বিশ্বকাপ শুরুর আগে কোটি টাকার প্রশ্ন তো আসলে একটাই। কোটি টাকার বলছি কেন, আসলে তো ৪৪ কোটির টাকার। ২০২৩ আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দল কত পাবে, জানেন তো? ‘মাত্র’ ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। কে চ্যাম্পিয়ন হবে, এটি তাই ‘ফোর মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন’। টাকার অঙ্কে ৪৪ কোটি টাকার প্রশ্ন।
তা মহামূল্য এ প্রশ্নের উত্তর কী, মানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হবে কোন দল? আমাকে বলতে বলছেন! আরে, এর চেয়ে সহজ প্রশ্ন আর হয় নাকি! আমি বলার পর বুঝবেন, উত্তরটা আপনারও জানা ছিল। কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে, এই প্রশ্নের উত্তর—যে দল ফাইনালে জিতবে।
২০১৯ বিশ্বকাপের আগে এ প্রশ্নের উত্তরটা এমন সহজই ছিল। কিন্তু লর্ডসের সেই ফাইনাল দিগন্ত উন্মোচনকারী এক তথ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সবাইকে। জানিয়ে দিয়েছে, ফাইনালে না জিতেও বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়। সে জন্য বেশি চার মারলেই হয়!
এবার অবশ্য আর তা হবে না। এরই মধ্যে আপনার জেনে যাওযার কথা, এবার ফাইনাল টাইয়ে শেষ হওয়ার পর সুপার ওভারও টাইয়ে শেষ হলে আরেকটি সুপার ওভার হবে। সেটিও টাই হলে আরেকটি। মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এমন চলতেই থাকবে।
ফুটবলে নকআউট ম্যাচ ‘টাই’ (পড়ুন ড্র) হয়ে গেলে তা ‘ব্রেক’ করার মাধ্যম হিসেবে পেনাল্টি শুটআউটের প্রবর্তন খেলাটা শুরুর অনেক পরে। গত শতকের সত্তরের দশকে। ক্রিকেটও অনেক বছর এমন কিছুর প্রয়োজন দেখেনি। টি-টোয়েন্টি না এলে হয়তো দেখতও না। টি-টোয়েন্টির প্রথম চাওয়া স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা, দ্বিতীয় চাওয়া আরও স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা...একমাত্র চাওয়াও তা-ই। একটা ম্যাচ শেষ হবে, আর দুই দলের কোনোটিই উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে সমান তৃপ্তি নিয়ে হাত মেলাবে—এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কি টি-টোয়েন্টির সঙ্গে যায় নাকি! সুপার ওভার বস্তুটার উদ্ভাবন এ কারণেই। টি-টোয়েন্টি থেকে পরে যা ওয়ানডেতে রপ্তানি করা হয়েছে।
২০১৯ ফাইনালের আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেরা ম্যাচ হিসেবে মোটামুটি সর্বজনীন স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেই এজবাস্টন সেমিফাইনাল। একবার ভেবে দেখুন তো, তখন সুপার ওভার থাকলে ওই ম্যাচটা কি এমন মহিমান্বিত হতো! ম্যাচ টাই হওয়ার পরও বিশ্বকাপে এর আগে দুই দল কী করেছে, সেই বিবেচনায় দক্ষিণ আফ্রিকার ছিটকে পড়াটাই না গল্পটাকে অমন ট্র্যাজিক বানিয়েছিল। সেই বিবেচনাও কী সূক্ষ্মতম! আপনি অবশ্য বলতেই পারেন, সুপার ওভার থাকার পরও তো ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল এক দলের জন্য ট্র্যাজিক গল্পই হয়ে আছে। এজবাস্টন সেমিফাইনালে সুপার ওভার থাকলে সেটিও টাই হতো কি না, কে বলতে পারে!
একবার যখন হয়েছে, সেই সম্ভাবনা একদমই ছিল না—এটা কীভাবে বলি! যদিও ২০১৯ ফাইনালের পর থেকে আমার শুধু মনে হয়, আর কি কখনো এমন কিছু দেখব আমরা! ম্যাচের পর সুপার ওভারও টাই—প্রবাবিলিটির হিসেবে তা হওয়ার চান্স কতটুকু? চার কম-বেশি মারার হিসাবে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হওয়ার চেয়ে হাস্যকর আর কিছু হয় না। তবে কেউ যে এমনও হতে পারে ভেবে বুদ্ধি করে বাইলজে ‘সুপার ওভারও টাই হলে...’ বিধানটা রেখেছিলেন, এটা ভেবেই তো একটু অবাক লাগে।
সুপার ওভার নিয়ে কথা বলতে বলতে লেখার মূল বিষয়টাই দেখি হারিয়ে যেতে বসেছে। সেটা যেন কী ছিল? ও হ্যাঁ, এবারের বিশ্বকাপ জিতবে কোন দল? আসলে মনে ছিল রে, ভাই। কোনো প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিতে না চাইলে এটা-ওটা বলে সেটিকে এড়িয়ে যাওয়ার এই কৌশল নিশ্চয়ই আপনিও অনেকবার প্রয়োগ করেছেন। বিশ্বকাপের আগে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী অনেক করেছি। ফুটবল-ক্রিকেট দুটি নিয়েই। কখনো তা মিলে গেছে, কখনো মেলেনি। মেলা না–মেলার মধ্যে কোনটার অংশ বেশি, সেই হিসাব করতে সময় লাগবে। এটা তো আর এক-দুই বিশ্বকাপের ব্যাপার নয়। শুধুই যখন দর্শক, বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় ভবিষ্যদ্বাণী তো ছাত্রজীবন থেকেই করে আসছি। সেসব বাদ দিলেও সাংবাদিকজীবনে পত্রিকায় লিখে সবাইকে তা জানিয়ে দেওয়ার ঝুঁকিও তো নিয়ে যাচ্ছি তিন দশকেরও বেশি। যেটির শুরু ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপ দিয়ে।
সেবার আমি কী বলেছিলাম? অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের সেই বিশ্বকাপ ৩১ বছর আগের কথা। আপনি যদি সেই বিশ্বকাপের স্মৃতি মনে করতে পারেন, তাহলে আপনার বয়স চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে। অন্তত চল্লিশ ছুঁই ছুঁই তো অবশ্যই। এই দলে থেকে থাকলে এটাও আপনার মনে থাকার কথা, সেই বিশ্বকাপে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দ্বিতীয় কোনো দেশের নাম বলার কোনো উপায় ছিল না।
সেটি শুধু অস্ট্রেলিয়া ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ছিল বলে নয়। অস্ট্রেলিয়ার ১৯৮৭ বিশ্বকাপ জয় তো ছিল বড় এক চমক। চার বছর আগে কপিলস ডেভিলসের রূপকথা অবশ্যই বিশ্বকাপের চমকের স্কেলে সবচেয়ে ওপরে। তবে উপমহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া ইডেনে শিরোপা উৎসব করবে, এটা কেউ আগে থেকে ভেবেছিলেন বলে দাবি করলে তা বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বকাপ জয় ট্রফি আর অর্থ পুরস্কারের বাইরেও আরেকটা জিনিস দেয়। আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়েই কি না, এরপর ওয়ানডেতে দুর্দমনীয় এক শক্তি হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। এতটাই যে ১৯৯২ বিশ্বকাপের আগেই পারলে ট্রফিটা সবাই বোর্ডারের হাতে তুলে দেন, এমন অবস্থা। নিজেদের দেশে খেলা, এটাও একটা বাড়তি পয়েন্ট ছিল।
হট ফেবারিট বলতে যে একটা কথা আছে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এটার প্রয়োগ এরপর আর সেভাবে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। সেই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার মুখ থুবড়ে পড়াই সম্ভবত একটা তত্ত্বকে জোরালো ভিত্তি দেয়। তা হলো, স্বাগতিকেরা কখনো বিশ্বকাপ জেতে না। ২০১১ বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত এই তত্ত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। শ্রীলঙ্কার কথা বলবেন তো? ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা যৌথ আয়োজক ছিল বটে, তবে তা নামমাত্রই। কয়টা ম্যাচই আর নিজেদের দেশে খেলেছে তারা!
এখন আবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অন্য ‘নিয়ম’। ২০১১ বিশ্বকাপে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের জয়োৎসব দিয়ে শুরু ধারা অনুসরণ করেছে পরের দুটি বিশ্বকাপও। চার বছর পর মেলবোর্নে ট্রফি হাতে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, পরের বিশ্বকাপে লর্ডসে ইংল্যান্ড। এবার তো তাহলে হিসাবটা খুব সহজ। ভারতে খেলা, ভারতই বিশ্বকাপ জিতবে।
তবে বিশ্বকাপ কি আর এমন নিয়ম মেনে চলে! ভারতের যে দল, তাতে বিশ্বকাপ তারা জিততেই পারে। তা দলীয় শক্তির কথা বললে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানকেই–বা পিছিয়ে রাখবেন কীভাবে! বিশ্বকাপে যারা সব সময়ই নিজেদের ছাড়িয়ে যায়, সেই নিউজিল্যান্ডকে? বিশ্বকাপকে যারা দুঃখের প্রতিশব্দ বানিয়ে ফেলেছে, সেই দক্ষিণ আফ্রিকার গল্পটাও তো একদিন না একদিন অন্যভাবে লেখা হবে।
কথায় কথায় যে দলগুলোর নাম বলে ফেললাম, ১৯ নভেম্বর রাতে আহমেদাবাদে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়াম এর বাইরের কোনো দলকে বিজয়ানন্দে হাসতে দেখবে বলে কল্পনা করা যাচ্ছে না। এটা পড়ার পর আপনার প্রতিক্রিয়াটা অনুমান করতে পারছি। একটু হয়তো বিরক্তও হয়েছেন। এটা বলার জন্য এত প্যাঁচাল পাড়ার অর্থ কী? এটা কে না জানে!
ভবিষ্যদ্বাণীর একটা অন্য ধরনও একসময় বের করে ফেলেছিলাম। কোন দল জিতবে, তা বলার বদলে কোন কোন দল জিতবে না বলে দেওয়া। এখানে তেমন দলের সংখ্যা পাচ্ছি চার। নাম বলার দরকার দেখছি না, ওপরের দুই প্যারা পড়ার পর আপনিই তা বলে দিতে পারবেন।
কিন্তু চ্যাম্পিয়ন কে হবে, তা বলে ফেলা এত সহজ নয়। ৪৪ কোটি টাকার প্রশ্ন বলে কথা!