বিশ্বকাপ শেষ হতে আরও আট দিন। তবে আজকের পর থেকে বাংলাদেশ তো শুধুই দর্শক। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাচ্ছে আজই। বিতর্কের বিশ্বকাপ, হতাশার বিশ্বকাপ, দীর্ঘশ্বাসের বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন নিয়ে খেলতে এসে যেটিতে এখন প্রথম আটে থাকার আকুতি।
শুধু এই বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ বলেই নয়, আরেকটা কারণেও আজকের দিনটাকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে বড় এক উপলক্ষ বলে ধরতে পারেন। প্রতিপক্ষের নাম যে অস্ট্রেলিয়া।
আইসিসি টুর্নামেন্ট ছাড়া যাদের দেখাই পায় না বাংলাদেশ। সেই ২০১১ সালে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ। এরপর ১২ বছরে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দেখা হয়েছে মাত্র দুবার। একবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে, আরেকবার বিশ্বকাপে। সংখ্যাটা এক বাড়তে পারত। বাড়েনি, কারণ ২০১৫ বিশ্বকাপে ব্রিসবেনের ম্যাচটাতে এক বলও হতে দেয়নি বৃষ্টি।
অস্ট্রেলিয়া সব সময়ই অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপে তো আরও বেশি। সবচেয়ে বেশি পাঁচবারের চ্যাম্পিয়নরা শুরুর হোঁচট সামলে এবারও জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে স্বমহিমায়। সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গেছে, প্রতিপক্ষও। তাহলে এই ম্যাচ থেকে অস্ট্রেলিয়ার আর কী চাওয়ার আছে, কী পাওয়ার?
ড্যানিয়েল ভেট্টোরির কথাটা হয়তো রসিকতা করেই বলা। ইডেন গার্ডেনের হোম ড্রেসিংরুমটা বেশি সুন্দর। রাউন্ড রবিন লিগ শেষে দ্বিতীয় হয়ে সেমিফাইনালে সেই ড্রেসিংরুমে থাকতে চায় অস্ট্রেলিয়া। হয়তো কেন, আসলেই রসিকতা। অস্ট্রেলিয়ার জিততে চাওয়ার কোনো কারণ লাগে নাকি! সব সময়ই তো তারা জিততে চায়। জিগীষা অস্ট্রেলিয়ানদের রক্তে।
সংবাদ সম্মেলনে ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে দেখে একটু কেমন কেমন লাগছিল। একটু আগে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে সংবাদ সম্মেলন করে গেছেন। এখন ভেট্টোরি। দুজনেরই তো একটা ‘কমন’ পরিচয় আছে। যে পরিচয়ে বাংলাদেশ আছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভেট্টোরির দীর্ঘ ইতিহাস। সেটিও শুধু এক ভূমিকায় নয়। খেলোয়াড় হিসেবে, নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশ তাঁর কাছে অনেক অম্লমধুর অভিজ্ঞতার নাম। নিউজিল্যান্ডকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন, আবার ‘বাংলাওয়াশ’-এর মতো হতাশাও তাঁকে এই বাংলাদেশেরই উপহার। পরে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কাজ করেছেন স্পিন কোচ হিসেবেও। এই ম্যাচের আগে অস্ট্রেলিয়া দলের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া কি এ কারণেই?
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচ তো অনেকটা হ্যালির ধূমকেতুর মতো। অনেক বছর পর পর একবার দেখা দেয়। অস্ট্রেলিয়া দলের অন্য যে কারও চেয়ে তাই বাংলাদেশ দল সম্পর্কে বেশি জানেন তাদের এখনকার স্পিন বোলিং কোচ। যে কারণে বুঝতে পারেন, সাকিব আল হাসান না থাকাটা বাংলাদেশের জন্য কত বড় ক্ষতি। এটা বুঝতে অবশ্য ভেট্টোরি হতে হয় না। কে না তা জানে!
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভেট্টোরির জানাশোনাটা ভালোমতো বোঝা গেল, যখন তিনি বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণ নিয়ে বলতে শুরু করলেন। মেহেদী হাসান মিরাজকে খুব পছন্দ করেন। পছন্দ করেন অন্য মেহেদীকেও। যাঁকে চেনাতে নাম দিয়ে দিলেন ‘লিটল মেহেদী’। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই দুই অফ স্পিনারই আজ খেলবেন বলে তাঁর বিশ্বাস। এতটা নিশ্চিত থাকার কারণ, বিরান ভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা পুনের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ম্যাচটা শুরু হবে স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায়।
ধর্মশালায় আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের বিশ্বকাপের শুরুটাও দিনের ম্যাচ দিয়ে। শেষটাও তা-ই। হাথুরুসিংহে কি একটু অনুযোগের সুরেই বললেন, ‘এই বিশ্বকাপে আমরাই বোধ হয় একমাত্র দল, যারা তিনটি ডে-ম্যাচ খেলছে।’ পার্থক্য কী? সবচেয়ে বড় পার্থক্য দিবারাত্রির ম্যাচগুলোয় শিশিরের প্রভাব। দিনের ম্যাচে সেই বালাই নেই বলে স্পিনারদের এখানে বড় ভূমিকা থাকার কথা। পড়তে পড়তে অ্যাডাম জাম্পার মুখটা হয়তো আপনার চোখে ভেসে উঠেছে। যেকোনো দলের জন্যই বড় এক চ্যালেঞ্জ। লেগ স্পিন সংস্কৃতিহীন বাংলাদেশের জন্য তো আরও বেশি। শুধু জাম্পাই বা কেন; অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের নামগুলো একবার দেখুন না! বাংলাদেশের জন্য কে চ্যালেঞ্জ নয়।
সেই চ্যালেঞ্জ আরও বড় হয়ে যাচ্ছে একের মধ্যে দুই সাকিব আল হাসান না থাকায়। অধিনায়কত্ব যোগ করলে আসলে তো একের মধ্যে তিন। সাকিব না থাকা প্রসঙ্গে দারুণ একটা কথা বললেন হাথুরুসিংহে। সাকিব বাংলাদেশ দলের অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছে। সেটি কীভাবে? সাকিব না থাকলেই বোঝা যায় একাদশ নির্বাচনের কাজটা কত কঠিন। সাকিব থাকা মানেই যে একই সঙ্গে একজন ব্যাটসম্যান ও একজন বোলার। বোলার সাকিবের অভাব যা-ও পূরণ করা যায় বলে মনে করেন, ব্যাটসম্যান সাকিবকে বড় মিস করছেন হাথুরু। সঙ্গে তাঁর নেতৃত্বকেও।
না থেকেও অবশ্য সাকিব ঘুরেফিরে আসছেন আলোচনায়। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে ওই ‘টাইমড আউট’ করে দেওয়া নিয়ে বিতর্ক এখনো থামেনি। তা সহজে থামবেও না। হাথুরুসিংহের সংবাদ সম্মেলনেও সেই প্রসঙ্গটা আবার উঠল। এত দিন এর পক্ষে-বিপক্ষে কথা হয়েছে, সম্ভবত হাথুরুসিংহেই প্রথম ভবিষ্যতে এই বিতর্ক এড়ানোর একটা উপায় বাতলে দিলেন। টাইমড আউট বলে একটা আউট যেহেতু আইনে আছেই, সেই আউট দেওয়া না-দেওয়ার সিদ্ধান্তটা আম্পায়াররাই নিন না কেন! ফিল্ডিং দলের এতে আপিল না করতে হলেই তো হয়।
সাকিব না থেকেও আছেন। আর গ্লেন ম্যাক্সওয়েল থেকেও আজ থাকবেন কি না, নিয়মরক্ষার এই ম্যাচ ঘিরে সবচেয়ে বড় কৌতূহল মনে হয় এটাই।