ইনিংসের প্রথম ওভারেই একটা বড় উপলক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে গেল বেলেরিভ ওভাল। প্রথম দুই বলে তাসকিন আহমেদ ফিরিয়ে দিলেন ডাচ ওপেনার বিক্রমজিৎ সিং ও বাস ডি লিডিকে। হ্যাটট্রিকটা কি তাহলে হয়েই যাবে তাসকিনের!
হয়নি, তবে হোবার্টের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে নেদারল্যান্ডসের ইনিংসটাকে শুরুতেই নাড়িয়ে দিয়ে তাসকিন যেন এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শুরুর চিত্রনাট্যটাই নতুন করে লিখলেন। নইলে সাদামাটা ওলন্দাজ বোলিংয়ের সামনেও বাংলাদেশের ১৪৪ রানের বেশি করতে না পারা হতাশার সলতেতে আগুন দিচ্ছিল বলে।
তাসকিনের দুই ধাক্কার পর ইনিংসের চতুর্থ ওভারে এক বলের ব্যবধানে নিজেরাই নিজেদের বিদায়ের পথ বেছে নেন নেদারল্যান্ডসের দুই ব্যাটসম্যান ম্যাক্স ও’ডাউড এবং টম কুপার। এক বলের ব্যবধানে দুজনই প্রান্ত ছুঁতে না পেরে রানআউট। বাংলাদেশের ১৪৪ রানটাও তখন নেদারল্যান্ডসের কাছে পাহাড়ি হোবার্টের সর্বোচ্চ চূড়া ওয়েলিংটন মাউন্টেনইনের মতোই উঁচু মনে হয়ে থাকবে।
মেঘলা দিনেও মসৃণ পাহাড়ি পথে গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে ঠিকই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২৭১ মিটার উচ্চতার ওয়েলিংটন মাউন্টেনের চূড়ায় উঠে যাওয়া যায়। কিন্তু চার ওভারের মধ্যে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর বাংলাদেশের ১৪৪ রানের চূড়া আর ছোঁয়া হয়নি ডাচদের। বিপর্যয় সামলাতে কলিন অ্যাকারমান ও অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস মিলে এরপর ৭ ওভার ৫ বলে ৪৪ রানের যে জুটি গড়লেন, সেটি দেখে মনে হচ্ছিল, জয় নয়; অলআউট না হওয়াটাই লক্ষ্য নেদারল্যান্ডসের। কিন্তু সে লক্ষ্যও সফল হয়নি। ৯ রানে হারের ম্যাচে শেষ বলে অলআউট হয়েছে নেদারল্যান্ডস।
বিশ্বকাপে আসার আগে যতই ঝোড়ো সময় পার করুক বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় অপ্রত্যাশিত ছিল না। ভয় ছিল শুধু পচা শামুকে পা কাটার। যদি খারাপ সময় থেকে এই সুযোগেও বের না হতে পারে বাংলাদেশ! এরকম ক্ষেত্রে ছোট সাফল্যও বড় আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে ওঠে। দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার আনন্দ। বেলেরিভ ওভালে আজ সাকিব-তাসকিনরা যেন সে আনন্দেই ভাসছিলেন বারবার।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে মাঝের দুটি জয় বাদ দিলে টি-টোয়েন্টিতে জয় পাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য অসম্ভব কল্পনা হয়েই দাঁড়িয়েছিল। ক্রাইস্টচার্চের ত্রিদেশীয় সিরিজের পর প্রস্তুতি ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষেও লড়াই না করে হার আত্মবিশ্বাস ঠেকিয়েছিল তলানিতে। সেখান থেকে বিশ্বকাপে নাক ভাসিয়ে চলতে প্রথম ম্যাচে জয়ের বিকল্প ছিল না। আজ কাঙ্ক্ষিত সেই জয়ের পথে পথে নেদারল্যান্ডসের প্রতিটি উইকেট পতনেই বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা যেরকম উৎসবে মেতে উঠছিলেন, মনেই হয়নি প্রতিপক্ষ দলটার নাম নেদারল্যান্ডস। মনে হচ্ছিল ভারত, পাকিস্তান বা দক্ষিণ আফ্রিকা বুঝি!
কিন্তু বোলারদের সৌজন্যে শেষ পর্যন্ত জয়ের মুখ দেখা গেলেও ব্যাটিং নিয়ে হতাশাটা কি এই ম্যাচের পরও থেকে গেল না! টি-টোয়েন্টি বাংলাদেশ একটু খারাপ খেলতেই পারে। চার-ছক্কা মারার পাওয়ার হিটার তাদের না-ই থাকতে পারে। ‘ইন্টেন্টে’ ‘ইমপ্যাক্ট’ খুঁজতে খুঁজতে টিম ম্যানেজমেন্ট হয়রান হতেই পারে। ওপরকে নিচ এবং নিচকে ওপর বানিয়েও শেষ পর্যন্ত একটা ভালো ওপেনিং জুটি খুঁজে না-ই পাওয়া যেতে পারে। তাই বলে নেদারল্যান্ডসের নির্বিষ বোলিংয়ের সামনেও অর্ধেকটা পথ ওরকম ব্যাটিং কেন!
পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে ইয়াসির আলীর ফিরে যাওয়া পর্যন্ত ইনিংস যেভাবে এগোচ্ছিল, এরপর আফিফ হোসেন (২৭ বলে ৩৮) আর মোসাদ্দেক হোসেনের (১২ বলে ২০*) ব্যাটিংটা না হলে বাংলাদেশের ইনিংসের চেহারা কী রকম দাঁড়াতো একবার কল্পনা করুন। ১১তম ওভারের শেষ বলে ইয়াসিরের আউটটা যে ছিল মাত্র ৭৬ রানের মাথায়!
ইনিংসের প্রথম ওভারেই সৌম্য সরকারের দুই চার, চতুর্থ ওভারে পর পর দুই বলে আরেক ওপেনার নাজমুল হোসেনের দুই চারে ইতিবাচক শুরুই হয়েছিল। কিন্তু দুই ওপেনারই ফিরে যান পর পর দুই ওভারে দুই নতুন বোলারের প্রথম বলে। এরপর কি এক অজানা তাড়াহুড়ায় ১১তম ওভার পর্যন্ত শুধুই স্নায়ুচাপে ভোগা। খারাপ সময়ের বৃত্তেই তবেই থেকেই যাচ্ছে বাংলাদেশ!
কর্মদিবসেও বেলেরিভ ওভালে হাজির হয়েছিল কয়েকশ প্রবাসী দর্শক। সিডনি-মেলবোর্নের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার এই দিকটায় বাংলাদেশিদের বাস কম বলে ওই সংখ্যাটাই অনেক। তার মধ্যে অনেকে আবার অন্য শহর থেকেও এসেছেন। সিডনি থেকেই যেমন বাংলাদেশ দলকে উৎসাহ দিতে এসেছে ২৫ জনের একটা দল।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সময় বারবার তাদের হতাশ মুখগুলোই টিভি পর্দায় ভেসে উঠলেও শেষ পর্যন্ত জয় দেখার আনন্দ নিয়েই ফিরতে পেরেছেন তাঁরা। বাংলাদেশ দলও কাল সিডনির বিমানে উঠবে আত্মবিশ্বাসের পারদ কিছুটা উঁচুতে তুলে। তাদের সমর্থন জোগাতে ২৭ অক্টোবর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গ্যালারি নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি লাল-সবুজ হয়ে উঠবে। অবশ্য সেদিন প্রতিপক্ষও বড় বাংলাদেশের—দক্ষিণ আফ্রিকা।
নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নড়বড়ে শুরুর পরও পার পাওয়া গেছে। বিশ্বকাপের মঞ্চে বড় দলগুলো হয়তো সে সুযোগ দেবে না বাংলাদেশকে। সাকিবরা তাহলে তাদের কথাই সত্যি করে দেখান এবার। একটা জয়ই তো নাকি বদলে দিতে পারে সবকিছু। আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার সেই জয়টা যখন এসেই গেছে, বিশ্বকাপেই বাংলাদেশ দেখাক তাদের বদলে যাওয়া টি-টোয়েন্টি রূপ।