তানজিদ কথা রাখায় আরেক ‘তামিম’কে পাচ্ছে বাংলাদেশ
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের দলবদল চলছিল। সিসিডিএম কার্যালয়ে দলবদলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তানজিদ হাসান। এমন সময় তানজিদের দল ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্রিকেটাররা তাঁকে ডাকলেন। দলবদল শেষে ছবি তোলার আনুষ্ঠানিকতার জন্য। তানজিদকে তখন আত্মভোলা মনে হচ্ছিল। সতীর্থদের সঙ্গে কয়েক মিনিট সময় কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন সিসিডিএম থেকে।
তখন হাতের চোটের সঙ্গে লড়াই করছিলেন এই বাঁহাতি ওপেনার। আগের মৌসুমটা একদমই ভালো যায়নি। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের হয়ে ২০২২ সালের প্রিমিয়ার লিগে ৯ ম্যাচ খেলে ৮ ইনিংসে করেছেন মাত্র ১১৯ রান। এমন পারফরম্যান্সের পর চোটের সঙ্গে লড়াই মিলিয়ে তানজিদের সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। যেতে যেতে এ নিয়েই হতাশা প্রকাশ করছিলেন ২২ বছর বয়সী এই তরুণ।
কিন্তু তানজিদের হতাশা খুব দ্রুতই প্রতিজ্ঞায় রূপ নিয়েছিল। ভাগ্য বদলানোর জন্য একটা মৌসুমই যথেষ্ট, বারবার তা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। নিজের সামর্থ্যে এতটাই আস্থা ছিল এই তরুণের। সেই আস্থা পারফরম্যান্সেও পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে এবার প্রিমিয়ার লিগে তানজিদ ১১ ম্যাচ খেলেন। ২টি সেঞ্চুরি, ১টি ফিফটিসহ রান করেছেন ৪৭৪। স্ট্রাইক রেট ৯৩.৩০।
কদিন আগে হয়ে যাওয়া ইমার্জিং এশিয়া কাপেও ছিলেন বাংলাদেশ ‘এ’ দলের সেরা ব্যাটসম্যান। শ্রীলঙ্কায় হয়ে যাওয়া সে টুর্নামেন্টে ৪ ম্যাচে ১৭৯ রান করেছেন তানজিদ, তাতে ফিফটি ৩টি, স্ট্রাইক রেট ১১৬.৯৯।
তানজিদের ভাগ্য সত্যিই বদলে গেল এক মৌসুমে। ইমার্জিং এশিয়া কাপের পারফরম্যান্সের সৌজন্যে তানজিদ প্রথমবারের মতো জায়গা করে নিলেন জাতীয় দলে। সেটাও এশিয়া কাপের মতো মঞ্চে।
তবে তানজিদের জাতীয় দল পর্যন্ত আসার পথটা কিন্তু মসৃণ ছিল না। বগুড়ার এই ছেলেকে ক্রিকেট খেলতে লড়তে হয়েছে বাবার সঙ্গে। তানজিদের বাবা তোজাম্মেল হোসেন বগুড়ার সোনাতলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক। সরকারি চাকরিজীবীর ছেলে যেহেতু, ছেলে পড়াশোনা করে পেশা হিসেবে চাকরিকে বেছে নেবে—তানজিদকে নিয়ে তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল এমনই।
কিন্তু তানজিদ স্বপ্ন দেখেছেন ক্রিকেট নিয়ে। এতটাই যে তানজিদের ক্রিকেট খেলার নেশার কারণে বাবা তাঁকে বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তানজিদের মা রেহেনা বেগম অবশ্য ছেলের স্বপ্নটা দেখেছেন, বুঝেছেন। মায়ের হাত ধরেই প্রথমবারের মতো বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে গিয়েছিলেন তানজিদ। খেলা নিয়ে মায়ের সমর্থন থাকলেও শর্তও ছিল। ক্রিকেট খেলতে হলে তানজিদকে পড়াশোনায় ভালো করতে হবে।
তানজিদ সে শর্তটা পূরণ করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে। এখন পড়ছেন ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে (এআইইউবি)।
পড়াশোনার পাশাপাশি তানজিদের ক্রিকেটযাত্রাও এগিয়েছে তরতরিয়ে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ দলে তাঁর সুযোগ হয়ে যায়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে দুটি সেঞ্চুরি করে আলোচনায় আসেন।
পরের বছর একই ক্লাবের হয়ে ১৩ ম্যাচে ৩৭১ রান করেন। তানজিদের বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা হয়ে যায় এই পারফরম্যান্সের সৌজন্যে। দুই বছর পর তানজিদদের সেই দলটাই জিতেছে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ। সে দলটার অধিনায়ক আকবর আলীকে বেশ কয়েকবার বলতে শুনেছি, ‘সে অন্য রকম ক্রিকেটার। ভালো বল মারার ক্ষেত্রে তার যে সামর্থ্য, সেটা আমাদের দলে খুব কম ক্রিকেটারের আছে।’
এই দক্ষতায় তানজিদের সঙ্গে মিল আছে তামিম ইকবালের। প্রতিপক্ষের সেরা বোলারকে মেরে খেলার কাজটা তামিম করে এসেছেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকে। মজার ব্যাপার, তানজিদের ডাকনাম তামিম। তামিমের মতো তানজিদও বাঁহাতি, দুজনই ওপেন করেন। এবার তানজিদ জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন তামিম জাতীয় দলে না থাকায়। চোটের কারণে তিনি এবারের এশিয়া কাপ খেলছেন না। কিন্তু তামিম ছাড়া বাংলাদেশ দল হয় নাকি! একজন তামিম তো থাকা চাই। তানজিদই এবার সে শূন্যতাটা পূরণ করবেন।