২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যে কারণে জিতেছে আফগানিস্তান, হেরেছে বাংলাদেশ

নজিবুল্লাহ জাদরানের দুর্দান্ত ইনিংসে হারের পর তাঁর সঙ্গেই মাঠ ছাড়েন মুশফিক ও তাসকিন। হারের কষ্ট দুজনের চোখেমুখে স্পষ্টছবি: এএফপি

শারজায় কাল ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে আফগানিস্তান অধিনায়ক মোহাম্মদ নবীর কথায় যতটুকু বোঝা গেল, মাঠের খেলার আগেই বুদ্ধির খেলাতেও মনে হয় হেরেছে বাংলাদেশ।

উইকেটের চরিত্র বুঝতে আগের দিন শারজায় গিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ ও টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট শ্রীধরন শ্রীরাম। তাঁরা কতটুকু বুঝেছেন কে জানে, তবে টস জিতে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত যে কাজে দেয়নি, তা নবীর কথাতেই পরিষ্কার, ‘এটা নতুন উইকেট, নতুন মাটি ফেলা হয়েছে। এই পিচে কেউ খেলেনি। তাই আগে বোলিং করে ভালো হয়েছে। বুঝতে পেরেছি, পিচ কেমন আচরণ করছে।’

সাকিব কেন ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা অবশ্য অনুমান করাই যায়। টি-টোয়েন্টির আফগানিস্তান সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা, রান তাড়া করার চেয়ে তারা ডিফেন্ড করায় বেশি পারঙ্গম। ভালো একটা স্কোর করে আফগানিস্তানের ‘দুর্বল’ জায়গাটাকে আরও চাপে ফেলার পরিকল্পনা ছিল তাঁর, যা সফল হলে আগে ব্যাটিং নেওয়ার পক্ষে হয়তো ইতিবাচক কথাও শোনা যেত।

আফগান স্পিনার মুজিবকে খেলতে সমস্যায় পড়েন ব্যাটসম্যানরা
ছবি: এএফপি

তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে আফগানিস্তানের চিন্তাভাবনা যে পরিষ্কার, সংবাদ সম্মেলনে নবীর কথায় সেটিও ভালোই বোঝা যায়। অচেনা উইকেটে দুই স্পিনার মুজিব উর রহমান ও রশিদ খান ব্যাটসম্যান বুঝে বল করেছেন। দুর্বল ফুটওয়ার্কের জন্য মুজিবের ‘ক্যারম বল’ আর রশিদের দ্রুতগতির ‘গুগলি’ সামলাতে সমস্যা হবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের, দুই স্পিনারের পাশাপাশি নবীও তা জানতেন। যে কারণে দুই প্রান্ত থেকে একসঙ্গে রশিদ-মুজিবকে দিয়ে বোলিং না করিয়ে আগে-পিছে করিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের ইনিংসে যতটা বেশি সময় সম্ভব বোলিংয়ে মুজিব ও রশিদকে রাখা গেছে। ফলও মিলেছে—৩টি করে উইকেট নিয়েছেন দুজনই। বাংলাদেশও ২০ ওভার খেলে ৭ উইকেটে মাত্র ১২৭ রানে থামতে বাধ্য হয়েছে।

হারের পর আরও ‘১৫-২০ রান করতে না পারা’র যে আক্ষেপ করেছেন সাকিব, ব্যাটিংয়ে পাওয়ার হিটিংয়ের বিষয়টি বাইরে রেখেই বলা যায়, বাংলাদেশ এই ১৫-২০ রানও পেত যদি আফগানিস্তানের ফিল্ডিং বাংলাদেশের মতো হতো। জানবাজি রাখা ফিল্ডিংয়ে অন্তত ১৫-২০ রান সেভ করেছে আফগানিস্তান। এমন কোনো ‘মহাকাশবিজ্ঞান’ নয়, টি-টোয়েন্টির মৌলিক বিষয়—ভালো জায়গায় বল ফেলা, ব্যাটসম্যান বুঝে বল করা এবং দুর্দান্ত ফিল্ডিং—এসব ঠিকঠাক করেই বাংলাদেশকে কম রানে আটকেছে আফগানিস্তান।

সবাই জানে, টি-টোয়েন্টিতে একটা-দুটো ভালো ওভার ম্যাচের গতিপথ পাল্টে দেয়, সেখানে রশিদ-মুজিবের সম্মিলিত ৮ ওভার থেকে রান এসেছে মাত্র ৩৮ (ওভারপ্রতি গড়ে ৪.৭৫), উইকেট ৬টি। বাকি চার বোলারের ১২ ওভার থেকে এসেছে ৮৬ রান—ওভারপ্রতি গড়ে ৭ রানের একটু বেশি। তাই এ কথা বলা যায় না, রশিদ-মুজিবকে দেখে খেলার ঘাটতিটুকু বাকি বোলারদের কাছ থেকে পুষিয়ে নিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। কারণ? আবারও সেই পরিকল্পনার প্রসঙ্গ এসে যায়।

রশিদ খানকেও ভালোভাবে সামাল দিতে পারেননি ব্যাটসম্যানরা
ছবি: এএফপি

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের চেনা কিছু ধারা আছে। ভালো শুরু পেলে তা পুঁজি করে শেষটা ভালো করার চেষ্টা থাকে। যদিও শেষ ৫ ওভারে খুব কম সময়ই দ্রুত রান তুলতে পেরেছে দল। আর ভালো শুরু না পেলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যতদূর যাওয়া যায়। কাল ঘটেছে পরেরটি। পাওয়ার প্লে-র ৬ ওভারের মধ্যে ২৮ রানে ৩ উইকেট পড়ে গেলে তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী না খেলে ‘আপন পরান বাঁচা’র পথে হেঁটেছেন ব্যাটসম্যানরা। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বর্তমান ধারা অনুযায়ী, এই কৌশল সেকেলে। এখন প্রায় সব দলই উইকেট পড়লেও টি-টোয়েন্টির মেজাজেই ব্যাটিং করে, অন্তত চেষ্টা করে। বাংলাদেশের ইনিংসে তাকালে কি তা দেখা যায়?

টপ অর্ডারে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের আউটগুলো ছিল কুৎসিত। মুজিবের আঙুলের টোকায় ‘ক্যারম বল’ কেউ পড়তে পারেননি। ফলাফল, পাওয়ার প্লে-তে আবারও ‘পাওয়ার’ ব্যবহারের ছিটেফোঁটাও নেই!

এই সংস্করণে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা সাধারণত, সিঙ্গেলস-ডাবলসের সঙ্গে প্রতি ওভারেই একটা-দুইটা বাউন্ডারি মারার চেষ্টা করেন, যেন ব্যাটিংয়ে রান তোলার ‘মিক্সিং’টা ভালো হয়, শুধু এক-দুই করে নিয়ে বাউন্ডারি মারার চাপ কিংবা শুধু বাউন্ডারি মারতে গিয়ে দ্রুত উইকেট হারানো এবং এক-দুই রান নষ্টের ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না।

টি–টোয়েন্টির মেজাজে ব্যাট করতে পারেনি টপ অর্ডার। পরের ব্যাটসম্যানদের ওপর চাপটা তাই বেড়েছে
ছবি: এএফপি

এবার দেখা যাক, বাংলাদেশের ইনিংসে বাউন্ডারি এসেছে কোন সময়—প্রথম ওভার (১টি চার), পঞ্চম ওভার (২টি চার), ১০তম ওভার (১টি চার), ১২তম ওভার (১টি ছক্কা), ১৫তম ওভার (১টি চার), ১৬তম ওভার (১টি চার), ১৭তম ওভার (১টি চার), ১৮তম ওভার (১টি চার), ১৯তম ওভার (১টি চার) ও ২০তম ওভার (১টি চার)। সব মিলিয়ে ইনিংসে ১০টি চার ও ১টি ছক্কা—যেখানে বাউন্ডারি থেকে এসেছে ৪৬ রান।

খেয়াল করলে দেখা যায়, পঞ্চম ওভারে সাকিব টানা দুই চার মেরে আউট হওয়ার পর ১০ম ওভারের আগপর্যন্ত কোনো বাউন্ডারি হয়নি, মাঝের এই চার ওভারের চিত্রটা এরকম—৬/১, ৩/১, ৪ এবং ৭। এতে ৯ ওভার শেষে গিয়ে স্কোর দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ৪২।

এমন খাদ থেকে বাংলাদেশের উঠে দাঁড়ানোর নজির অন্তত টি-টোয়েন্টিতে খুব কম, আর বিপর্যয়ের পর খুঁড়িয়ে ব্যাটিং যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন টি-টোয়েন্টির ভয়ডরহীন ব্যাটিং কারও মনে থাকার কথা নয়। ৩১ বলে ৪৮ করা মোসাদ্দেক হোসেনের কিছুটা মনে থাকায় তবু শেষ ৫ ওভারে ৪৭ এসেছে, নইলে রান আরও কম হতো এবং বোলারদের লড়াইয়ের সুযোগটাও থাকত না। সুযোগের কথাই যখন উঠল, তখন আরেকটি বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া যায়। সাকিব যে আরও ১৫-২০ রান করতে না পারার আক্ষেপ করেছেন, তার অর্থ, এই রানগুলো করতে পারলে বাংলাদেশের জয়ের সুযোগ থাকত।

সাকিব হয়তো ভুলে গেছেন, আফগানিস্তান ৯ বল হাতে রেখে জিতেছে। ধরা যাক, বাংলাদেশ আরও ২০ রান বেশি করল, তাতে স্কোর দাঁড়াত ১৪৭। আফগানিস্তান ১৮.৩ ওভারে ১৩১ রান তোলায় শেষ ৯ বলে জয়ের জন্য লাগত ১৭। উইকেটে তখন নজিবুল্লাহ জাদরান ও ইব্রাহিম জাদরান—প্রথমজন ৬ ছক্কা মেরে রীতিমতো সংহারকের ভূমিকায়, পরেরজন সহায়ক। এই পরিস্থিতিতে দুই জাদরান মিলে শেষ ৯ বলে ১৭ রান তুলতে পারতেন না—এই কথার পক্ষে সম্ভবত বাংলাদেশ ক্রিকেটের পাঁড় ভক্তও বাজি ধরবেন না!

বোলিংয়ে ভালো শুরু এনে দেন সাকিব
ছবি: এএফপি

তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? বাংলাদেশ ক্রিকেটে হাল আমলে খেলোয়াড়দের মুখ থেকে একটি ইংরেজি শব্দ প্রায়ই শোনা যায়—‘ইনটেন্ট’। বাংলা অর্থ ‘লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্য’ হলেও ক্রিকেটে, অন্তত টি-টোয়েন্টিতে এই অর্থের সঙ্গে একটু তীব্রতা এবং আত্মবিশ্বাস মেশানো থাকে। অর্থাৎ যা করতে চাই সে লক্ষ্যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়সংকল্প থাকা এবং বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটানো। ব্যাটিংয়ে এই বিষয় এতটাই অনুপস্থিত যে চাইলে সংবাদপত্রে ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ছাপানো যায়!

খেয়াল করে দেখুন, বাংলাদেশের ইনিংসে ১৫ থেকে ২০ ওভার পর্যন্ত প্রতি ওভারে মাত্র একটি করে চার এসেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্যান্য দলের ‘ডেথ ওভার’-এর ব্যাটিংয়ের সঙ্গে এমন ব্যাটিং কতটুকু মানানসই? এ প্রসঙ্গে প্রস্তর যুগ না হোক অন্তত মধ্যযুগের সঙ্গে আধুনিক যুগের তুলনাটা উঠতে পারে!

সেই তুলনায় আফগানিস্তানের ব্যাটিংয়ের প্রসঙ্গই টানা যায়। তার আগে বলে রাখা ভালো, সাকিবের অধিনায়কত্বে বোলারদের মধ্যে কিন্তু সেই ইংরেজি শব্দটার উপস্থিতি বোঝা গেছে, যে কারণে পাওয়ার প্লে-র ৬ ওভারে আফগানিস্তান ১ উইকেটে ২৯ তুলে চাপে, শেষ ১০ ওভারেও দরকার ছিল ৮০, আর শেষ ৫ ওভারে দরকার ৫২। ম্যাচের স্টিয়ারিং হাতবদল হয়েছে এই শেষ ৫ ওভারেই, তাতে মোস্তাফিজুর রহমান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের দুই ওভারে মোট ৩৯ রান দেওয়ার দোষটা তো পরিষ্কার বোঝাই যায়। কিন্তু এই যে ৩৯ রান উঠল, তার পেছনে কিন্তু অবদান আছে ওই ‘ইনটেন্ট’ কথাটার সঠিক প্রয়োগেরও। কীভাবে?

নজিবুল্লাহ জাদরানের বুদ্ধিদীপ্ত ইনিংসকে থামাতে পারেনি বাংলাদেশ
ছবি: টুইটার

ইনিংসের ১৫ ওভার পর্যন্ত আফগানিস্তানের ব্যাটসম্যানরা নিচে খেলেছেন, কোনো ছক্কা মারেননি। ৮টি চার এসেছে এ সময়। কিন্তু সিঙ্গেলস-ডাবলসের পাশাপাশি চার মারার ‘মিশ্রণ’ ঠিক রাখায় শেষ ৫ ওভারে লক্ষ্যটা আওতার মধ্যে ছিল। এর সঙ্গে যোগ করুন, হাতে উইকেট থাকার আত্মবিশ্বাস এবং নজিবুল্লাহ জাদরানের মতো ‘ক্লিন হিটার’। কতটা ‘ক্লিন’, তা বোঝাতে একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। বাংলাদেশ গোটা ইনিংসে বাউন্ডারি থেকে যেখানে ৪৬ রান তুলেছে, নজিবুল্লাহ জাদরান সেখানে নিজেদের ইনিংসে শেষ ৩ ওভার থেকেই বাউন্ডারিতে (চার-ছক্কা) তুলেছেন ৪০। আর পুরো ইনিংসে বাউন্ডারি থেকে এসেছে ৭৬।

এই ৭৬ রানের মধ্যে ৪৪-ই ১৬ থেকে ১৮.৩ ওভারের মধ্যে। বলা হচ্ছিল, ‘ইনটেন্ট’-এর কথা; মাথা পরিষ্কার রেখে নিজের আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে পরিকল্পনা অনুযায়ী রান তোলার উদাহরণ এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!

চাইলে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। বাংলাদেশের ইনিংসে ‘ডট’ বলের সংখ্যা ৪৪—অর্থাৎ, ২০ ওভারের মধ্যে ৭.২ ওভারই ডট। বাকি ১২.৪ ওভার থেকে রান উঠেছে ১২৭। আফগানিস্তান কিন্তু ‘ডট’ খেলেছে আরও বেশি—৪৯টি। অর্থাৎ ৮.১ ওভার।

কিন্তু সামর্থ্যে আস্থা রেখে লক্ষ্যটা স্থির ছিল আফগানদের। তাই এই জয়। আর এই জয়ের পেছনে যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তাঁর একটি কীর্তি না জানানো অপরাধের সমতুল্য। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে রান তাড়ায় ‘ডেথ ওভার’-এ এখন সর্বোচ্চ ছক্কা জাদরানের। ১৮টি ছক্কা মেরে তিনি পেছনে ফেলেছেন এউইন মরগান ও থিসারা পেরেরাকে। যদিও পরিসংখ্যানবিদেরা নির্দিষ্ট করে বলেননি, ডেথ ওভার বলতে ইনিংসের কোন ওভার থেকে শেষ পর্যন্ত বোঝানো হচ্ছে।

তবু এটা নিশ্চিত যে ডেথ ওভারে দ্রুত রান তোলা নিয়ে আফগানদের অন্তত ভাবতে হয় না। আর বাংলাদেশ?

নজিবুল্লাহ জাদরানের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ২০১২ সালে। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে ‘ইনটেন্ট’ খুঁজছে তারও আগে থেকে—এই যা পার্থক্য!