বলুন তো, টেস্ট ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর কত? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে?
বেশির ভাগই বলতে পারবেন না বলে অনুমান করি। আপনার যদি স্কোর দুটি মুখস্থ থেকে থাকে, তাহলে রাগ করবেন না প্লিজ। ‘বেশির ভাগ’ কথাটা তো লিখেছি আপনার মতো ব্যতিক্রম দু–একজনের কথা মাথায় রেখেই। শুধু ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ বলেই নয়, ওই ইনিংস দুটির আরও গভীর তাৎপর্য আছে। ১৯৩০ সালে লিডসের হেডিংলিতে ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ ৩৩৪ সেই সময়ে টেস্টেও সর্বোচ্চ স্কোর। ওই ইনিংসের আসল মহিমা অবশ্য অন্য। এই ৩৩৪-এর ৩০৯ রানই এক দিনে। এর আগে-পরে টেস্ট ক্রিকেট যা দেখেনি কখনো।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪৫২-ও তখন বিশ্ব রেকর্ড। টেস্ট রেকর্ডটি মাত্র তিন বছর আয়ু পেলেও এটি টিকে ছিল প্রায় ২৯ বছর। তারপরও কজনের তা মনে আছে, সেই সংশয়ের কথা তো শুরুতেই বলেছি। তবে প্রশ্নটা যদি হয়, শেষ টেস্ট ইনিংসে ব্র্যাডম্যানের স্কোর কত ছিল, আমার ধারণা, ক্রিকেট অনুরাগীমাত্রই বিরক্তিসূচক ‘এটা কে না জানে’ ভঙ্গি করবেন। আরে, ওই শূন্যের কথা কে না জানে!
আর কারও জন্যই যেন কোনো কীর্তি অবশিষ্ট রাখতে চাননি স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। নইলে টেস্ট ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত ইনিংসের মতো সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটাও কেন তাঁরই হবে!
এতই বিখ্যাত যে নানা আলোচনায় এখনো তা ঘুরেফিরে আসে। এতই বিখ্যাত যে অনেক কীর্তির সাক্ষী লন্ডনের ওভাল মাঠে প্রথম পা রাখার পর বাকি সব ছাপিয়ে আমার সেই শূন্যের কথাই প্রথম মনে পড়েছিল। এতই বিখ্যাত যে সেই শূন্যের ৭৫ বছর পূর্তিতে তা নিয়ে লিখতেও বসে গেলাম।
টেস্ট ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যান শেষবারের মতো ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট। সেদিনই ওই শূন্য। ৭৫ বছর পরও যা অসীম কৌতূহলের বিষয় হয়ে আছে।
ইংল্যান্ডের প্রথম টেস্ট ভেন্যু ওভালে প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৯৯ সালে। মাঠটা দৃষ্টিসীমায় আসতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়েছিল। সেই সাদা-কালো ওভাল, ব্যাট করতে নামা ডন ব্র্যাডম্যানকে অধিনায়ক নরম্যান ইয়ার্ডলির নেতৃত্বে ইংলিশ খেলোয়াড়দের ‘থ্রি চিয়ার্স’ দেওয়া, দুই বলের ইনিংস শেষে তাঁর ধীর পদক্ষেপে টেস্ট ক্রিকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া—সব চোখের সামনে ভাসতে শুরু করল। কৈশোর থেকে এ নিয়ে পড়তে পড়তে এমন হয়েছে, দৃশ্যগুলো যেন নিজেই দেখেছি!
ব্যাটিং করতে নামার সময় প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় আর দর্শকদের দেওয়া সংবর্ধনায় আবেগাক্রান্ত ব্র্যাডম্যানের চোখে জল চলে এসেছিল, এ কারণেই এরিক হলিসের গুগলিটি দেখতে না পেয়ে আউট হয়ে যান—খুব জনপ্রিয় এই ধারণাকে নিজেই নস্যাৎ করে দিয়ে গেছেন স্যার ডন। নিজেকে তিনি এমনই এতটা ‘ঈশ্বরতুল্য’ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করতে চায়নি, ক্রিকেটিং কোনো কারণে তাঁর টেস্ট অ্যাভারেজ পুরোপুরি ১০০ করার জন্য প্রয়োজনীয় ৪টি রান করতে পারেননি। এ কীভাবে হয়!
চোখে জল-টলের ব্যাপার নেই, তবে অন্য একটা সমস্যা যে তাঁর হয়েছিল, সেটি স্যার ডন লিখে গেছেন ১৯৫০ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট-এ। যেটির বঙ্গানুবাদ দাঁড়ায় এমন: আরেকটি দারুণ সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে যখন আমি নামছি, আমার মন চলে গিয়েছিল ১৮ বছর আগে এই মাঠেই জ্যাক হবসের শেষ টেস্টে। সেই দৃশ্যেরই যেন পুনরাভিনয় হচ্ছে এখানে। ফিল্ডাররা সব একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থ্রি চিয়ার্স দিচ্ছে, জানাচ্ছে শুভকামনা (অবশ্যই পরের বছরগুলোর জন্য)। খেলা শুরু হলো, তারপর আমি মনে-প্রাণে ভালো করতে চাইছিলাম। কিন্তু তা হওয়ার নয়। ওই অভ্যর্থনা আমার আবেগকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে আমার মনকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিল, যে মানসিক অবস্থাটা যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই খুব মারাত্মক। আমি হলিসের প্রথম বলটি খেললাম, যদিও তা ঠিকমতো দেখতে পেরেছিলাম কি না, ঠিক নিশ্চিত নই সে ব্যাপারে। দ্বিতীয় বলটি হলো নিখুঁত লেংথে পড়া এক গুগলি, যা বোকা বানাল আমাকে। আমি শুধু ব্যাটের ভেতরের কানাটা ছোঁয়াতে পারলাম তাতে, এরপর শুধু অফ স্টাম্পের বেল পড়ে যাওয়ার শব্দ।
এই হলো স্যার ডনের নিজের কলামে তাঁর শেষ টেস্ট ইনিংস, যেটি স্যার ডনকে সাধারণ মানুষে পরিণত করার পাশাপাশি এরিক হলিসকে উপহার দিয়েছে অমরত্ব। এই কীর্তিটা না করে ফেললে কজন জানত ১৩ টেস্টে ৪৪ উইকেট নেওয়া এই লেগ স্পিনারের নাম? তবে এই টেস্টের আগেই স্যার ডনের কাছ থেকে ভালো বোলার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন হলিস। ওয়ারউইকশায়ারের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচটিতে টানা ৪৩.৫ ওভার বোলিং করে ১০৭ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন। যে পারফরম্যান্সকে স্যার ডনও ‘আউটস্ট্যান্ডিং’ বলে রায় দিয়েছেন আত্মজীবনীতে। এই পারফরম্যান্সই হলিসকে সুযোগ করে দিয়েছিল সিরিজের পঞ্চম ও শেষ টেস্টে।
৮০ ইনিংসে যার ২৯টি সেঞ্চুরি, তাঁর শেষ ইনিংসে শূন্য; এটুকুই যথেষ্ট ছিল এই ‘শূন্য’কে অমর করে রাখতে। শেষ ইনিংসে ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন ১০১.৩৯ অ্যাভারেজ নিয়ে, ৪ রান করতে পারলেই অ্যাভারেজটা ঠিক ১০০ হতো—এই হাহাকার এতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। তবে স্যার ডন এমনই এক রান মেশিন ছিলেন যে তাঁর সব শূন্য নিয়েই আছে বাড়তি কৌতূহল। টেস্ট ক্রিকেটে বোলারদের জন্য বর্ণনাতীত আনন্দের এ ঘটনা ঘটেছে সাতবার। এর মধ্যে দুবারই ১৯৪৮ সালের ওই ইংল্যান্ড সফরে। শেষ টেস্টের আগে নটিংহামে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও কেন যেন রান করা হয়ে ওঠেনি ব্র্যাডম্যানের। সেবার বোলারের নাম অ্যালেক বেডসার।
এই মিডিয়াম পেসারই টেস্টে দ্বিতীয় সর্বাধিক ছয়বার আউট করেছেন ব্র্যাডম্যানকে (বাঁহাতি স্পিনার হেডলি ভেরিটি করেছেন সবচেয়ে বেশি আটবার), তাঁকে একাধিকবার শূন্য রানে আউট করার একমাত্র কীর্তিটিও তাঁরই। টেস্ট ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শূন্য ‘উপহার’ দিয়েছেন এই বেডসার। ১৯৪৮ সিরিজের শেষ দুটি শূন্য ছাড়া ব্র্যাডম্যানের বাকি ৫টি শূন্যই দেশের মাটিতে। এর মধ্যে ১৯৩৬-৩৭ অ্যাশেজ সিরিজে স্যার ডনকে পরপর দুই ইনিংসে শূন্য রানে আউট করার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলেন ইংল্যান্ডের বোলাররা।
ব্রিসবেনে বিল ভোসের বলে ক্যাচ নিয়ে যে গ্যাবি অ্যালেন শূন্যতে ফিরিয়ে দেন ব্র্যাডম্যানকে, সিডনিতে পরের টেস্টে তিনিই নামেন মূল হন্তারকের ভূমিকায়। আরেকটা ছোট্ট তথ্য যোগ করা যায় এখানে। ওভালে শেষ টেস্টে একটি ইনিংসই ব্যাট করেছেন ডন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করার সুযোগ পেলে কী হতো, তা অনুমান করা এমন দুঃসাধ্য কিছু নয়। কারণ, বাকি ৬টি শূন্যের ৩টিতেই অন্য ইনিংসে সেঞ্চুরি এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে।
৫২ টেস্টে ৬,৯৯৬ রান, গড় ৯৯.৯৪, ২৯টি সেঞ্চুরি, যার ২টি ট্রিপল, ১০টি ডাবল—এসবের পাশাপাশি ব্র্যাডম্যানের শূন্য নিয়ে এমন আলোচনাটাও তাঁর গ্রেটনেসেরই প্রমাণ। শেষ ইনিংসে শূন্য রানে আউট হওয়ার ৭৫তম বার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে লেখাও কি তা–ই নয়!