মধ্যে ভালো একটি লেগ স্পিনার পেয়েছি। তার বয়স মাত্র ২৩ এবং আসলেই সে খুব ভালো টার্ন করাতে পারে। অ্যাকুরেসিও দারুণ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এখন যে টেস্ট খেলা হচ্ছে, সেখানে সে ওভারে দুইয়ের কম করে রান দিচ্ছে, যেটা অসাধারণ। তার ইংল্যান্ডেও ভালো করা উচিত।’
ব্র্যাডম্যানের ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৯৩ অ্যাশেজ ওয়ার্নের ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’র জন্য আলাদা করে খ্যাতি পেয়েছে। সেটা ছিল আবার ইংল্যান্ডের মাটিতে ওয়ার্নের প্রথম বল। ৬ ম্যাচের সেই সিরিজ ৪–১ ব্যবধানে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ব্র্যাডম্যান চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমাদের ছেলেরা ভালো খেলেছে সেই প্রশংসা করতেই হবে। ফ্লিটউড–স্মিথের পর কোনো তরুণ লেগ স্পিনারকে বল এতটা বাঁক খাওয়াতে দেখেও খুব রোমাঞ্চ লেগেছে। সে রানও কম দিয়েছে। ফাস্ট বোলারদের অন্তহীন মিছিল থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার সময়টা এখনই।’
১৮ মাস পর, ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে লেখা চিঠিতে আবারও ওয়ার্নকে নিয়ে প্রশংসার বান ছুটিয়ে দেন ব্র্যাডম্যান, ‘শেন ওয়ার্ন দারুণ বোলিং করছে এবং সব রকমের সমস্যাই তৈরি করছে। (বিল) ও’রিলি বাদে ওয়ার্ন আমাদের তৈরি করা সেরা স্লো লেগ স্পিনার। এমনকি (ক্ল্যারি) গ্রিমেটের চেয়েও ভালো, যেটা অনেক উঁচুমানের প্রশংসা।’
অন্য চিঠিতে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন ব্র্যাডম্যান। ১৯৮৬ সালের মে মাসে রানির রাজকীয় প্রমোদতরিতে মধ্যাহ্নভোজের জন্য আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গিয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। সে বিষয়ে ওই বছরেরই ১১ মে ব্র্যাডম্যান চিঠিতে লেখেন, ‘৭০ জন বিশেষ অতিথি ছিলেন...আমি রানির টেবিলে বসেছিলাম। তাকে দারুণ লাগছিল। সাধারণ নাগরিকদের মতো স্বাভাবিকভাবে হাসিখুশি থেকে কথা বললেন। কোনো বাগাড়ম্বর নেই। তিনি উঠে যাওয়ার পর স্টুয়ার্ড এবং অন্যরা আমাকে ঘিরে ধরে অটোগ্রাফ চাওয়ায় একটু বিরক্তও লেগেছিল।’
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল কিটিংকে অপছন্দের কথা জানিয়েছেন ব্র্যাডম্যান। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ১৯৯১ সালের ২৯ আগস্টে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র শেষ হওয়ায় খুব আনন্দ লাগছে। এটা চতুর এবং শয়তানি দর্শন।’
সে বছরই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে মার্গারেট থ্যাচার সরে দাঁড়ানোয় দুঃখ পেয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। রাজীব গান্ধী হত্যার পর চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ভারতে যা ঘটেছে অন্তত আমরা সেসব থেকে মুক্ত রয়েছি।’ অস্ট্রেলিয়া দলে ব্রুস রিড ও স্টিভ ওয়াহর অন্তর্ভুক্তিতেও চিঠিতে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন ব্যাটিংয়ে ৯৯.৯৪ গড়ের মালিক। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে চিঠিতে মার্টিন ক্রোকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘বিশ্বের সেরা তিন ব্যাটসম্যানের তালিকায় সে অবশ্যই থাকবে। দুর্দান্ত টেকনিক, একটাই দুর্বলতা, আগ্রাসনের ঘাটতি। কিন্তু সে দারুণ এক মডেল।’