এত চেষ্টার পরও ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল না হওয়ার ‘দায়’ কার
কী, হিংসা হচ্ছে? সব হিসাব–নিকাশ তো ভুল প্রমাণিত হলো! কৌশল করে বানানো সূচিটাও মাঠে মারা গেল। কত অঙ্ক কষে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এশিয়া কাপের সূচি বানানো হলো, যেন ফাইনালের আগেই ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ কয়েকবার দেখা যায়। ফাইনালেও এই দুই প্রতিবেশীকে প্রত্যাশা করে তাঁদের উঠে আসার পথে দু–একটা ‘কাঁটা’ও সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কথায় আছে, মানুষ প্রত্যাশা করে এক, হয় আরেক। অনেকটাই শিক্ষাজীবনে পরীক্ষার মতো। দেখা যায়, যে সিলেবাস ঠোঁটস্থ করে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, সেটার ‘অর্ধেক’ এসেছে, বাকিটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত—শ্রীলঙ্কা টাইপের প্রশ্ন!
ভেঙে বলা যাক। ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ ক্রিকেটের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত লড়াইগুলোর একটি। সেটি শুধু রাজনৈতিক বৈরী সম্পর্কের আঁচে জমজমাট লড়াইয়ের জন্য নয়, টাকাপয়সাও আয় হয় এন্তার। অন্য যেকোনো ম্যাচের তুলনায় এই দ্বৈরথ থেকে বাণিজ্যিকভাবে বেশি লাভবান হন আয়োজকেরা। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই এশিয়া কাপ হবে আর সেখানে ভারত–পাকিস্তান অংশ নেবে, কিন্তু তাদের যতটা বেশি সম্ভব মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে না, তা হয় না। শুধু ক্রিকেটীয় চেতনায় তো আর পেট ভরবে না, টাকাপয়সার ব্যাপারও তো দেখতে হবে, নাকি! তাই শুধু এবার নয়, এশিয়া কাপে প্রায় প্রতিবারই এমন হয়েছে, সামনেও হবে আলবত।
কমিকের চাচা চৌধুরীর মতো—যাঁর মস্তিষ্ক কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর—বুদ্ধিমান আয়োজকেরা এবার এশিয়া কাপে ভারত–পাকিস্তানকে এক গ্রুপে রেখেছিলেন। দুই দলই যেন পরের পর্বে উঠতে পারে—ছিল সেই বন্দোবস্তও। গ্রুপ পর্বের খাদ থেকে দুই দলের পরের পর্বে ওঠার ‘পাটাতন’ হিসেবে রাখা হয়েছিল নেপালকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনো ‘দুই দিনের বৈরাগী’ হয়ে থাকা নেপালকে বেশ মজা করে হারিয়েই প্রত্যাশামতো সুপার ফোরে উঠে এসেছিল ভারত ও পাকিস্তান। আর এই পর্বে কোনো কৌশল নয়, সূচির দাবি মেটাতেই অবধারিত ছিল একটি ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ।
কিন্তু বুদ্ধিমানেরা অতীত থেকে শিক্ষা নেন। গ্রুপ পর্বে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচ বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার লোকসান তো তাঁরা ভোলেননি। সুপার ফোরেও তেমন কিছু হলে পয়েন্ট আর নেট রান রেটের হিসাবে ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল দেখার স্বপ্ন ভেঙে যেতে পারে! আয়োজকদের তাই ফাঁদতে হয় নতুন কৌশল। ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে উড়িয়ে আনা হয় রিজার্ভ ডে। এ নিয়ে তখন অনেকেই ‘হা রে রে রে’ করে আওয়াজ তুলে বলেছিলেন, এর মাধ্যমে বাকি দলগুলোর সঙ্গে অন্যায় করা হলো। এই ‘বোকা’দের দলে ছিলেন শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রিকেটার চারিত সেনানায়েকে। এবার এশিয়া কাপের ড্র দেখে তাঁর মনে হয়েছে ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল নিশ্চিত করতে এই সূচি যোগসাজশ করে বানানো! ভেঙ্কটেশ প্রসাদ সোজাসাপ্টা বলেছিলেন, এটা লজ্জাহীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বাকিদের সঙ্গে অন্যায়।
আসলে আবেগের বশে তো কত কিছুই বলা হয়! কিন্তু চাইলেই কি আয়োজকদের মতো গভীর সাম্যবাদী হওয়া যায়? যে বা যাঁরা পেটে দেয়, তাঁদের অবহেলা কিংবা কিলও সহ্য করা যায়! এই যে ভারত, এই যে পাকিস্তান—এসব দল যত বেশি মুখোমুখি হবে, আয় তত বেশি, তার মানে টাকার ভাগও তত বেশি। কিংবা এভাবেও ভাবতে পারেন, সেই যে ছোটবেলার ক্রিকেট খেলার মতো। ব্যাট যাঁর, সে–ই খেলার কর্তা, আর কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম। এশিয়া কাপের সুপার ফোরে ওঠা চার দলের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, গুণে, মানে ভারত–পাকিস্তানের চেয়ে কে এগিয়ে! চেতনা শিকেয় তুলে আয়োজকদের মতো ক্রিকেটের কোষাগারে তাকিয়ে একটু ভেবে বলুন তো, এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলার দাবিদার কারা? এখন নিশ্চয়ই আর অমত করতে পারবেন না!
বরং বলতে পারেন, আয়োজকদের যোগসাজশ করে সূচি বানানোর জন্য এক পশলা করতালি দেওয়াই যায়। আসল সাম্যবাদী তো তারাই!
শুধু সাম্যবাদী কেন, সাহসীও। এশিয়া কাপের ধারাকে এবার উল্টে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা ছিল তাদের। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই টুর্নামেন্টে এর আগে ১৫টি সংস্করণে কখনো ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল দেখা যায়নি। এবার যেন তা হয়—সে লক্ষ্যে সূচিটা বানানো হয়েছিল ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’–এর দক্ষতায়। ফাইনালসহ ৩টি ম্যাচ হবে ভারত–পাকিস্তান—এই প্যাঁচ কষেছিলেন আয়োজকেরা। তবে অধিক উত্তেজনায় এশিয়া কাপের গতি–প্রকৃতি সম্ভবত তারা ভুলে গিয়েছিল। এটা জানা থাকলে ভারত–পাকিস্তান ফাইনালের জন্য সম্ভবত তারা ‘অন্য ব্যবস্থা’ নিতেন। সেটা কী ব্যবস্থা—এবারের ভুল শুধরে নিয়ে আয়োজকেরা নিশ্চয়ই দেখিয়ে দেবে আগামী আসরে।
সে পর্যন্ত একটি তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো, এশিয়া কাপে এবারসহ মোট ১২ বার ফাইনালে উঠল শ্রীলঙ্কা। এর আগে অনুষ্ঠিত ১৫টি সংস্করণের মধ্যে যে দল ১১ বারই ফাইনাল খেলেছে, সে দলকে এবার সূচি বানানোর সময়ই মনে মনে হিসাবের বাইরে রাখাটা আয়োজকদের অসম সাহসিকতার পরিচয়ই বটে! আরেকটু সাহস দেখিয়ে এর পক্ষে তারা পাল্টা যুক্তিও দিতে পারে, এবার এশিয়া কাপের সুপার ফোরে ওঠা দলগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কাই সম্ভবত সবচেয়ে দুর্বল। দয়া করে ‘জাত গেল, জাত গেল’ বলে তেড়ে আসবেন না! বাংলাদেশকে এই হিসাবে রেখেই কথাটা বলা।
ভেবে বলুন তো, এশিয়া কাপ শুরুর আগে সবচেয়ে বেশি চোটজর্জর ছিল কোন দল? ভারী নাম নেই, তারকার বাহার নেই—এমন কোনো দল যদি এবার এশিয়া কাপে থেকে থাকে, সেটাও শ্রীলঙ্কাই। বাংলাদেশও এশিয়া কাপ শুরুর আগে বড় বুলি ছেড়েছে। শ্রীলঙ্কার কিন্তু সে সুযোগও ছিল না। তাই আয়োজকদের হিসাব মোটেও ভুল ছিল না। ক্রিকেট গোল বলের খেলা। যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে! এখন আয়োজকদের (ভারত–পাকিস্তান ফাইনাল) বাড়া ভাতে শ্রীলঙ্কা ছাই দিয়ে বসলে তাদের কী করার আছে! হ্যাঁ, একটা কাজই করার আছে। কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘পারিব না’ কবিতার সেই লাইনটি তাঁরা শোকসন্তপ্ত বুকে দাওয়াই হিসেবে লাগাতে পারে—একবার না পারিলে দেখ শতবার!
মানে, এবারও যেহেতু হলো না, তাই আগামীবার নিশ্চয়ই একই চেষ্টা করা হবে! আয়োজকদের জন্য করতালি।