সেই হেডই এখন ‘কিংবদন্তি’
‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে দাগই ভালো’—বাংলাদেশি একটি বিজ্ঞাপনের প্রবল জনপ্রিয় এই স্লোগান ট্রাভিস হেডের জানার কথা নয়। তবে ২৯ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান বাঁহাতির এখনকার অনুভূতি অনেকটা এ রকমই।
সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে বাঁ হাতে চোট পেয়েছিলেন হেড। যে চোট তাঁকে দল থেকে বেরিয়ে বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য করে। কিন্তু বছর দুয়েক ধরে যে দুর্দান্ত ছন্দে খেলে গেছেন, হেডকে টুর্নামেন্টের প্রথম অর্ধেকে পাওয়া যাবে না জেনেও তাঁকে নিয়েই বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের প্রথম পাঁচ ম্যাচে তাঁকে পায়ওনি প্যাট কামিন্সের দল। মাসখানেক পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে চনমনে হয়ে বিশ্বকাপের মাঝপথে দলে যোগ দেওয়া সেই হেডই এখন অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক।
ম্যাচসেরা হয়েছিলেন সেমিফাইনালে, ম্যাচসেরা ফাইনালেও। এর আগে এ বছরের জুনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালেও অস্ট্রেলিয়ার জয়ের নায়ক (১৭৪ বলে ১৬৩) ছিলেন এই বাঁহাতি। আইসিসির দুটি বড় মঞ্চে কেউ এমন কীর্তি গড়লে যা হয়ে থাকে, হেডকে কাল সেই স্বীকৃতিই দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্স—কিংবদন্তি!
সাত বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা হেডের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দুটি অধ্যায়। প্রথমটি ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত। দ্বিতীয়টি ২০২২ থেকে চলমান। মাঝের সময়টা তিনি ছিলেন শুধুই টেস্ট ক্রিকেটার। প্রথম ৩ বছরে ৪২টি ওয়ানডে খেলা হেডের ব্যাটে ছিল ১০টি অর্ধশতক, শতক মাত্র ১টি। সেই হেডই গত বছর আবারও ৫০ ওভার ক্রিকেটে ফেরার পর ২২ ম্যাচে তুলেছেন ৪টি শতক ও ৬টি অর্ধশতক।
দুই মাস আগে দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে যখন চোটে পড়েন, ২০২২ থেকে তখন পর্যন্ত তাঁর গড় ছিল ৬০.৮৪, স্ট্রাইক রেট ১১৯.১৪। যে কারণে হেডকে ছাড়া বিশ্বকাপের দল গড়ার কথা ভাবতে পারেননি অস্ট্রেলিয়ার কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডরমট ও নির্বাচক জর্জ বেইলি। হাত ভেঙে যাওয়ায় বিশ্বকাপের শেষের দিক ছাড়া পাওয়া যাবে না বোঝার পরও হেডকে ১৫ জনের দলে রাখতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। তবে হাতের অবস্থা এমনও ছিল না যে হেড দলের সঙ্গে থাকবেন আর সুস্থ হয়ে মাঠে নেমে যেতে পারবেন। বিশ্বকাপের শেষের দিকেও তাঁকে না পাওয়ার ঝুঁকি ছিলই। অস্ত্রোপচার করালে যা নিশ্চিতই ছিল। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দক্ষিণ আফিকা সিরিজ শেষে দেশে পরিবারের কাছে ফিরে যান হেড। আর অস্ট্রেলিয়া দল ভারতে পা রাখে ১৪ জন নিয়ে। যার মানে অস্ট্রেলিয়া যখন ভারতে পা রাখে, হেড তখন বিশ্বকাপে ‘অনাগত’ খেলোয়াড়!
হেডবিহীন কামিন্সের দলের শুরুটা ছিল আতংক–জাগানিয়া। প্রথম ম্যাচেই ভারতের কাছে হার ৬ উইকেটে, পরের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ১৩৪ রানে। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার ওই এলোমেলো শুরুর পর ভারতে পৌঁছান হেড। তবে তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নামার মতো ফিট ছিলেন না। যখন ফিট হয়ে ওঠেন, তত দিনে অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ ম্যাচ শেষ। হেড খেলতে নামেন ধর্মশালায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে। সাত বছরের ক্যারিয়ারে এটি ছিল তাঁর বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ। কিন্তু প্রথম ম্যাচের প্রথম কয়েক বলেই বুঝিয়ে দেন, কেন তাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল দল, কেন ঝুঁকি নিয়েছিলেন নির্বাচকেরা। ট্রেন্ট বোল্ট, লকি ফার্গুসনদের ওপর ঝড় বইয়ে দিয়ে মাত্র ২৫ বলেই অর্ধশতকে পৌঁছে যান হেড, যা টেনে নেন তিন অঙ্কেও। ৬৭ বলে ১০৯ রানের ইনিংসটির সুবাদে হন ম্যাচসেরাও।
বিশ্বকাপের অভিষেকেই শতক করে হেড সগৌরবে জানান দেন, বিশ্বকাপ কাঁপাতে তিনি এসে গেছেন। চোটের কারণে মাসখানেক দেশে বসে থাকাটা যে তাঁর উপকারই করেছে, দাগ লাগার মাধ্যমে দারুণ কিছুর সুযোগ করে দিয়েছে, বললেন সেটিও, ‘সে (জেরাল্ড কোয়েৎজি, দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারের বলে চোট পেয়েছিলেন) আমার উপকারই করেছে। চার সপ্তাহ পরিবারের সঙ্গে ঘরে থাকতে পেরেছি, ফলে তরতাজা হয়ে আসতে পেরেছি। আশা করি, আমি টুর্নামেন্টের শেষ দিকে পারফর্ম করতে পারব। এটি শাপেবরই হতে পারে।’
সেই শাপেবরেরই প্রথম দৃষ্টান্ত সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ। ইডেন গার্ডেনে প্রোটিয়াদের ২১২ রান তাড়া করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া যে শেষ পর্যন্ত ১৬ বল বাকি থাকতে ৩ উইকেটে জয় তোলে, তাতে শুরুতেই ৪৮ বলে ৬২ রানের ইনিংসে মূলত কাজটি করে দিয়ে যান হেড। স্বীকৃতি পান ম্যাচসেরারও। সেমিফাইনালের পর চূড়ান্ত মঞ্চ ছিল ফাইনাল। যে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিপক্ষ শুধু ভারতীয় দলের ১১ জন নয়, ১ লাখ ৩০ হাজার আসনবিশিষ্ট গ্যালারিও। টসের সময় থেকে গমগম করতে থাকা সেই গ্যালারিকে প্রথমবার স্তব্ধ করে দেন হেডই। ব্যাটে নয়, ফিল্ডিংয়ে।
৩১ বলে ৪৭ রান করে দুর্দান্ত কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে তুলে মারতে গেলে বল উঠে যায় ওপরে। কাভারে দাঁড়িয়ে থাকা হেড উল্টো দিকে দৌড়ে ১১ মিটার দূরে গিয়ে নেন দুর্দান্ত ক্যাচ। ম্যাচে সেই যে ভারত ধাক্কা খেয়েছে, সেটা তারা আর ঠিকঠাক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, অলআউট হয় ২৪০ রানে।
ফিল্ডিংয়ে হেডের ভূমিকাটা ছিল উইকেট তোলায় সহায়কের, কিন্তু ব্যাটিংয়ে তিনিই হয়ে ওঠেন প্রধান চরিত্র। ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া যে শেষ পর্যন্ত আয়েশী জয় তুলেছে, তা হেডের ১২০ বলে ১৩৭ রানের সুবাদেই। ভারতীয় দলের পুরো ইনিংসে বাউন্ডারি যেখানে ১৬টি, এক হেডই এরচেয়ে তিনটি বেশি বাউন্ডারি মারেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে আরও ছয়টি শতকের ঘটনা থাকলেও রান তাড়ায় ছিল একটিই—১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার অরবিন্দ ডি সিলভার ১০৭*। তখনকার দুই বছর বয়সী হেডই ২৭ বছর পর এসে ছাড়িয়ে যান ডি সিলভাকে।
ফাইনাল–সেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে নিজের এই কীর্তির দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্যই মনে হয়েছে হেডের। উচ্ছ্বাসের তোড়ে বলছিলেন, ‘আমি কখনোই এমন কিছু আশা করিনি। লাখো–কোটি বছরেও নয়। এটি আমার জীবনের অন্য রকম একটি দিন।’
কতটা অন্য রকম, সেটিই ফুটে উঠেছে কামিন্সের কথায়। যেখানে আছে একজন খেলোয়াড়ের আজীবনের স্বীকৃতি, ‘হাত ভেঙে যাওয়ার পরও নির্বাচক এবং চিকিৎসক দল ওর ওপর আস্থা রেখেছিল। ঝুঁকিটা অনেক বড় ছিল। তবে এর প্রতিদান আমরা পেয়েছি। ট্রাভিসের জন্য এরচেয়ে বেশি খুশির কিছু হতে পারে না। সে একজন কিংবদন্তি। আমরা তাকে ভালোবাসি।’