সাকিব-ম্যাথুস এবার সতীর্থ: ‘টাইমড আউট’-এর স্মৃতি এবং নিয়তির খেয়াল
বিপিএলে গতকাল সোনারগাঁও হোটেলে প্লেয়ার্স ড্রাফটে তাঁদের নাম ডাকা হয়নি। কারণ, সরাসরি চুক্তিতে দুজনকে আগেই দলে ভিড়িয়েছে চিটাগং কিংস। তখনই হয়তো কারও কারও মনে গত বছর নভেম্বরে দিল্লির সেই ঘটনা উঁকি দিয়েছে। গতকাল প্লেয়ার্স ড্রাফটের পর চট্টগ্রাম কিংসের ২০ সদস্যের খেলোয়াড় তালিকা দেখেও কেউ কেউ হয়তো ফিরে গিয়েছেন দিল্লির সেই বিকেলে। সাকিব আল হাসান, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস...ব্যস, আর কিছু লাগে!
‘যে তোমার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখে, তার পথে ফুল ছিটিয়ে দাও’—এ বাণী মনীষীদের। দিল্লিতে ম্যাথুসের আসার পথে বুদ্ধি ও সময়জ্ঞানের ‘কাঁটা’ বিছিয়ে রেখেছিলেন সাকিব। ম্যাথুস তাতে বিদ্ধ হয়ে আর ক্রিজে যেতে পারেননি। টাইমড আউট!
পরে এ নিয়ে কত বিতর্ক হলো, কত কথা হলো! নিয়মের বইপত্রও খুলে দেখা হলো। জানা গেল, সাকিব নিয়মের ভেতরে থেকেই ম্যাথুসকে ‘কাঁটা’ ফুটিয়েছেন। লঙ্কানদের মধ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় শতভাগ। তবে কোনো জাতি কতটা প্রতিশোধপরায়ণ তা নির্ণয়ের কোনো যন্ত্রপাতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই লঙ্কানদের মধ্যে এই ধারা কতটা, তা বলা না গেলেও চিত্র দেখে আন্দাজ তো করে নেওয়া যায়। এ বছর মার্চেই বাংলাদেশ সফরে এসে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের পর নাজমুল হোসেনদের সামনে ‘টাইমড আউট’ উদ্যাপন করেছিলেন শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়েরা। সেই চিত্র যে খুব একটা দৃষ্টিসুখকর ছিল না, তা বোঝেন লঙ্কানরাও। কিংসকে তাই লঙ্কানরা ধন্যবাদ জানাতেই পারেন। কারণ, ম্যাথুসের পথে সাকিবকে যে এখন ‘ফুল’ বিছিয়ে রাখতে হবে!
ব্যাপারটা পুরোপুরি এমন না হলেও খুব দূরবর্তী ভাবনাও নয়। কিংস দুজনকেই দলে টেনেছে। অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া বিপিএলে সতীর্থ হিসেবে খেলবেন সাকিব ও ম্যাথুস। যেহেতু সতীর্থ, তাই বিপিএলে অন্তত ম্যাথুসকে ‘টাইমড আউট’ করার সুযোগটা সাকিব পাচ্ছেন না। উল্টো, ম্যাথুস এমন কিছুর শিকার হলে সাকিবকে তাঁর হয়ে গলা ফাটাতে হবে। শুধু তা–ই নয়, সাকিব চাইলে কিছু বিষয় আগে থেকে ভেবেও রাখতে পারেন।
সাকিব ও ম্যাথুস—দুজনেই অলরাউন্ডার। ব্যাটিং পজিশনও তাই কাছাকাছি হবে। অর্থাৎ দুজনের একসঙ্গে ব্যাটিং করার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তো, সাকিব তাঁর আগে নামলে পকেটে করে হেলমেটের অতিরিক্ত একটি স্ট্র্যাপ নিয়ে যেতে পারেন। কারণ, ম্যাথুস যেহেতু পরে নামবেন, তাঁর এটা লাগতে পারে। কিংবা সাকিব ক্রিজে থাকতে অন্য প্রান্তের ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর তিনি দৌড়ে একটু এগিয়ে গিয়ে (অবশ্যই মাঠের সীমানার ভেতরে থাকতে হবে) ম্যাথুসকে ডাকতে পারেন, ‘ম্যাথুস, ম্যাথুস ডাক পাড়ি, টাইমড আউটের নেই বেশি (সময়) বাকি!’
লঙ্কানদের চোখে এটুকু হতে পারে, সাকিবের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত। কিসের—সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠবে না। হেলমেটের স্ট্র্যাপ এবং সময়—দিল্লির সেই ‘টাইমড আউট’ বিতর্কের মূলে তো এ দুটি বিষয়ই ছিল!
২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে আগে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল শ্রীলঙ্কা। অধিনায়ক সাকিবের করা ২৪.২ ওভারে সাদিরা সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার পর নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে এসেছিলেন ম্যাথুস। ক্রিজে দাঁড়িয়ে টের পেলেন, তাঁর হেলমেটের স্ট্র্যাপে (ফিতা) কোনো একটা সমস্যা, সম্ভবত ছেঁড়া ছিল। ড্রেসিংরুমে ইশারা করলেন নতুন হেলমেটের জন্য। অতিরিক্ত খেলোয়াড়ের মাধ্যমে নতুন হেলমেট আনতে কিছুটা দেরি হলো। তখন ম্যাথুসকে ‘টাইমড আউট’–এর আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব। আইনসিদ্ধ হওয়ায় মাঠের আম্পায়ার আবেদন মেনে নিয়ে ম্যাথুসকে আউট ঘোষণা করেন। জন্ম হয় নতুন ইতিহাস ও বিতর্কের।
ম্যাথুস হলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ‘টাইমড আউট’ হওয়া ব্যাটসম্যান, আর ক্রিকেট–বিশ্বে বিভক্ত হলো ‘স্পিরিট অব দ্য গেম’ নিয়ে। অর্থাৎ সাকিবের আচরণ খেলোয়াড়সুলভ ছিল কি না, এই প্রশ্নে বিভক্তি দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু এখন বিভক্তি নয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিপক্ষকে ‘টাইমড আউট’ করার সময়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাথুস যেহেতু প্রথম ‘টাইমড আউট’ হওয়া ব্যাটসম্যান, আর সাকিবও এই আউটের আবেদন করে সফল হওয়া প্রথম অধিনায়ক (ক্রিকেটার)—তাই ‘টাইমড আউট’ কীভাবে হয় কিংবা কখন এই আউটের আবেদন করতে হবে, তা সাকিব-ম্যাথুসের চেয়ে ভালো জানবেন কে! অর্থাৎ বিপিএলে এই দুই ক্রিকেটারকে মিলেমিশে প্রতিপক্ষকে টাইমড আউট করতে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। লঙ্কানরাও এমন কিছু দেখলে নিশ্চয়ই শান্তি পাবেন।
ম্যাথুসকে টাইমড আউট করে যে ক্রিকেটার লঙ্কানদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন, সেই একই খেলোয়াড় এখন সতীর্থ হিসেবে দলীয় সাফল্যে তাঁকে বুকে টেনে নেবেন, একসঙ্গে উদ্যাপন করবেন এবং প্রয়োজনে এই সতীর্থের জন্য গলাও ফাটাবেন। এর চেয়ে বড় প্রতিশোধ আর কী হতে পারে! এসবই আসলে নিয়তির খেয়াল। চিটাগং কিংস সেখানে উপলক্ষ্য মাত্র!