নাহিদ রানা কথা রাখতে জানেন
বিরল এক দৃশ্য। সেটি অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য। পেসারের বল ব্যাটসম্যানের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে স্লিপে গেল, ধরতে পারলেন না ফিল্ডার। কিন্তু পেসারের চোখেমুখে হতাশার লেশমাত্র নেই। ব্যর্থতাসূচক একটা শরীরী ঝাঁকি তো ছিলই, কিন্তু মুখে হাসিও ছিল। ব্যাপারটা এমন যে ‘এবার না হলেও পরেরবার হবে’ বোলার সেই বিষয়ে নিশ্চিত। স্লিপে ক্যাচ মিসের পর পেসারের মুখে হাসির এই ছবি হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন সংযোজন।
নাহিদ রানা সেই হাসির ধারক। ব্যাটসম্যান ছিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। নাহিদ শেষ পর্যন্ত রিজওয়ানকে আউট করতে পারেননি। কিন্তু তা কেউ মনে রাখবে না।
রাওয়ালপিন্ডিতে আজ চতুর্থ দিনে সবাই মনে রাখবেন টেস্টের গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া নাহিদের স্পেলটি। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে তখন ১৬তম ওভারের খেলা শেষ, স্কোর ৩ উইকেটে ৬১। ক্রিজে বাবর আজম এবং শান মাসুদ। ৭৩ রানের লিড। লক্ষ্য নাগালের মধ্যে রাখতে দ্রুত উইকেট নিতেই হতো। তখন টিভির স্ক্রিনে পরিসংখ্যানেও দেখাচ্ছিল, ২০১৩ সাল থেকে টেস্টে পাকিস্তানের মিডল অর্ডার (৫ম থেকে ৭ম) ব্যাটসম্যানদের গড় সর্বোচ্চ (৮ ম্যাচে ৫১.১৮)। তাসকিন আহমেদের জায়গায় বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন তাই নিয়ে এলেন নাহিদকে।
কেন? সে প্রশ্নের উত্তর ততক্ষণে ধারাভাষ্যকক্ষে বসে ব্যাখ্যা করছিলেন পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক আমির সোহেল। এই সিরিজে দুই দলের মধ্যে নাহিদই দ্রুততম। বলও একটু পুরোনো হয়েছে। এমন সময় বাবরের মতো কাউকে আউট করতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত গতির। নাহিদের সেই গতিটা আছে।
লিটন দাস পরশুই বলে গেছেন উইকেট একটু ‘মন্থর ও ধীর’ হয়ে এসেছে, এমন উইকেটে হুট করে অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত গতির পেসারদের মোকাবিলা করা অস্বস্তির। নাহিদ যেন এসব ব্যাখ্যাই অক্ষরে অক্ষরে ফলালেন ২২ গজে! তৃতীয় বলেই নাহিদের বাইরের বল খেলতে গিয়ে আউট শান মাসুদ। গতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি।
ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠল নাহিদের পরের ওভারে প্রথম বলেই। ১৪৬ কিলোমিটার গতিতে তাঁর বল বাবরের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা পড়ল স্লিপে। মাঝে এক ওভার পর আবারও একইভাবে আউট সৌদ শাকিল। ১৭ থেকে ২১—এই পাঁচ ওভারের মধ্যে পাল্টে যায় ম্যাচের মোড়। এই ৫ ওভারের মধ্যে ২০ রানে যে ৩ উইকেট পড়েছে, সব কটিই নাহিদের। সব কটিই নিয়েছেন ১৮ বলের ব্যবধানে, ১২ রান খরচায়। বাবর আউট হওয়ার পরের বলেই রিজওয়ানের ক্যাচ ছাড়ায় চতুর্থ উইকেটটি তখন পাননি।
পরে তিনি আবরারকে তুলে নেন এবং হাসান মাহমুদ ৫ উইকেট পেলেও নাহিদের ওই স্পেলটি আসলে পাকিস্তানকে দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭২ রানে গুটিয়ে দেওয়ার ‘নিউক্লিয়াস’—যে কারণে ১৮৫ রানের অতিক্রমযোগ্য লক্ষ্যও পেয়েছে বাংলাদেশ। এটি নাহিদের ক্যারিয়ার–সেরা বোলিংও (৪৪/৪)।
৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার নাহিদ আজ ঘণ্টায় ১৫০ কিমির কাছাকাছি গতিতেও বল করেছেন। মাত্রই ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে খেলতে নামা এই পেসারকে প্রথম সেশনে তখন বাবরকে আউট করতেই আনা হয়েছিল। এই রাওয়ালপিন্ডিতেই প্রথম টেস্টে বাবরকে বাউন্সার দিতে দিতে হুট করে সামনে বল পিচ করে (বোল্ড) পরিকল্পনার মাধ্যমে আউট করেন নাহিদ। বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল নিশ্চয়ই মনে রেখেছিলেন। অধিনায়ক নিশ্চয়ই আরও মনে রেখেছিলেন, এই সফরে যাওয়ার আগে নাহিদ নিজেই বলেছিলেন, পাকিস্তানের মাটিতে গতি দেখানোর চেষ্টা করব।
নাহিদ সেই প্রতিশ্রুতি কীভাবে রাখলেন তা একবার ভাবুন তো—যে পেস বোলিং পাকিস্তানের ঐতিহ্য, সেই পাকিস্তানের মাটিতেই পাকিস্তানি বোলারদের দর্শক বানিয়ে ধারে ও গতিতে দাপট দেখালেন এই ২১ বছর বয়সী। ভাবা যায়!
বাংলাদেশের পেসারদের নিয়ে এখন এমন কিছু সত্যিই ভাবা যায়। তাই ক্যাচ ছাড়ার পরও পেসারের মুখে হাসির বিরল দৃশ্যগুলো জন্ম নিচ্ছে!