‘যুক্তির গালে চড় মেরে’ সুবাস ছড়াচ্ছে পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের ক্রিকেট
তিন বছর আগে ফিরে তাকানো যাক। আরও স্পষ্ট করে বললে ১৮ ডিসেম্বর ২০২০—আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেদিন প্রথম ওপেন করেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। কারণটা কি মনে আছে?
অধিনায়ক বাবর আজমের চোট। সেই থেকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে রিজওয়ানের নতুন শুরু। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচের আগে খেলা ১৫ টি-টোয়েন্টি ইনিংসে ফিফটি না পাওয়া রিজওয়ান পরের ৫৮ ইনিংসে ফিফটি করেন ২৫টি, সেঞ্চুরি ১টি। অধিনায়ক বাবরের সঙ্গেও রিজওয়ানের জুটি বেশ জমে উঠেছিল। টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রান এসেছে এই জুটি থেকে। সবচেয়ে বেশি শতরানের জুটির রেকর্ডও তাঁদের।
কী মনে হয়? এত এত সাফল্যে গত কয়েক বছর পাকিস্তান ক্রিকেটে তাঁদের পথটা মসৃণ ছিল? এমন ভাবলে ভুল হবে। নির্মম সত্য হলো, এ সময়ে পাকিস্তান ক্রিকেটে যে দুজনকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে, তাঁরাও বাবর ও রিজওয়ান।
পাকিস্তানের এমন কোনো সাবেক ক্রিকেটার হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যাঁরা বাবর-রিজওয়ানের সমালোচনা করেননি! বেশির ভাগের মতে, টি-টোয়েন্টিতে বাবর আর রিজওয়ান একটু বেমানান। অন্যদের তুলনায় তাঁদের স্ট্রাইক রেট বেশ কম। সমালোচনা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে বাবর-রিজওয়ানকে ছাড়া আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হারের পর সেই সিরিজের অধিনায়ক শাদাব খান বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘বাবর-রিজওয়ানকে এখন শ্রদ্ধা করবে মানুষ।’
কিন্তু এত সমালোচনার পরও কেন ওপেনিং জুটি বদলায়নি পাকিস্তান? উত্তরটা সহজ, বাবরের পাকিস্তান এভাবেই সফল। অতিরিক্ত মারমুখী ক্রিকেটে মন না দিয়ে প্রথাগত ক্রিকেট কৌশলেই ভরসা রেখেছেন বাবর–রিজওয়ানরা। প্রথম ১০ ওভারে বাবর-রিজওয়ান মঞ্চ তৈরি করবেন, এরপর বাকিরা সেই মঞ্চে ঝড় তুলবেন। এই কৌশলে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছে তারা। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছে সেমিফাইনাল। বাবরদের যুক্তিটা ছিল এমন—দল সফল হলে কৌশল গৌণ।
টি-টোয়েন্টি ছেড়ে ওয়ানডেতে আসুন। সংস্করণ বদলালেও পাকিস্তানের খেলার ধরন বদলায়নি। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডের হাত ধরে ওয়ানডে ক্রিকেটে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, সেই হাওয়া পাকিস্তান দলকে খুব একটা নড়াতে পারেনি। বাইরে থেকে অনেকেই, মানে সমালোচকেরা সে হাওয়া দলে ঢোকাতে চাইলেও পাকিস্তান দল সমাদরে সেটা গ্রহণ করেনি। এই কারণে অনেকেই বলেন, পাকিস্তান এখনো নব্বই দশকের ক্রিকেট খেলে। মানে, ঝুঁকিমুক্তভাবে ইনিংস বড় করে শেষ দিকে দ্রুতগতিতে রান তোলার চেষ্টা করা। ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মতো শুরু থেকেই দাপট দেখানোর চেষ্টা করে না।
একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। চলতি বছরে প্রথম ১০ ওভারে এখন পর্যন্ত একটা ছক্বাও মারেনি পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানেরা। বল খেলেছে ১০০০ এর বেশি।
এ ধরনের ব্যাটিং শুধু মাঝারি মানের সংগ্রহের ক্ষেত্রেই কার্যকরী—এমন সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান নিন্দুকদের চোখে চোখ রেখেই এমন সব কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করে যাচ্ছে এবং সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে গতকাল শ্রীলঙ্কার ৩৪৪ তাড়া করে ৬ উইকেটে তুলে নেওয়া জয়। ওহ, আরও ১০ বল বাকি ছিল!
পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্লেষক মাজহার আরশাদ তাই কথাটা মন্দ বলেননি, ‘পাকিস্তান ক্রিকেট হলো যুক্তির গালে একটা চড় ।’
সাড়ে তিন শর কাছাকাছি রান তাড়ায় নেমেও পাকিস্তান শুরু থেকে তাড়াহুড়া করেনি। প্রথম ১০ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে তুলেছে ৪৮। দুই সেঞ্চুরিয়ান রিজওয়ান ও আবদুল্লাহ শফিকের কেউ অযথা ঝুঁকি নেননি। বাজে বলের অপেক্ষা করে ‘স্ট্রাইক রোটেট’ করে খেলেছেন। অর্থাৎ, এক–দুইয়ের ওপর খেলেছেন।
পাকিস্তানের ১০০ রান এসেছে ১৮.৫ ওভারে। আর ১৫০ রান এসেছে ২৭ ওভারে। যথার্থ মঞ্চ তৈরির পর দ্রুত রান তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। ২৭ ওভারে ১৫০ রান করা পাকিস্তান ২০০ রানে পৌঁছায় ৩১.৩ ওভারে।
ব্যক্তিগত ইনিংসে তাকালেও এমন কৌশলই চোখে পড়বে। দুজনেই ফিফটি করেন ৫৮ বলে আর সেঞ্চুরি ৯৭ বলে! শেষ দিকে ইফতিখার আহমেদ নেমে করেন ১০ বলে ২২ রান। প্রথাগত ব্যাটিং করেই হায়দরাবাদে ৩৪৫ রানের লক্ষ্য পাকিস্তান পেরিয়ে যায় ১০ বল হাতে রেখে—যেটি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডও।
বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের ক্রিকেট পরিচালক মিকি আর্থার অবশ্য এমন কিছুরই আভাস দিয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া তাদের ক্রিকেটটা খেলুক, পাকিস্তানও খেলবে নিজেদের মেজাজেই, ‘ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া একটা ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলে, তবে আমরা আমাদের কৌশলেই খেলব। সন্দেহ নেই, তাদের এমন কৌশলে খেলার যথেষ্ট সামর্থ্য আছে। তবে আমরা এমন এক ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলব, যেটাকে আমরা বলি “পাকিস্তানস ওয়ে”। আমরা যে ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলি, সেটা আমাদের সঙ্গে মানানসই, আমাদের দলীয় চিন্তাভাবনার সঙ্গে খাপ খায়। এই ব্র্যান্ডের ক্রিকেটই আমরা খেলব, আশা করছি এভাবে খেলেই বিশ্বকাপ জিতব।’
পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতুক বা না জিতুক, বাবররা যে ‘পাকিস্তানি ব্র্যান্ড অব ক্রিকেট’টাই খেলবেন, তাতে সন্দেহ নেই। তবু সমালোচনা হবে। নিন্দুকদের মুখ তো আর আটকে রাখা যাবে না। কিন্তু দল জিতলে বাবররাও বলতে পারেন, কৌশল নিয়ে নিন্দায় কীই–বা আসে–যায়!