স্থপতি, উইকেটকিপার, পেসার, অভিনেতা থেকে রহস্য স্পিনার
বরুণ চক্রবর্তী জানতেন, তিনি ফিরবেন। আইপিএলের গত মৌসুমের দুর্দশা কাটিয়ে আবার স্বরূপে জ্বলে উঠবেন। সে কারণেই এবারের আইপিএল শুরুর আগে বেশ গর্ব করেই বলেছিলেন—‘ক্যারিয়ারের কোনো সময়ে এমন একটা বাজে মৌসুম আমি প্রত্যাশা করছিলাম। সবাই খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়, কিন্তু ফিরে আসাটাই গুরুত্বপূর্ণ।’
গুরুত্বপূর্ণ সেই কাজটা বরুণ করেছেন। ২০২২ সালে ১১ ম্যাচ খেলে ৬ উইকেট নেওয়া বরুণ কলকাতার একাদশ থেকে বাদও পড়েছিলেন। তবে বাদ পড়া সেই বরুণই এবার সেই দলের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এই রহস্য স্পিনারের কারণেই অনেকটা এই আসরে টিকে আছে কলকাতা।
এবারের আইপিএলে এখন পর্যন্ত ১৩ ম্যাচ খেলে বরুণ উইকেট নিয়েছেন ১৯টি। এই মৌসুমে আইপিএলে যা চতুর্থ সর্বোচ্চ। স্পিনার হয়েও এই আইপিএলে ডেথ ওভারে বোলিং করেছেন। এমনকি শেষ ওভারে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে ৯ রানের সমীকরণে বোলিং করতে এসেও দলকে জিতিয়েছেন।
নিজেদের সর্বশেষ ম্যাচে চেন্নাইকে হারানোর পথেও নিয়েছেন ২ উইকেট। ফিরিয়েছেন টপ অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যান রুতুরাজ গায়কোয়াড় ও অজিঙ্কা রাহানেকে। এই দুই উইকেটের প্রভাব ম্যাচে এতটাই পড়েছে যে সংবাদ সম্মেলনে চেন্নাই কোচ স্টিভেন ফ্লেমিং বরুনের কথা না বলে পারেননি।
বরুণের সঙ্গে চেন্নাইয়ে সম্পর্কটা বেশ পুরোনো। আইপিএলে বরুণের শুরুটা এই চেন্নাইয়ের হাত ধরে, যদিও নেট বোলার হিসেবে। সে সময়ে নেটে বরুণ কতটা চেন্নাই ব্যাটসম্যানদের ভোগাতেন, সেটা তো স্পষ্ট চেন্নাই কোচের কথাতে, ‘এটা এখনো আমাদের কষ্ট দেয় (বরুণকে না নেওয়া)। সে নেটে কয়েক বছর ধরে আমাদের ব্যাটসম্যানদের যন্ত্রণা দিত। তবে নিলামে আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি।’
এক মৌসুম খারাপ করার পর ফিরে আসার বার্তাটা হয়তো বরুণ নিজের জীবন থেকেই পেয়েছেন। কারণ, বরুণের জীবনও তো কম রহস্যময় নয়। বরুণের সেই রহস্যময় জীবনের গল্পটাও কিছুটা শোনা যাক।
বরুণের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু ১৩ বছর বয়সে। আজকের এই রহস্য স্পিনার তখন ছিলেন উইকেটকিপার। হতে চাইতেন দিনেশ কার্তিকের মতো। তবে কিপিং গ্লাভস হাতে দলে খুব একটা সুযোগ পেতেন না। রাজ্য দলে বেশ কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বরুণ পরে ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ক্রিকেট ছেড়ে বরুণ মন দেন পড়াশোনায়। চেন্নাইয়ে এসআরএম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে ডিগ্রিও নিয়েছেন। ২০১৭ সালে স্থাপত্য ফার্মও খুলেছিলেন। তবে চেন্নাইয়ে বন্যায় তাঁর একটি প্রজেক্ট ভেসে গিয়েছিল। মজার একটা তথ্য না দিলেই নয়, এর আগে সিনেমায় সহকারী পরিচালকও হতে চাইতেন বরুণ। ২০১৪ সালে ‘জিভা’ নামে এক তামিল সিনেমাতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
সময় গড়ানোর সঙ্গে বরুণ বুঝতে পেরেছিলেন, এই জায়গা আসলে তাঁর জন্য নয়। বরুণ এরপর আবার ক্রিকেটে ফেরেন। এবারে ফেরেন পেসার হিসেবে।
কিন্তু বরুণকে আবারও হতাশ হতে হয়। চোটের কারণে পেসার হিসেবে মাত্র দুই ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।
চোটই মূলত পেসার বরুণকে পরিণত করেন স্পিনার হিসেবে। খুব বেশি আগের কথা নয়, ২০১৮ সালে চেন্নাই লিগের চতুর্থ ডিভিশনে জুবিলি ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেন স্পিনার হিসেবে। সেই থেকে শুরু। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৮.২৬ গড়ে, ৩.০৬ রান রেটে তুলে নিলেন ৩১ উইকেট।
এরপর তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগেও দুর্দান্ত খেলেন এই স্পিনার। ডাক আসে আইপিএলের নেটে। ২০১৯ সালে আইপিএল নিলামে ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে তাঁকে কেনে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। সেখানেও ভালো করতে পারেননি বরুণ। আইপিএল পাঞ্জাবের হয়ে নিজের প্রথম ওভার বল করতে এসেই রান দেন ২৫। সেই মৌসুমে ওই এক ম্যাচই খেলেন বরুণ।
এরপর কলকাতায় টানা দুই মৌসুমেই সফল হওয়ার পর ডাক পান ভারতীয় দলে। তবে ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি বরুণ। এরপর ২০২২ সালের ওই খারাপ সময়টাকে পার করে বরুণ আবারও ছন্দে ফিরেছেন।
বরুণ কত দিন এই ছন্দ ধরে রাখতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়। ছন্দ যদি একটু পড়ে যায়, তাতেও–বা কী! বরুণ যে ফিরতে জানেন।