বিপিএলে এডিআরএস: বিতর্ক কমছে, নাকি বাড়ছে
এডিআরএস বা অলটারনেটিভ (বিকল্প) ডিসিশন রিভিউ পদ্ধতি বিপিএলে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় গত মৌসুমে। গতবার ঢাকা পর্বে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের পর চট্টগ্রাম পর্ব থেকে এটি চালু করেছিল বিসিবি। এবার প্রথম পর্ব থেকেই আছে এটি।
ডিআরএসের বদলে এডিআরএস থাকবে, এ মৌসুম শুরুর আগেই জানানো হয় সেটি। তবে মৌসুমে ৬ দিনে ১২টি ম্যাচের মধ্যেই একাধিক বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এই এডিআরএস। যে বিতর্ক সরাতে এডিআরএসের আশ্রয় নেওয়া, সেটিই বরং নতুন বিতর্ক জন্ম দিচ্ছে বলে এর কার্যকারীতা নিয়েও প্রশ্নটা বড়ই হচ্ছে।
গত মৌসুমে বিসিবি বলেছিল, বিপিএল আয়োজনে অনিশ্চয়তা, করোনাভাইরাসের কারণে পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান নেই—এসব কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ডিআরএস আনতে পারেনি তারা। এবার বিপিএল হচ্ছে, বিসিবি সেটি জানায় বেশ আগে থেকেই। তবে এবারও ডিআরএস আনতে ব্যর্থই হয়েছে বিসিবি। সেটি নিয়ে এ মৌসুম শুরুর আগে থেকেই বিসিবিকে বেশ বড়সড় সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সাকিব আল হাসান প্রকাশ্যেই বিসিবিকে ধুয়েও দেন বিপিএলের অব্যবস্থাপনা নিয়ে।
টাইটেল স্পনসর ঘোষণার দিন সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন চৌধুরী ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, কেন ডিআরএস রাখতে পারছেন না তাঁরা। পরে বিপিএল শুরুর প্রথম দিন দুই ম্যাচের মধ্যকার সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শেখ সোহেল ও সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক, ছিলেন নিজাম উদ্দিনও। ডিআরএস না–থাকা নিয়ে বিসিবির ভাষ্য, হক–আইয়ের যন্ত্রপাতি থাকলেও সেসব চালানোর মতো জনবল পাওয়া যায়নি বলেই এ অবস্থা। এর সঙ্গে আর্থিক কোনো সম্পর্ক নেই বলেও জানানো হয়।
তবে এডিআরএস বিতর্কের জন্ম দিয়েই যাচ্ছে। তৃতীয় ম্যাচে সৌম্য সরকারের এলবিডব্লুর সিদ্ধান্ত একাধিকবার বদলান টেলিভিশন আম্পায়ার, সপ্তম ম্যাচে এলবিডব্লু হওয়ার পর তো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই দেখান এনামুল হক। সর্বশেষ বিতর্কটি তৈরি হয় ১৪ জানুয়ারি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস ও ফরচুন বরিশালের ম্যাচে। বরিশালের অফ স্পিনার ইফতিখার আহমেদের রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে করা বলে এলবিডব্লু হন কুমিল্লার উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান জাকের আলী। অন ফিল্ড আম্পায়ার মোর্শেদ আলী খানের সিদ্ধান্ত রিভিউ করেন জাকের।
জাকেরের রিভিউয়ে দেখা যায়, ইফতিখারের বলের বেশির ভাগ অংশই পড়েছে লেগ স্টাম্পের বাইরের লাইনে। জাকের দারুণ রিভিউ করেছেন, তখন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছিল এমন। তবে টেলিভিশন আম্পায়ার তানভীর আহমেদ মাঠের আউটের সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন। স্বাভাবিকভাবেই টেলিভিশনে ডিআরএসের প্রচলিত প্রক্রিয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত দর্শক, সাংবাদিক, এমনকি ধারাভাষ্যকাররাও তানভীরের সে সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সাধারণত এখন ডিআরএসে টেলিভিশন আম্পায়ারের কথা শোনানো হয় ব্রডকাস্টিংয়ে, মানে কোন পদ্ধতিতে, কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, জানতে পারেন দর্শকেরা। তবে এডিআরএসে সেটি তো দূরের কথা, পিচিং, ইমপ্যাক্ট, হিটিংয়ের মানদণ্ডগুলোও আলাদা করে দেখানো হয় না। এর ফলে এডিআরএসের এ প্রক্রিয়ার সময়টিতে একরকম ধোঁয়াশার মধ্যেই থাকতে হয়। তানভীরের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে যখন অন ফিল্ড আম্পায়ার আউট বহাল রাখেন, ধোঁয়াশা বাড়ে আরও।
পরে রাতে বিসিবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিপিএলের প্লেয়িং কন্ডিশন অনুযায়ী টেলিভিশন আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই ঠিক। এবার এডিআরএস থাকবে, এমন সিদ্ধান্তের কথা জানালেও বিপিএলের প্লেয়িং কন্ডিশন বা এডিআরএসের নিয়ম আলাদা করে প্রকাশ করেনি বিসিবি। তবে গতবার দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছিল এ নিয়মের বিস্তারিত।
আইসিসি স্বীকৃত ডিআরএসের মূল দুটি প্রযুক্তি—হক–আই, স্নিকোমিটার বা আলট্রা এজের কোনোটিই নেই ‘এডিআরএস’-এ। টেলিভিশন আম্পায়ারের মূল ভরসা তাই ‘সুপার স্লো মোশন’ রিপ্লে। ডিআরএসে এলবিডব্লুর সিদ্ধান্তের বল ট্র্যাকিং পদ্ধতির পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর ও স্বয়ংক্রিয় হলেও বিপিএলে যেটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে খোলা চোখে দেখে মূল সিদ্ধান্তটা দেন টেলিভিশন আম্পায়ারই।
বল পিচের কোথায় পড়েছে, সেটি দেখতে ব্যবহার করা হয় ‘এমএটি’ বা ‘শেডেড এরিয়া অব উইকেট টু উইকেট’। মানে অফ স্টাম্প থেকে লেগ স্টাম্প পর্যন্ত অঞ্চলটিকে আলাদা করে দেখা হবে, বলটি স্টাম্প লাইনে পড়েছে কি না। ডিআরএসে পিচিংয়ে বলের বেশির ভাগ বা অন্তত ৫১ শতাংশ হিসাব করা হলেও এখানে দেখা হয় যেকোনো অংশ। অর্থাৎ অফ স্টাম্প থেকে লেগ স্টাম্পের ওই অঞ্চলের ভেতরে বলের কোনো অংশ পড়লেই সেটি লাইনে পড়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
ডিআরএসের বল ট্র্যাকিং নেই বলে ৫১ শতাংশের পদ্ধতি এখানে অনুসরণ করা সম্ভবও নয়। এর ফলে বল পিচে পড়ার সময় একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে একটা কাল্পনিক লাইন টেনে ওই নির্দিষ্ট জোনে বল স্পর্শ করেছে বলে মনে করলেই টেলিভিশন আম্পায়ারকে সেটি ইন লাইন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জাকেরকে আউটের সিদ্ধান্তও এসেছে এভাবেই। তবে খোলা চোখেই যখন বোঝা যাচ্ছে, বলের বেশির ভাগ অংশ লেগ স্টাম্প লাইনের বাইরে, তবুও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাটসম্যানের আউট হওয়াটা একরকম অন্যায্য বলাই যায়।
পিচিংয়ের মতো বিতর্কের সুযোগ আছে ‘ইমপ্যাক্ট’ বা বল ব্যাটসম্যানের প্যাডে প্রথমবার লাগার সময় সেটি স্টাম্পের লাইনে আছে কি না, সে ক্ষেত্রেও। এটিও বোঝার জন্য ব্যবহার করা হয় আগের মতোই ‘এমএটি’। আগের মতোই বলের কোনো অংশ এই নির্দিষ্ট অঞ্চলে থাকলেই সেটিকে ‘ইন লাইন’ বিবেচনা করা হয়।
এখন এলবিডব্লুর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বড় আরেকটি যে ব্যাপার—বলটি স্টাম্পে লাগত কি না, সে সিদ্ধান্ত রিভিউয়ের ক্ষেত্রে মূলত দেবেন টিভি আম্পায়ার। যেটি আইসিসি স্বীকৃত ডিআরএস পদ্ধতিতে হক-আই করে থাকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই। বলটি স্টাম্পে লাগত কি না, তাতে আগের অনেক ডেটাও ব্যবহার করা হয়। তবে বিপিএলের এই এডিআরএসে ‘ট্রান্সপারেন্ট ভিউ’ বা ‘বলের অবস্থানের একটা স্বচ্ছ চিত্র’, ‘স্প্লিট স্ক্রিন’ বা টিভি স্ক্রিনকে একাধিক ভাগে ভাগ করে, সুপার স্লো মোশন রিপ্লের সহায়তায় টিভি আম্পায়ার সিদ্ধান্ত নেবেন—বলটি স্টাম্পে আঘাত করত কি না।
শেষ পর্যন্ত তাই ব্যাপারটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে—অন ফিল্ড আম্পায়ার একটি সিদ্ধান্ত দেবেন, টেলিভিশন আম্পায়ারকেও দিতে হবে নতুন একটি সিদ্ধান্ত। অথচ ব্যাপারটি হওয়ার কথা ছিল এমন, অন ফিল্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই প্রযুক্তির সহায়তায় নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডে টেলিভিশন আম্পায়ার সেটি পুনর্বিবেচনা করবেন। পর্যাপ্ত উপাত্ত থাকলে বদলাবেন মাঠের সিদ্ধান্ত।
ডিআরএসে আম্পায়ার্স কলের নিয়মের কারণে আইসিসিকে প্রায়ই বিতর্কের মুখে পড়তে হয়। তবে অন ফিল্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থা, প্রযুক্তির শতভাগ অ্যাকুরেট না হওয়া—এমন কারণে আইসিসি আম্পায়ার্স কল থেকে সরে আসেনি, যদিও আম্পায়ার্স কলের মানদণ্ডে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এডিআরএসে অন ফিল্ড আম্পায়ারের সঙ্গে টেলিভিশন আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত—বিতর্কের মুখে পড়তে পারে দুটিই।
সীমাবদ্ধতা আছে কট বিহাইন্ড বা ইনসাইড এজের ক্ষেত্রেও। বল ব্যাট বা গ্লাভসে লেগেছে কি না, সেটি বোঝার জন্য যে শব্দনির্ভর প্রযুক্তি, তার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে শুধুই স্টাম্প মাইক্রোফোনের আওয়াজ। ভিডিওর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সে আওয়াজ ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা টিভি আম্পায়ারের। তবে ব্যাটের সঙ্গে প্যাড বা মাটিতে ব্যাটসম্যানের স্পাইকের আওয়াজে আলট্রা এজই সব সময় ‘কনক্লুসিভ’ বা পর্যাপ্ত হয় না, সেখানে একটা রিভিউ পদ্ধতিতে শুধু স্টাম্প মাইক্রোফোনের আওয়াজ ঢাল-তলোয়ার ছাড়া যুদ্ধে যাওয়ার মতোই। বল গতি পরিবর্তন করেছে কি না, খোলা চোখে সেটি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া আম্পায়ারের ওপর বাড়তি চাপই তৈরি করতে পারে।
সম্প্রতি বিসিবির অনানুষ্ঠানিক এক বোর্ড সভায় নাকি টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোতে মাঠের শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আম্পায়ার-ম্যাচ রেফারিদের আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অথচ এডিআরএস চাপ বাড়াচ্ছে সেই আম্পায়ারদের ওপরই।
তবে বিসিবি অবশ্য এডিআরএস নিয়ে সমালোচনা সেভাবে সহ্য করতে পারছে না। জাকেরের ওই ঘটনার পর সংবাদ সম্মেলনে এ পদ্ধতির আরেক দফা সমালোচনা করেন কুমিল্লা কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। বিসিবি পরে তাঁকে শাস্তির ঘোষণাও দেয়।
ডিআরএস বা ডিসিশন রিভিউ সিস্টেমের উৎপত্তি মূলত প্রযুক্তির সহায়তায় অন ফিল্ড আম্পায়ারদের ‘হাওলার’ বা ‘বড়সড় ভুল’ সরানো। তবে এখন আম্পায়ারিংয়ের মান যেমন বেড়েছে, ডিআরএসের প্রভাবও বেড়েছে খেলায়। প্রযুক্তি নিশ্চিতভাবেই আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে আম্পায়ারদের। অথচ বিপিএলে বাংলাদেশের ঘরোয়া আম্পায়াররা এ প্রযুক্তির সঙ্গে যেমন অভ্যস্ত হতে পারছেন না, তেমনি পড়তে হচ্ছে বিতর্কের মুখেও। বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিংয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন বরাবরই ওঠে, এডিআরএস তৈরি করছে নতুন চাপের ক্ষেত্র।
হ্যাঁ, পূর্ণাঙ্গ ডিআরএস যে নতুন বিতর্ক তৈরি করেনি, তা নয়। কখনো হক-আই নিজেই ভুল স্বীকার করেছে, কখনো টেলিভিশন আম্পায়ার তাঁর ‘জাজমেন্ট’-এ ভুল করেছেন। তবে দিনের শেষে রিভিউ সিস্টেম বদলে দিয়েছে অনেক কিছুই। আগে স্পিনারদের বলে ব্যাটসম্যানরা ফ্রন্ট ফুটে খেললে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এলবিডব্লু দিতেন না আম্পায়াররা, যেটি বদলে গেছে এখন। একবার ড্যানিয়েল ভেট্টোরি বলেছিলেন, ডিআরএসের আগে টেলএন্ডারদের ‘সহজেই’ এলবিডব্লু দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল আম্পায়ারদের, ডিআরএসে বদলে গেছে তা-ও।
ক্রিস রজার্সকে তো বদলে ফেলতে হয়েছিল নিজের গার্ডও। সাবেক বাঁহাতি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান কোনো ডানহাতি বোলার রাউন্ড দ্য উইকেটে বল করতে এলে অফ স্টাম্পের দিকে সরে গার্ড নিতেন। কিন্তু একবার খুব সূক্ষ্মভাবে আউট হয়ে গেলেন, বলটা শুধু লেগ স্টাম্প ছুঁয়ে গিয়েছিল। রজার্স এরপর গার্ড বদলে লেগ স্টাম্পের দিকে গার্ড নেওয়া শুরু করেছিলেন, টেকনিকে গড়বড় হয়ে গিয়েছিল তাতেই।
ডিআরএস থাকলে ইফতিখারের বলে সেদিন জাকেরের আউট হওয়ার কথা ছিল না। তবে বিসিবির এডিআরএস পদ্ধতির বলি হয়ে গেছেন তিনি। লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়া বলে এলবিডব্লু হবেন না, স্বাভাবিকভাবেই ব্যাটসম্যানের টেকনিকে প্রভাব থাকে সেটির। বিতর্কের কথা বাদ দিন, এখন অমন সিদ্ধান্তের পর জাকেরের মতো কারও টেকনিকে যদি পরিবর্তন আনতে হয়, সেটির প্রভাব যদি তাঁর ক্যারিয়ারে একটু হলেও থাকে, বিসিবি কি সেটির দায় নেবে?