‘টোটাল ফুটবল’ খেলছেন সাকিবরা
টোটাল ফুটবল—ফুটবল নিয়ে মোটামুটি জানাশোনা আছে, এমন যে কারও টার্মটি জানার কথা। ১৯৭০-এর দশকে ফুটবল–জগতে রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল এই কৌশল।
ডাচ ক্লাব আয়াক্স প্রথমে এই কৌশলে খেলতে শুরু করেছিল, যার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ডাচ কোচ রাইনাস মিশেলস। যে খেলোয়াড়টি মিশেলসের এই কৌশল বাস্তবায়নের পথে প্রাণভোমরা ছিলেন, তিনি কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে মিশেল-ক্রুইফ যুগলবন্দিতে এই কৌশলে খেলে সবাইকে চমকে দিয়েছিল নেদারল্যান্ডস।
সহজ কথায় টোটাল ফুটবলের মূল সূত্র, গোলরক্ষক ছাড়া কারও পজিশনই নির্দিষ্ট নয়। রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড় যেমন আক্রমণভাগে গিয়ে খেলতে পারেন, তেমনি এর উল্টোটাও হতে পারে। পজিশন বদলে খেলার এই কৌশলে দারুণভাবে বাজিমাত করে আয়াক্স ও নেদারল্যান্ডস।
বিশেষ করে এই কৌশলে আয়াক্স রীতিমতো ইউরোপিয়ান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। টানা ম্যাচ জেতা কিংবা একের পর এক শিরোপা জেতা তেমন কিছুরই সাক্ষ্য দেয়। ’৭৪ বিশ্বকাপে এই কৌশলের সফল ব্যবহার করে শিরোপা জিততে না পারলেও ফাইনালে ঠিকই খেলেছিল নেদারল্যান্ডস। বিশ্বকাপ না জিতলেও এখনো প্রশংসিত হয় ডাচদের সেই দলটির খেলা। এখনো নানাভাবে বিবর্তিত হয়ে টোটাল ফুটবল টিকে আছে। সেটা অন্য আলাপ।
কথা হচ্ছে, এই টোটাল ফুটবলের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্পর্ক কোথায়? যেখানে দুটি খেলা একদমই আলাদা। কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা হয়েও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলা মনে করিয়ে দিচ্ছে টোটাল ফুটবলকে।
কীভাবে? বলছি। টোটাল ফুটবলে যেমন কোনো খেলোয়াড়ের নির্দিষ্ট পজিশন নেই, বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ দলের চিত্রও যেন ঠিক তা-ই!
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের খেলা ৪ ম্যাচে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হবে সে চিত্র। তবে আরেকটু দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে তাকালে বোঝা যায়, এই ভাবনার শুরুটা বিশ্বকাপের আগেই হয়েছে। যেদিন তামিম ইকবালকে মিডল অর্ডারে ব্যাট করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সম্ভবত সেদিন থেকে। ‘টোটাল ক্রিকেট’ খেলতে রাজি না হওয়ায় তামিমকে ছাড়াই বিশ্বকাপ খেলছে বাংলাদেশ। তবে তামিম না গেলেও বাংলাদেশ কিন্তু এই নীতি থেকে সরে আসেনি। প্রায় প্রতি ম্যাচেই দেখা গেছে ‘টোটাল ক্রিকেট’–এর প্রয়োগ। শুরুটা হয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজকে দিয়ে।
এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওপেনিংয়ে নেমে সেঞ্চুরি করে আলোচনায় আসেন মিরাজ। লম্বা সময় মিরাজের ব্যাটিং–সত্তার খবর না রাখলেও বিশ্বকাপের আগে এবং বিশ্বকাপেও তাঁকে ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ রীতিতে খেলানো শুরু করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার ব্যাটিং পজিশন ছিল ৩ নম্বরে। পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেললেন ৫ নম্বরে। এরপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁকে আবার খেলানো হলো তিনে। আর গতকাল ভারতের বিপক্ষে খেলানো হলো চারে। অর্থাৎ, বিশ্বকাপে এখনো টানা একই পজিশনে খেলার সুযোগ পাননি মিরাজ।
বারবার পজিশন বদলানোর সুফলও মেলেনি। যা হয়েছে, সেটা হলো ছন্দ হারিয়েছেন মিরাজ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফিফটি করা মিরাজ পরের তিন ম্যাচে করলেন ৮, ৩০ এবং ৩। আর একজন খেলোয়াড়ের জায়গা বদলানো মানে নিশ্চিতভাবেই বাকিদের জায়গাও বদলেছে, যাকে বলে ‘ডমিনো ইফেক্ট’। যে ইফেক্ট তথা প্রভাব পড়েছে পারফরম্যান্সও। বিশ্বকাপের আগে যেসব ব্যাটসম্যানকে ছন্দে আছেন মনে হয়েছিল, সেই নাজমুল হাসান শান্ত কিংবা তৌহিদ হৃদয়ও হারিয়েছেন ছন্দ।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র জেতা ম্যাচে চার নম্বরে খেলে অপরাজিত ফিফটি করা শান্ত পরের তিন ম্যাচে করেন ০, ৭ এবং ৮। একই অবস্থা তৌহিদ হৃদয়েরও। প্রথম ম্যাচে ছয় জন ব্যাটসম্যান মাঠে নামলেও নামার সুযোগ হয়নি হৃদয়ের।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাতে নেমে করলেন ৩৯। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও সাতে খেলে করেন ১৩। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে তাঁকে তুলে আনা হলো পাঁচে। কেউ কেউ চাইলে সাকিব আল হাসান না থাকায় তাঁর ব্যাটিং পজিশন বদলানোর কথা বলতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আগের তিন ম্যাচেই তাঁর পজিশন ছিল মুশফিকের পরে। কিন্তু হঠাৎ করেই গতকাল তাঁকে তুলে আনা হলো মুশফিকের ওপরে।
ডানহাতি–বাঁহাতি সমন্বয়ের যুক্তিও এখানে খাটে না। দুজনই যেহেতু ডানহাতি ব্যাটসম্যান। তবে টিম ম্যানেজমেন্টের নিশ্চয় কোনো যুক্তি থাকবে। ব্যাটিং অর্ডারে ওপেনিং বাদ দিলে শুধু মুশফিকই একই পজিশনে চার ম্যাচ খেলেছেন। বাংলাদেশের প্রতি ম্যাচে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে কদিন আগে বিরক্ত ভারতের কিংবদন্তি স্পিনার অনিল কুম্বলে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপে আপনি যখন খেলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনাকে স্থিতিশীল সমন্বয়ের মধ্যে থাকা উচিত। সেটা বিশ্বকাপের আগেই হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু আপনি যদি বিশ্বকাপে এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন, তবে সেটা অনেক মুশকিলের ব্যাপার।’
বাংলাদেশ এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন করছে, তা বুঝতে পারছেন না জানিয়ে কুম্বলে বলেছিলেন, ‘তানজিদ বিশ্বকাপে দুই ম্যাচে ওপেন করেছে। অথচ তামিম ইকবাল অনেক অভিজ্ঞ ওপেনার। তাকে না নিয়েই চলে এসেছে তারা। তাকে বলা হলো, খেলতে হলে মিডল অর্ডারে খেলতে হবে। অন্য দিকে মেহেদী হাসান মিরাজ ওপেনিংয়ে এসে সেঞ্চুরি করল। এরপর আগের ম্যাচ তাকে দেখলাম ৫ নম্বরে খেলতে। বুঝতে পারছি না দলটায় কি হচ্ছে! ওরা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। আপনি যদি বিশ্বকাপেই এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তবে সমস্যায় পড়তে হবে।’
ভারতের বিপক্ষে হারের পর পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ওয়াসিম আকরামও বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আপনার মিডল অর্ডারে যখন এত সমস্যা, তখন আপনার সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এত নিচে ব্যাটিং করে! মাহমুদউল্লাহ কেন ৭-৮ নম্বরে ব্যাট করবে? তার টেকনিক ভালো, অভিজ্ঞও। বুঝলাম সে ফিনিশার। কিন্তু ফিনিশারের প্রয়োজন তখন পড়বে, যখন আপনার মিডল অর্ডার কাজ করে।’
শুধু ব্যাটিংয়েই নয় অদল-বদল ঘটেছে বোলিংয়েও। প্রায় সব দলই যেখানে শুরুর দুই বোলারে অপরিবর্তিত রেখেছে, সেখানে বাংলাদেশ প্রায় প্রতি ম্যাচেই দেখেছে আলাদা আলাদা সমন্বয়। বোলিংয়ের ক্ষেত্রে উইকেটের কিংবা প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তার তারতম্যের কথা আসতে পারে। কিন্তু সেটাও দেখা যাচ্ছে শুধু বাংলাদেশের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। ভারত, পাকিস্তান কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলো ইনিংসের শুরুতে একই বোলারদের ওপরই আস্থা রেখেছে। এমনকি টানা দুই হারের পরও অস্ট্রেলিয়া নিজেদের ‘বেসিক’ থেকে সরে আসেনি।
কে জানে, হয়তো ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভাবনা থেকেই চন্ডিকা হাথুরুসিংহে-সাকিব আল হাসানদের এমন ‘টোটাল ক্রিকেট’। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেওয়াটা পূর্বশর্ত। পজিশন বদলে খেলানো মানে ভিন্ন একটি পজিশনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এবং সেখানে নিজেকে মেলে ধরা। তাই শুধু বাজি ধরলেই হয় না, সেটা বাস্তবায়নের সামর্থ্যও লাগে।
সেই সামর্থ্যটা আসলে কেমন, টোটাল ফুটবলের নেপথ্য–নায়ক ক্রুইফের মুখ থেকেই শোনা যাক। আত্মজীবনী ‘মাই টার্ন’–এ ক্রুইফ লিখেছেন, ‘আমি বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি এবং শুনেছি, লোকজন জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ দেখে ভাবছে, আমাদের খেলার ধরন হচ্ছে ফাটকা। এটা অগ্রহণযোগ্য। ওই সময় ডাচ দলে যারা খেলত, তারা গড়পড়তা নয়, বরং অস্বাভাবিকভাবে ভালো। ওরা দুর্দান্ত।’
যখন ‘আউট অব দ্য বক্স’ পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হয়, তখন সেটাকে সফল করতে তেমন দক্ষতা ও সামর্থ্যের প্রয়োজন হবে। নইলে দিন শেষে তা শুধুই ফাটকা!