র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে ঢোকার পথটার পাশে একটু পরপরই হোর্ডিং। হোটেলের নিচতলার বিশাল বলরুমেও যা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। এর মধ্যে কয়েকটায় জন্মদিনের শুভেচ্ছাবাণী: হ্যাপি বার্থডে সাকিব আল হাসান। ৩৬তম জন্মদিন উপলক্ষে সকাল থেকেই দেশ-বিদেশ থেকে আসা শুভেচ্ছায় সিক্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। আজ বিকেলে র্যাডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানটার সঙ্গে অবশ্য সাকিবের জন্মদিনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। জন্মদিনের প্রসঙ্গটা এসেছে কাকতালীয়ভাবে দিনটি মহতী একটা উদ্যোগের যাত্রা শুরুর দিনের সঙ্গে মিলে যাওয়ায়।
সেই মহতী উদ্যোগের নাম সাকিব আল হাসান ক্যানসার ফাউন্ডেশন। ক্যানসার নিয়ে জনসচেতনতা বাড়িয়ে যত দ্রুত সম্ভব তা শনাক্ত করায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যেটির যাত্রা শুরু হলো এদিন। সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সবাইকে তা জানাতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন।
যে নাজমূল আবেদীন ফাহিমকে সবাই ক্রিকেট কোচ ও বিশ্লেষক হিসেবে চেনেন, তিনি প্রাঞ্জল সঞ্চালনার মাধ্যমে বুঝিয়ে বললেন এই ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য। দর্শক-শ্রোতা বলতে অবশ্য সাংবাদিকই বেশি। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত টেলিভিশন ক্যামেরার সারি। ফাউন্ডেশনের সদস্য নয়জনের বাইরে হাতে গোনা কয়েকজন আমন্ত্রিত অতিথি।
আমাদের স্বপ্নটা বড়, একটা ক্যানসার হাসপাতাল করা। যেখানে পরিপূর্ণ আধুনিক চিকিৎসার সকল সুযোগ থাকবে। একদমই কম খরচে মানুষ যে হাসপাতালে এসে হাসিমুখে বাড়ি ফিরবে।
যাঁদের একজন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান, যিনি ল্যাপটপের বাটন টিপে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু করিয়ে দিলেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এছাড়াও ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান ও হাবিবুল বাশার এবং সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ ওমর, সানোয়ার হোসেন, মুশফিকুর রহমান ও সাজেদুল ইসলামের মতো আরও কয়েকজন।
হাবিবুল বাশার ক্যানসারে তাঁর বড় ভাইকে হারিয়েছেন। সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা পারতপক্ষে মনে করতে চান না। তারপরও এদিন এ নিয়ে কথা বলতে হলো তাঁকে। সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশনের জন্মও এমন একটা বিয়োগান্ত ঘটনা থেকেই। এটির মূল উদ্যোক্তা যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাবেক ক্রিকেটার কাফি খান। বিকেএসপির ছাত্র কাফি ২০০২-২০০৩ সালের দিকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক ছিলেন।
বিকেএসপিতে তাঁর সহপাঠী ও সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাফর সাদেক মাত্র ৩১ বছর বয়সে মারা গেছেন ক্যানসারে। সেই ক্যানসার ধরা পড়তে পড়তে অনেক দেরি হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ও চেন্নাইয়ে প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। কাছ থেকে দেখেছেন ক্যানসার কীভাবে প্রাণবন্ত একজন যুবককে হতশ্রী বানিয়ে কত তাড়াতাড়ি মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
২০১৬ সালে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর পর থেকেই ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কিছু একটা করার তাগিদ বোধ করছিলেন কাফি খান। সেই তাড়নার কারণটাও বললেন, ‘আমার বন্ধুর অসুস্থতার সময়ই দেখেছি, ক্যানসার ধরা পড়তে পড়তেই অনেক সময় অনেক দেরি হয়ে যায়। আমাদেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অবস্থা তো চিন্তাই করা যায় না।’
অভিমানে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ডপ্রবাসী হয়েছেন অনেক বছর। সেখানে ব্রিটিশ রেলওয়েতে সিগন্যালিং প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন কাফি। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সময় সাকিবের সঙ্গে দেখা করে ক্যানসার নিয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছার কথা জানান। সাকিব সঙ্গে সঙ্গেই যেটির সঙ্গে যুক্ত হতে রাজি হয়ে যান। বিকেএসপিতে তাঁর চার বছরের জুনিয়র সাকিব সম্পর্কে কাফি একটা কথা যোগ না করে পারলেন না, ‘সাকিব কিন্তু মানুষকে অনেক হেল্প করে। কেন যেন তা আলোচনায় আসে না।’
২০১৭ থেকে ২০২৩—প্রায় ছয় বছর পর সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে আলোর মুখ দেখেছে, তবে এর প্রস্তুতি চলছিল এতগুলো বছর ধরেই। সাকিবের সঙ্গে কথা হওয়ার পর কাফি তাঁর পুরো পরিকল্পনাটা জানিয়েছিলেন বিকেএসপিতে তাঁর কোচ নাজমূল আবেদীন ফাহিমকে। নাজমূল আবেদীন, সাকিব ও কাফি খানের সঙ্গে যোগ হন আরও ছয়জন—সোহরাওয়ার্দী শুভ, নাঈম ইসলাম, মোশাররফ হোসেন রুবেল, আবদুর রাজ্জাক, নাসিরুল ইসলাম ও সারোয়ার ইমরান। এঁরা সবাই ক্রিকেটের মানুষ। নিয়তির নির্মম পরিহাসই বলতে হবে, এঁদের মধ্যে মোশাররফ হোসেন নিজেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।
সাকিব তাঁর বক্তব্যে ক্যানসার নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করার অঙ্গীকার করলেন। তাঁর স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির তাঁকে এ ব্যাপারে কতটা অনুপ্রাণিত করেছেন, জানালেন সে কথাও। শিশিরের একটা ভিডিও-ও দেখানো হলো অনুষ্ঠানে। যেটিতে গত দুই বছরের মধ্যে ক্যানসারে মা–বাবা দুজনকেই হারানোর বেদনার কথা বললেন তিনি। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বড় কিছুই করতে চান সাকিব, ‘আমাদের স্বপ্নটা বড়, একটা ক্যানসার হাসপাতাল করা। যেখানে পরিপূর্ণ আধুনিক চিকিৎসার সকল সুযোগ থাকবে। একদমই কম খরচে মানুষ যে হাসপাতালে এসে হাসিমুখে বাড়ি ফিরবে। গর্ব করে বলবে, বাংলাদেশেও এমন একটি হাসপাতাল আছে।'
হাসপাতাল যখন হওয়ার হবে। আপাতত ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজটা শুরু করে দিতে চায় এই ফাউন্ডেশন। কাফি খান জানালেন একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার করার চিন্তার কথাও। যেখানে গরিব রোগীরা একটু কম পয়সায় ক্যানসারের ব্যয়বহুল পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে পারবেন। অথবা এমনও হতে পারে, খরচের একটা অংশের জোগান দেবে এই ফাউন্ডেশন। আর দূরতম লক্ষ্য তো একটাই, প্রিয় বন্ধুর স্মৃতিতে কোনো একদিন একটা ক্যানসার হাসপাতাল হবে, 'এটা তো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। মূলত যা মানুষের দানের ওপর নির্ভরশীল। তবে আমরা একদিন না একদিন আমরা একটা ক্যানসার হাসপাতাল করতে চাই।'
ক্রিকেট এবং ক্যানসার হাসপাতাল—এই দুটি কথা একসঙ্গে উচ্চারিত হলেই যাঁর নাম প্রথমেই মনে হয়, সেই ইমরান খান এখানেও প্রেরণা। ইমরান খানের সঙ্গে নামের শেষাংশে মিল আছে। তবে ইমরানের চেয়ে কাফি খানের স্বপ্নপূরণের পথটা যে অনেক বেশি কঠিন, তা তো না বললেও চলছে। কাফি খানও তা জানেন। তারপরও লড়াইটা শুরু করতে চান, তাতে জেতার আশাও করেন। কারণ একটাই—তাঁর সঙ্গে যে একজন সাকিব আল হাসান আছেন।