নিল আর্মস্ট্রং হয়ে যেদিন ক্রিকেটের ‘চন্দ্রবিজয়’ করেছিলেন গাভাস্কার
কথাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই—‘মানুষের জন্য ক্ষুদ্র এক পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিরাট এক লাফ।’
তারপরও কে, কবে, কোন উপলক্ষে কথাটা বলেছিলেন, তা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো? কথাটা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নিল আর্মস্ট্রংয়ের। ভদ্রলোক নভোচারীও ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের পর কথাটা বলেছিলেন। আহমেদাবাদের অধুনালুপ্ত সরদার প্যাটেল স্টেডিয়ামে (বর্তমানে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম) ৩৭ বছর আগে সেদিন সুনীল গাভাস্কারও চাইলে এভাবে বলতে পারতেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে ক্ষুদ্র এক পদক্ষেপ, কিন্তু টেস্ট ব্যাটসম্যানদের জন্য বিরাট এক লাফ।’
কিংবা গাভাস্কার যদি ‘নস্ত্রাদামুস’ হতেন, আগামী দিনে কী ঘটবে, সেটা বুঝতে পারতেন, তাহলে কথাটা হয়তো উল্টো করে বলতে পারতেন, ‘টেস্ট ব্যাটসম্যানের জন্য ক্ষুদ্র এক পদক্ষেপ, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের জন্য বিরাট এক লাফ।’ এত ভণিতায় একটু কি বিরক্ত হচ্ছেন? আসলে সেই সময় এবং এই সময়ের মাহাত্ম্য বোঝাতেই আর্মস্ট্রংয়ের বাণী চিরন্তনী নিজের মতো বানিয়ে গাভাস্কারের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া। আচ্ছা, খুলেই বলা যাক।
১৮৭৭ সালে টেস্ট ক্রিকেট যাত্রা শুরুর পর এই সংস্করণে কারও ১০ হাজার রান দেখতে সময় লেগেছে ১১০ বছর। সে সময় ব্যাপারটার মাহাত্ম্য ছিল অনেকটা চন্দ্রবিজয়ের মতোই। কিন্তু তারপর? ১৯৮৭ সালে ভারতের আদি ‘লিটল মাস্টার’ টেস্টে প্রথম ১০ হাজার রানের সেই মাইলফলক গড়ার পর এই ৩৭ বছরে একই মাইলফলকের দেখা পেয়েছেন আরও ১৩ জন। ভাবুন একবার, ১১০ বছরে যেখানে একজন, ৩৭ বছরে সেখানে ১৩ জন!
অর্থাৎ সুনীল গাভাস্কারের সেই ১০ হাজার রান টেস্ট ক্রিকেটের জন্য ক্ষুদ্র এক পদক্ষেপ হলেও টেস্ট ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল বিরাট অগ্রযাত্রা। কারণ, আর্মস্ট্রংয়ের দেখানো পথে পরে যেমন বাজ অলড্রিন, পিট কনরাড, অ্যালান বিন, এডগার মিচেলরা চাঁদে হেঁটেছেন; তেমনি গাভাস্কার মাইলফলকটি গড়ার পর সেটি ছুঁয়েছেন অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, কুমার সাঙ্গাকারা...।
আবার উল্টোটাও ভেবে নেওয়া যায়। টেস্টে টেন্ডুলকারের ১৫ হাজার প্লাস, পন্টিং–ক্যালিসের ১৩ হাজার প্লাস রান দেখে গাভাস্কারের সেই ১০ হাজারকে এখন একটু ‘ক্ষুদ্র’ লাগতে পারে। কিন্তু অতিকায় ও অতল গভীর টেস্ট–সুমদ্রে গাভাস্কার ধৈর্য ও দক্ষতার মন্থনে ১০ হাজার সূচক প্রথম যে ‘ক্ষুদ্র’ পদ্মটি তুলে এনেছিলেন—তারপর তো ধীরে ধীরে ব্যাপারটা এমন হলো যে কবিয়াল রমেশ শীলের সেই গানটি ক্রিকেটের ছাঁচে ব্যবহার করা যায়, ‘ইশকুল খুইলাছে রে মাওলা, ইশকুল খুইলাছে/ সুনীল গাভাস্কার ১০ হাজার রানের ইশকুল খুইলাছে!’
রসিকতা নয়, এখনকার রানপ্রসবা ক্রিকেট বিচারে গাভাস্কারের সেই ‘ক্ষুদ্র’ অর্জন টেস্ট ক্রিকেটের অগ্রযাত্রায় কতখানি অবদান রেখেছিল, তার প্রমাণ পরে একই ক্লাবের সদস্য হওয়া ১৩ জন ও অপেক্ষমাণ আরও কয়েকজন—স্টিভ স্মিথ (৯৬৬৫), বিরাট কোহলি (৮৪৪৮), কেইন উইলিয়ামসন (৮৬৭৫)। তাই গাভাস্কারের সেই অর্জন টেস্ট ব্যাটসম্যানের জন্য ক্ষুদ্র পদক্ষেপ হলেও টেস্ট ক্রিকেটের জন্য বিরাট অগ্রযাত্রাই।
অল্পের সঙ্গে গল্পে সেই অগ্রযাত্রার কথাই হোক আজ।
১৯৮৭ সালে ভারত সফরে গিয়েছিল পাকিস্তান। সেটা ছিল পাঁচ টেস্টের সিরিজ এবং ভারতের হয়ে এই সংস্করণে গাভাস্কারের খেলা শেষ সিরিজও। চেন্নাইয়ে সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলতে নামার আগে ১২১ টেস্টে গাভাস্কারের রান ছিল ৯৮২৭। অর্থাৎ ১০ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁতে দরকার ছিল মাত্র ১৭৩। চেন্নাইয়ে ড্র হওয়া প্রথম টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসে আউট হয়ে গেলেন ৯১ রানে। আর কত রান বাকি থাকল, হিসাব করে ফেলুন।
সতীর্থ ওপেনার কৃঞ্চমাচারি শ্রীকান্তকে গাভাস্কার প্রায়ই বলতেন, ‘চিকা, দেখিস একদিন একই ম্যাচে আমি তোর চেয়ে দ্রুতগতিতে ফিফটি করব।’ শ্রীকান্তের দাবি অনুযায়ী, চেন্নাইয়ে সিরিজের সেই প্রথম টেস্টেই কথা রেখেছিলেন গাভাস্কার—তিনি ফিফটি তুলে নেওয়ার ‘এক বল পর ফিফটি পেয়েছিলেন’ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া শ্রীকান্ত। সে যা–ই হোক, চেন্নাই টেস্ট শেষে গাভাস্কারের সংগ্রহ দাঁড়াল ১২২ টেস্টে ৯৯১৮ রান। এখনকার মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ হলে সে সময় নিশ্চয়ই পুরো ভারতজুড়েই গাভাস্কারের ১০ হাজারের ক্ষণগণনা নিয়ে তুলকালাম হতো। একদম যে হয়নি, সেটাও নয়। কাগজে যেমন লেখা হচ্ছিল অপেক্ষার গল্প, মানুষও তেমনি মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিশেষ করে কলকাতার মানুষ। কারণ, পরের টেস্টটাই ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের নন্দনকানন ইডেন গার্ডেনে।
কিন্তু গাভাস্কার ইডেনে সেই টেস্টে খেলেননি। একদম পত্রপাঠ নয়!
ভারত টানা ২৯ টেস্ট জিততে না পারায় কপিল দেবকে সরিয়ে ১৯৮৪–৮৫ মৌসুমের শুরুতে গাভাস্কারকে অধিনায়ক বানানো হয়। ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ড গেল ভারত সফরে। মুম্বাইয়ে ভারত প্রথম টেস্ট ৮ উইকেটে জিতলেও সেটিকে ‘মিথ্যা সূর্যোদয়’ বলা হয়েছিল ইংল্যান্ড দিল্লিতে দ্বিতীয় টেস্ট জিতে সমতায় ফেরার পর। ইডেনে (১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শুরু) তৃতীয় টেস্টে ভারত দুই দিনের বেশি সময় ধরে ব্যাট করে ২০০ ওভারে ৭ উইকেটে মাত্র ৪৩৭ রান তুলেছিল। ভারতের মন্থর ব্যাটিংয়ে (আজহারউদ্দিনের ৩২২ বলে ১১০ ও রবি শাস্ত্রীর ৩৫৭ বলে ১১১) তিতিবিরক্ত দর্শকেরা গ্যালারিতে শোর তুলেছিলেন, ‘গাভাস্কার ডাউন! গাভাস্কার আউট!’ সত্য–মিথ্যা নির্ণয় হয়নি তবে গুঞ্জন রয়েছে, ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে ভারতের অধিনায়ককে অনুরোধ করেছিল কলকাতার পুলিশ। আর দর্শক রাগে–ক্ষোভে গাভাস্কার এবং তাঁর স্ত্রীকে ফল, বোতল ও পাথরও ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
গাভাস্কার এরপর শপথ করে বলেছিলেন, তিনি আর কখনো ইডেন গার্ডেনে খেলবেন না। সে জন্যই ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেননি ইডেন টেস্টে। এরপর জয়পুরে তৃতীয় টেস্টে ভারতের দুই ইনিংস মিলিয়ে করলেন ২৪ (০ ও ২৪)। টেস্টে গাভাস্কারের মোট রানসংখ্যা দাঁড়াল ১২৩ ম্যাচে ৯৯৪২। দরকার আর ৫৮!
আহমেদাবাদে ভারতের প্রথম ইনিংসেই হয়ে গেল সেটি। তৃতীয় দিনে চা–বিরতির পর পাকিস্তানের স্পিনিং অলরাউন্ডার ইজাজ ফাকিহকে থার্ড ম্যানে লেট কাট করে ২ রান নিয়ে অমরত্ব নিশ্চিত করেন গাভাস্কার। কীসের অমরত্ব? টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ১০ হাজার রানের মাইলফলক ছোঁয়ার অমরত্ব। প্রশ্ন করতে পারেন, অনেকেই তো করেছেন। তাহলে অমরত্ব হলো কীভাবে! আচ্ছা, তাহলে একটা প্রশ্ন—চাঁদে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে পা রেখেছেন কে? এটা না পারলে আরেকটি প্রশ্ন—দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিলেন কে?
মাথাটা একটু চুলকে মনে করার চেষ্টা করাই স্বাভাবিক। কারণ, ‘দ্বিতীয়’কে কেউ মনে রাখেন না। সবাই মনে রাখেন প্রথমকে। ইতিহাসের পাতাও তা–ই। অনেকেই অনেক কিছু করতে পারেন, কিন্তু সেসব তালিকায় যাঁরা প্রথম—ইতিহাসে তাঁরা অমর। চন্দ্রবিজয়ে যেমন নীল আর্মস্ট্রং, টেস্ট ক্রিকেটে ১০ হাজার রানে তেমনি গাভাস্কার!
আজ সেই দিন—যেদিন নিল আর্মস্ট্রং হয়ে টেস্ট ক্রিকেটের ‘চন্দ্রবিজয়’ করেছিলেন গাভাস্কার।