বাবরনামায় নিষ্প্রভ এক বছর ২০২৩
প্রথম ইনিংস—ব্যাক অব দ্য লেংথ ডেলিভারি। আউট সাইড অফে করা প্যাট কামিন্সের বল ভেতরে ঢুকল। তাতে ব্যাট ও প্যাডের ফাঁক গলে বাবর আজমের স্টাম্প লন্ডভন্ড।
দ্বিতীয় ইনিংস—এবারও ভেতরে ঢোকা বলে ব্যাট ও প্যাডের ফাঁক গলেই বাবর বোল্ড।
পার্থক্য শুধু প্রথম ইনিংসে যে কাজটা করেছিলেন প্যাট কামিন্স, দ্বিতীয় ইনিংসে সেটাই জশ হ্যাজলউড। অর্থাৎ মেলবোর্ন টেস্টে নামার আগে বাবরকে ফাঁদে ফেলার পাঠ ভালোভাবেই নিয়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা। পরীক্ষাতেও তারাই সফল।
মেলবোর্ন টেস্টে বাবর রান পেলে কী হতে পারত? পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে ফেরা যাক। ৩১৭ রান তাড়া করতে নেমে একসময় পাকিস্তানের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ১৪৬। হাতে ৭ উইকেট, রান প্রয়োজন ১৭১। পুরো দেড় দিন বাকি থাকায় পাকিস্তানের চিন্তা ছিল না। সবচেয়ে বড় বিষয় ক্রিজে তখন সৌদ শাকিলের সঙ্গে বাবর। ক্রিজে পুরোপুরি থিতু হয়ে গিয়েছিলেন। ৭৮ বলে ৪১ রানে ব্যাট করছিলেন। ঠিক তখনই বাবরের স্টাম্প ছত্রখান!
বলটাও দুর্দান্ত ছিল। তবে বাবর তো বাবর হয়ে উঠেছেন এমন দুর্দান্ত সব ডেলিভারিকে বশ মানিয়েই। অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশন পাকিস্তানের জন্য বরাবরই কঠিন। গত ২৮ বছরে সেখানে কোনো টেস্ট জিততে পারেনি তারা। টেস্ট সিরিজ তো কখনোই জিততে পারেনি। মেলবোর্ন টেস্টে পাকিস্তান তাই জিতে গেলে সেটা হতো ঐতিহাসিক। ইতিহাসের সাক্ষী হতে বাবরকে তিন অঙ্কের ঘরের কোনো ইনিংসই খেলতে হতো। সেটা তিনি পারলেন না।
প্রথম ইনিংসে বাবর ক্রিজে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। ৭ বলে ১ রানে আউট বাবরের উইকেট দিয়েই মূলত সেদিন পাকিস্তানের ব্যাটিং ধস শুরু হয়। বাবর যখন ক্রিজে আসেন তখন ৫৯ বলে ৪৪ রানে অপরাজিত অধিনায়ক শান মাসুদ। সেদিন মাসুদকে তিনি সঙ্গ দিতে পারেননি। এরপর ১ উইকেটে ১২৪ রান করা পাকিস্তান ১৭০ রানেই হারায় ৬ উইকেট। পাকিস্তানের আর লিড নেওয়াও হয়নি। ছোট ছোট জুটিতে ২৬৪ তুলতে পেরেছিল।
বাবর বিশ্বকাপের পরই অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন। সেটা চাপের মুখে নেওয়া সিদ্ধান্ত। কারণ অনেকেই মনে করেন, অধিনায়কত্বের চাপে ব্যাটসম্যান বাবরের সেরাটা পাওয়া যাচ্ছে না। বাবর অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর অস্ট্রেলিয়া সিরিজই ছিল পাকিস্তানের প্রথম সিরিজ। অধিনায়কত্ব ছেড়ে যেহেতু চাপমুক্ত, তাই বাবরকে নিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন পাকিস্তানের সমর্থকেরা। কিন্তু সেটি তিনি মেটাতে ব্যর্থ। শুধু কি মেলবোর্ন, পার্থে প্রথম টেস্টে দুই ইনিংসে করেছিলেন যথাক্রমে ২১ ও ১৪।
চলতি বছর টেস্টে বাবরের ব্যাট মোটেই কথা বলেনি। মেলবোর্ন টেস্টে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪১ রানই চলতি বছরে তাঁর সর্বোচ্চ। ওয়ানডে বিশ্বকাপের বছর খুব বেশি টেস্ট খেলেছেন, তা–ও নয়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুটি টেস্ট খেলেছেন। সেখানে ৯ ইনিংসে বাবরের রান মাত্র ২০৪, গড় ২২.৬৬। অথচ গত বছর টেস্টে বাবর রান করেন ৬৯.৬৪ গড়ে। ১৭ ইনিংসে ৪ শতক ও ৭টি অর্ধশতক।
২০২১ সালে টেস্টে বাবরের ভাটা গেছে। ১৩ ইনিংসে রান করেন ৩৪.৬৬ গড়ে। শতক নেই, ৪টি অর্ধশতক। তবে এর আগের তিন বছরই টেস্টে রান করেছেন ৫০ এর বেশি গড়ে। ২০২০ সালে ৬৭.৬০ এবং ২০১৯ সালে ৬৮.৪৪। ২০১৮ সালে তাঁর গড় ছিল ৫৬। যদিও ২০২০ সালে বাবরের টেস্ট ইনিংস ছিল ৬টি। তবে ২০১৯ সালে ১১টি ও ২০১৮ সালে ১৪টি।
চলতি বছর ওয়ানডেতেও বাবর তুলনামূলক নিষ্প্রভ। এ বছরে ২৪ ইনিংসে ব্যাট করেছেন ৪৬.৩০ গড়ে ও ৮৪.৬৫ স্ট্রাইকরেট, যা ২০১৯ সালের পর গড় ও স্ট্রাইকরেটে সর্বনিম্ন। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২—এ তিন বছরে বাবর একবারও ওয়ানডেতে ১০ ইনিংসের বেশি খেলেননি। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ সালকে চলতি বছরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সে বছর বাবর ওয়ানডেতে ২০ ইনিংসে ৬০.৬৬ গড় এবং ৯২.৩০ স্ট্রাইকরেটে ১০৯২ রান করেন।
৪৬.৩০ গড়টা হয়তো দেখতে মন্দ নয়। কিন্তু গত বছর অমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ভাবা হচ্ছিল চলতি বছরটাও বাবরেরই হবে, কিন্তু ওয়ানডে এবং টেস্ট মিলিয়ে তেমনটা কিছুই দেখা যায়নি। আর বিশ্বকাপে ব্যর্থতা তো আছেই। টি-টোয়েন্টিতে এ বছর বাবর ইনিংসই খেলেছেন ৪টি। রান ৪৩.৩৩ গড়ে ১৩০।
অনেকেই বাবরকে তুলনা করেন ভারতের বিরাট কোহলির সঙ্গে। সেটি সংখ্যার দিক থেকে কোহলি যোজন যোজন এগিয়ে থাকার পরও। বাবরের এবারের নিষ্প্রভ বছরে সেই কোহলি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নতুন জীবন পেয়েছেন। টেস্টে ১২ ইনিংসে ৬৭১ রান ৫৫.৯১ গড়ে, ২টি শতক। অথচ গত তিন বছর বিবেচনায় কোহলির সর্বোচ্চ গড় ছিল ২০২১ সালে। সে বছর ১৯ টেস্ট ইনিংসে তাঁর গড় ছিল ২৮.৫১। ২০২২ সালে কোহলি খেলেছেন ১১ ইনিংস, ২০২০ সালে ৬ ইনিংস।
ওয়ানডেতে তো এ বছরটাই কোহলির। ২৪ ইনিংসে ৭২.৪৭ গড় আর ৯৯.১৩ স্ট্রাইক রেটে রান ১৩৭৭। শতক ৬টি। ২০১৮ সালের পর গড়ের হিসাবে এটাই কোহলির সেরা বছর। গত ৫ নভেম্বর বিশ্বকাপের লিগ পর্বে কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শচীন টেন্ডুলকারের ৪৯ শতকের রেকর্ড স্পর্শ করেন। এরপর সেমিফাইনালে মুম্বাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবের ৫০ শতকের রেকর্ড গড়েন।
২০২২ সালে আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি জিতেছিলেন বাবর। এমন স্বীকৃতি পাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই কোহলির সঙ্গে তাঁর তুলনা আরও বেশি টানা হচ্ছিল। তবে চলতি বছর দুজনের ব্যবধান আরও স্পষ্ট করল। আসছে বছরে কেমন করবেন ২৯ বছর বয়সী বাবর? পারফর্ম করার তো এখনই সময়!