ওয়ারিউড বিচে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘এই যে সমুদ্র দেখছেন, এরপরই আমেরিকা। আমি অন্তত তা–ই বলি...।’
শুনে একটু ভ্যাবাচেকাই খেয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে আছি সিডনিতে, সামনে প্রশান্ত মহাসাগর। আর উনি বলছেন ওপারে নাকি আমেরিকা! ওয়ার্ল্ড ম্যাপ খুলে বসলে অবশ্য ও রকম কিছুটা মনে হতেই পারে। সাগর পাড়ি দিলে আফ্রিকার সুচালো অগ্রভাগটা একটু ছুঁয়ে দক্ষিণ আমেরিকা। কিন্তু সেটাও তো এত কাছে নয় যে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে বলে দেওয়া যায়, ‘এরপরই আমেরিকা’! বিমানে সরাসরি ওপারে যেতেও ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার কম নয়।
কাওসার খান সাহেব কথাটা মজা করেই বলেছেন আসলে। ২২ বছর যাবৎ অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। পেশায় আইনজীবী, লেখালেখিও করেন। আজ দুপুরে হোবার্ট থেকে সিডনিতে পৌঁছার পর বিকেল পর্যন্ত তাঁর সঙ্গেই কাটল। কাটল বলতে ঘোরাঘুরি এবং সেই ঘোরাঘুরির মানচিত্রটা যদি একটিমাত্র সরলরেখা দিয়ে আঁকতে হয়, তাহলে ওপরের শিরোনামটাই চলে আসে মাথায়—সিডনি অপেরা থেকে আমেরিকার ‘কাছাকাছি’।
আজ সিডনিতে পা দিয়ে কাওসার খান সাহেবের সৌজন্যে যে অভিজ্ঞতা হলো, প্রায় সে রকমই এক অভিজ্ঞতা এর আগে হয়েছিল ২০১৮ সালের জুনে। ভারতের দেরাদুনে আফগানিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে দেশে ফিরছিলাম, যাত্রাপথে দিল্লিতে এক দিনের বিরতি।
হোটেলে কোনোরকমে ব্যাগপত্র রেখেই বের হয়ে গিয়েছিলাম দিল্লি দর্শনে। সকাল ১০টার দিকে দিল্লিতে নেমে দিনের আলো থাকতে থাকতেই ইন্ডিয়া গেট, লালকেল্লা, কুতুবমিনার, কনট প্লেস—সব দেখা শেষ। ট্যাক্সিওয়ালা আরও কিছু জায়গায় নিয়ে গেলেও সব এখন আর মনে নেই। রাতে জামে মসজিদ দেখে বিখ্যাত করিমস হোটেলে কাবাব-রুটি খেয়ে শেষ হয়েছিল আমার দিল্লি দর্শন। পরদিন সকালেই ছিল ঢাকার ফ্লাইট।
দিল্লিতে সেদিন ছিল প্রচণ্ড গরম, সে তুলনায় সিডনির আবহাওয়া রীতিমতো স্বর্গীয়। এখানে এসেছি অবশ্য হোবার্ট থেকে। সেখানেও আবহাওয়া মাঝেমধ্যেই অসহনীয় হয়ে উঠতে দেখেছি, তবে দিল্লির উল্টো রকমে। প্রচণ্ড বাতাস, রাতে তাপমাত্রা কখনো কখনো নেমে যায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নিচে। প্রথমে ভেবেছিলাম সমস্যাটা আমারই। কিন্তু তাসমানিয়ার রাজধানীতে তিন দিনের যা অভিজ্ঞতা, তাতে দেখলাম, সেখানে ৫-৭ বছর থেকে ফেলা ভারতীয়-নেপালিদের অনেকেই শুধু বেতাল ঠান্ডা থেকে বাঁচতে অস্ট্রেলিয়ার অন্যত্র পাড়ি জমানোর চিন্তাভাবনা করছেন।
আজ দুপুরে সিডনির রোদ–ঝলমলে আকাশ, তাই উড়োজাহাজে থাকতেই মন ভালো করে দিল। উড়োজাহাজ সিডনি বিমানবন্দরের রানওয়ে ছুঁতেই স্পিকারে পাইলটের কণ্ঠে রীতিমতো সুখবর—সিডনিতে স্বাগত, এখানে এখন তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে কাওসার খান প্রস্তাব দিলেন, হোটেলে যাওয়ার আগে সিডনি শহরটা একটু ঘুরে দেখব কি না। প্রস্তাবটা লোভনীয়, কারণ সূচিতে তিনি সিডনি অপেরা হাউস, হারবার ব্রিজ, হাইড পার্ক, সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড এবং তাঁর ভাষায় ‘আমেরিকার বর্ডার’ও রেখেছেন।
সিডনিতে থাকা হবে মাত্র তিন দিন। এর মধ্যে আজকের দিনটা বাদ দিলে বাকি দুই দিনই ব্যস্ততায় কাটবে। কাল বাংলাদেশ দলের অনুশীলন, পরশু তো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলাই। এর পরদিনই ধরতে হবে ব্রিসবেনের ফ্লাইট। সিডনিতে থেকেও সিডনি শহরটাই ঠিকঠাকভাবে দেখা কঠিন এত অল্প সময়ের মধ্যে।
কাওসার সাহেবের ঝটিকা সফরের প্রস্তাবে তাই রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। অনুপ্রেরণা দিল্লি দর্শন। বিশ্বকাপের ম্যাচ কাভার করতে এসে দর্শনীয় স্থান দেখার লোভ সামলাতে না পারলে ঝটিকা সফরই একমাত্র উপায়।
সিডনি অপেরার ছবি ক্যালেন্ডারের পাতায়, ইন্টারনেটে, মানুষের ফেসবুক পোস্টে অনেকই দেখেছি। হারবার ব্রিজও দেখেছি। তবে অস্ট্রেলিয়ায় আগে আসিনি বলে দুটোকে একসঙ্গে স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। বোনাস হিসেবে অপেরা হাউসের পাশেই ভেড়ানো ছিল বিশাল ক্রুজ শিপ প্যাসিফিক অ্যাডভেঞ্চার। সেটি আবার আমরা থাকতে থাকতেই সেখান থেকে চলতে শুরু করল।
যাঁরা সিডনিতে থাকেন বা সিডনি সিবিডি (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট) যাঁদের ঘোরা আছে, তাঁদের জন্য এসব বর্ণনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু একটা জায়গায় নতুন আসা কারও চোখে তো সবই নতুন লাগবে। আমারও তাই লাগতে লাগল। ছবিতে দেখা সিডনির সঙ্গে একটা পার্থক্য হলো, ছবিতে আপনি অপেরা হাউস, সিডনি হারবার, হারবার ব্রিজ—এসবকে আলাদা আলাদাই দেখবেন। কখনো একই ছবিতে দেখলেও পুরো পরিবেশ তো আর বোঝার উপায় থাকে না সেখানে। অপেরা হাউসের সশরীর হাজির হয়ে প্রথম কাজ করল এই রোমাঞ্চটাই—সব একসঙ্গে!
পুরো এলাকায় মূলত পর্যটকদেরই আনাগোনা। সিডনি হারবারের পাশের সুদৃশ্য কফি শপ আর বার—রেস্টুরেন্টগুলোয় মানুষের এলায়িত ভঙ্গি বলে দিচ্ছিল, ‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি...।’ এক নবদম্পতি পাওয়া গেল, যাঁরা এসেছেন সিডনির আইকনিক স্থাপত্যগুলোকে পেছনে রেখে ফটোশুট করতে। কখনো অপেরা হাউস, কখনো হারবার ব্রিজ, কখনোবা দুটোকেই তাঁদের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী করতে ফটোগ্রাফারের সেকি প্রাণান্ত চেষ্টা!
বেশির ভাগ পর্যটকের মনোযোগ অবশ্য দেখলাম সেদিকেই—কীভাবে একটা ভালো ছবি তোলা যায়। এত দিন শুধু সেসব ছবিই ফেসবুকে দেখেছি। আজ দেখলাম, ছবিগুলো কীভাবে তোলা হয়। আমি নিজেও যে চেষ্টা করিনি, তা নয়। তবে অল্প সময়ে অপেরা হাউসের জুতসই অ্যাঙ্গেল খুঁজে পাওয়া দেখলাম বেশ কষ্টকরই।
আকাশ মেঘলা হয়ে ওঠায় একটু আগেই যেন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল সিডনিতে। তার মধ্যেই হাইড পার্ক, গভর্নর হাউস হয়ে গাড়ি চলে এল সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের (এসসিজি) সামনে। বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ উপলক্ষে সিডনিতে আগামী দুই দিন এটাই আমাদের আসল ঠিকানা।
ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই এসসিজি। তবে সেসব ইতিহাসের কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই। সিডনিতে যে এর আগে কখনো আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলেনি বাংলাদেশ দল!
এসসিজির সামনে গিয়ে সেটাই মনে পড়ল আগে। আমার কাছে সিডনি অপেরা হাউস যা, সাকিব আল হাসানদের কাছে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডও তা। আমি বরং একটু এগিয়ে। সিডনির মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘আমেরিকার বর্ডার’ তো আর ক্রিকেটাররা দেখেননি, হোটেলে আসার আগে যেটি ছিল আমার ঝটিকা সফরের শেষ স্টপেজ।