সৌরভের মাথায় ঢুকেছে ‘ক্রিকেটপোকা’, মৃত্যুর আগে ছাড়বে না তা
সৌরভ চতুর্বেদী—কানপুর গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামে নামটা বেশ পরিচিত। পুরোনো আমলের মানুষ বলে সবাই একনামে চেনেন তাঁকে। প্রেসবক্সে টেস্ট ম্যাচ চলাকালে এসে নাম বললেই স্কোরারদের পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখা বৃদ্ধ লোকটিকে দেখিয়ে দেবেন। একসময় তিনি নিজেও স্কোরার ছিলেন। বিসিসিআইয়ের প্রথম স্কোরার প্যানেলের সদস্য ছিলেন সৌরভ। ১৯৯৭ সালে প্রথম বিসিসিআই স্কোরিং প্যানেল শুরু করে। প্রথম ব্যাচেই উত্তর প্রদেশ তো বটেই, সেন্ট্রাল জোনেরই একমাত্র প্রতিনিধি সৌরভ।
তবে সৌরভের ক্রিকেট ম্যাচে স্কোরিংয়ের নেশা আরও পুরোনো। ১৯৫৯ সালে কানপুরে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের টেস্ট ম্যাচে সৌরভ স্কোরিং করেছিলেন স্টেডিয়ামের স্টুডেন্ট গ্যালারিতে বসে। কাগজে–কলমে করা সেই ম্যাচের স্কোরিংয়ের গল্প নিয়ে এখনো গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামের স্কোরারদের মধ্যে চর্চা হয়। সেই ম্যাচটার আলাদা গল্পও আছে। কানপুরের সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মতো হারায় ভারত।
রিচি বেনোর সেই দলের একাদশকে কে কত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমেছেন, গ্রিন পার্কের গ্যালারির দিকে আঙুল তুলে তা সহজেই বলে দিচ্ছিলেন সৌরভ, ‘আমার সঙ্গে একটা রেডিও ছিল। সেটা কানে রেখে ধারাভাষ্য শুনছিলাম। সঙ্গে খেলাও দেখছিলাম। আর পাশাপাশি স্কোরিং। ওই যে ওই গ্যালারিটা দেখছেন, সেটাই স্টুডেন্ট গ্যালারি। সেখানে বসে স্কোরিং করছিলাম।’
পরের বছরই কানপুরে এসেছিল ফজল মাহমুদের পাকিস্তান দল। হানিফ মোহাম্মদ, ইমতিয়াজ আহমেদ, সাঈদ আহমেদ, জাভেদ বুরকি…একে একে সেই দলের খেলোয়াড়দেরও নাম বলছিলেন সৌরভ। ড্র হওয়া সেই ম্যাচটার গল্পও বেশ আগ্রহ নিয়ে শোনালেন তিনি। কিশোর বয়সের সেই স্মৃতি যে এখনো তরতাজা সৌরভের মনে, ‘ওই সময়ের ম্যাচগুলো নিয়ে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে। সেটা এখনো আছে। তখন খেলার প্রতি ভালোবাসা একটু একটু করে গভীর হচ্ছিল। ওই সময়টা স্বাভাবিকভাবেই মধুর।’
স্টুডেন্ট গ্যালারির সেই সৌরভ ১৯৮১ সালের দিকে উত্তর প্রদেশ ক্রিকেটের অফিশিয়াল স্কোরারের দায়িত্ব পান। তবে শুধু কানপুরের ম্যাচ নয়, ভারত পৃথিবীর যে প্রান্তেই খেলুক না কেন, টিভি কিংবা রেডিওর সৌজন্যে স্কোরিং করতেন সৌরভ, ‘১৯৮১ সালের দিকে আমি অফিশিয়াল স্কোরার হই। কিন্তু ভারত যেখানেই ম্যাচ খেলে, আমি স্কোরিং করে রাখি। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানেই হোক; স্কোরিং করে যাই। আগে রেডিওতে শুনে স্কোরিং করতাম।’
নিজের কাজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে এই তথ্যও দিলেন, ‘১৯৯৭ সালে যোগ দিই বিসিসিআইয়ের প্যানেলে। আমি পুরো ইউপি থেকে একমাত্র বিসিসিআই স্কোরার ছিলাম। শুধু ইউপি নয়, আমি প্রথম ব্যক্তি, যিনি সেন্ট্রাল জোনের প্রথম স্কোরার ছিলাম।’ মধ্যে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন ইএসপিএন ক্রিকইনফোর কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। নিজের স্কোরিংয়ের ধরন নিয়ে নিজেই গর্ব করলেন সৌরভ, ‘কোন এন্ড থেকে বোলার বল করছে, সেই এন্ডে কোন আম্পায়ার দাঁড়ানো, ওই সময় কে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন…সব উল্লেখ থাকে। উইকেট পড়লে তখন কোন এন্ডে উইকেট পড়েছে, সে তথ্য থেকে শুরু করে সব লিখিত থাকত।’
এখন কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ না করলেও নিজের জন্য ঠিকই স্কোরিং করে যাচ্ছেন সৌরভ। ভারত যেখানেই খেলুক, বিশাল স্কোরের খাতা খুলে সংখ্যায় খেলা শুরু করবেন তিনি। ৭১ বছর বয়সে এসেও খেলার ইতিহাস টুকে রাখার নেশা ছাড়েননি সৌরভকে। এই নেশা নাকি আমৃত্যু ছাড়বে না, ‘ক্রিকেটের পোকা আছে না, পোকা একবার মাথায় ঢুকে গেলে আর ছাড়ে না। একবার ধরেছে তো মরার আগ পর্যন্ত চলবে (হাসি)।’
কথাটার সঙ্গে নিশ্চয়ই মিল খুঁজে পাবেন সৌরভের মতো ক্রিকেটকে ‘জীবন’ বানিয়ে ফেলা অনেকেই।