ছলাকলার উইকেটেও বিরাট ‘রেকর্ড’ কোহলি
অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসেই বল উইকেটে পড়ার পর ধুলা উড়ছিল। ভারতের সামনে কী অপেক্ষা করছিল, সেটা বোঝা গিয়েছিল তখনই। ম্যাচ শেষেও উইকেট নিয়ে জল্পনাকল্পনা থামেনি। লোকেশ রাহুলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এমএ চিদাম্বরম স্টেডিয়ামের উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য কতটা কঠিন ছিল?
অপরাজিত ৯৭ রানের ইনিংসে ভারতকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়া রাহুলের প্রতিক্রিয়া শুনলে মনে হবে ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’–এর বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘(শিশির পড়ার পর) তখনো এটা অসম বাউন্সের উইকেট ছিল। ব্যাট করার জন্য ভালো ছিল না। আবার খুব যে কঠিন, সেটাও নয়। উইকেট ফ্ল্যাট ছিল না, কিন্তু বোলাররাও তেমন সাহায্য পায়নি...।’
রাহুল পরে অবশ্য বলেছেন, ক্রিকেট ম্যাচের জন্য ভালো উইকেট। সেটা সম্ভবত এমন উইকেট ব্যাটসম্যানের দক্ষতা ও সামর্থ্যের পরীক্ষা নেয় বোঝাতে বলেছেন। ভারতের স্পিনারদের ৬ উইকেট নেওয়া—বিশেষ করে রবীন্দ্র জাদেজার ‘আনপ্লেয়েবল’ বলে স্টিভেন স্মিথের আউটটি এবং পরে ভারতের ইনিংসে শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের টপাটপ ৩ উইকেট তুলে নেওয়া কী সাক্ষ্য দেয়? উইকেট আসলেই ‘ছলনাময়ী’ ছিল—টু পেসড!
ভারতের ইনিংসে প্রথম ১২ বলের মধ্যে পড়েছে ৩ উইকেট। ৪৯.৩ ওভার ফিল্ডিং করার পর লোকেশ রাহুল একটু বিশ্রাম নেওয়ারও সময় পাননি। দলকে উদ্ধার করতে ব্যাট হাতে নেমে আসতে হয়েছে উইকেটে। সেখানে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন তিনে নামা বিরাট কোহলিকে। সেই চাপের মুহূর্তে উইকেটের আচরণ রাহুলের তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলার কথা নয়। রাহুলের সেই চেষ্টা করার প্রয়োজনও ছিল না। অন্য প্রান্তে ‘বিশেষজ্ঞ’ তো ছিলেনই ! এমন উইকেটে কীভাবে ব্যাট করতে হবে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেই মিলেছে সমাধান, ‘বিরাট বলেছে উইকেট থেকে প্রচুর সাহায্য মিলবে। আপাতত কিছুক্ষণ আমাদের টেস্ট ক্রিকেটের মতো ঠিকঠাক ক্রিকেটীয় শট খেলতে হবে তারপর কী হয়, দেখা যাবে।’
রাহুলের দাবি, ‘এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা এবং সেটা দলের জন্য কাজে লাগাতে পারে আমরা খুশি।’
কোহলির কথাই কিন্তু সত্য প্রমাণিত হয়েছে। রাহুলই বলেছেন, শিশিরের কারণে ইনিংসের শেষ ১৫-২০ ওভারে ব্যাট করাটা সহজ হয়ে এসেছিল। অস্ট্রেলিয়া বল একবার পাল্টানোর পর আর অসুবিধা হয়নি। এমন দূরদর্শিতার জন্য কোহলির প্রশংসায় হার্শা ভোগলের টুইটটি টেনে আনা যায়, ‘(ম্যাচের) পরিস্থিতি বোঝার ক্ষমতা এবং সে পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের খেলাকে মানিয়ে নেওয়ায় আধুনিক ক্রিকেটে বিরাট কোহলির সমকক্ষ কেউ নেই।’
নাহ, এই বেলা শচীন টেন্ডুলকারের সমর্থকেরা হয়তো একটু মন খারাপ করতে পারেন। টেন্ডুলকারও তো আধুনিক ক্রিকেটের কিংবদন্তি। ওয়ানডেতে টেন্ডুলকারের ৪৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড টপকে যাওয়া থেকে কোহলি নাহয় আর মাত্র ৩ সেঞ্চুরি দূরে, তাই বলে ‘সমকক্ষ কেউ নেই’ রায় দিতে হবে! হ্যাঁ, ভোগলে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু অনুমতির ভিত্তিতে কথাটা বলেছেন, তবু মনের মধ্যে খচখচানিটা কী যায়?
আসলে কিছু করারও নেই। পরিসংখ্যানই কিছু কিছু জায়গায় টেন্ডুলকারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে রেখেছে কোহলিকে। অবশ্য দোষটা তো পরিসংখ্যানেরও নয়—পরিসংখ্যানের তো আর হাত-পা নেই যে টেন্ডুলকার অবসর নেওয়ার পর কোহলিকে ঠেলেঠুলে তাঁর চেয়ে এগিয়ে দেবে! ‘দোষী’ কেউ হয়ে থাকলে সেটা স্বয়ং কোহলি-ই!
গতকাল যেমন ১১৬ বলে ৮৫ রানের ইনিংসে ভারতকে জেতানোর পথে টেন্ডুলকারকে পরিসংখ্যানের বিশেষ এক পাতায় পেছনে ফেলেছেন কোহলি—ওয়ানডেতে সফল রানতাড়ার সবচেয়ে বেশি রান এখন তাঁর।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নামার আগে ওয়ানডেতে সফল রানতাড়ায় ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে (৯২ ইনিংস) কোহলির রান ছিল ৫৪৩১। এই তালিকায় ১২৭ ম্যাচে (১২৪ ইনিংস) ৫৪৯০ রান নিয়ে শীর্ষে ছিলেন টেন্ডুলকার। ২৯তম ওভারে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের বলে স্কয়ার লেগে সিঙ্গেল নিয়ে কোহলির রান যখন ৬০—তখনই এই তালিকায় তাঁর পেছনে পড়লেন টেন্ডুলকার। তাহলে বলুন, ‘দোষ’টা কার? পরিসংখ্যানের না কোহলির! ওয়ানডেতে সফল রানতাড়ায় কোহলির রানসংখ্যাই এখন সর্বোচ্চ—৯৮ ম্যাচে ৯২ ইনিংসে ৫৫১৭ রান।
এই তালিকায় অন্তত ৩ হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যাটিং গড়ে কোহলির (৮৮.৯৮) ধারেকাছেও কেউ নেই। কোহলি ছাড়া ব্যাটিং গড়ে ৬০–এর ওপরে আছেন শুধু ব্রায়ান লারা (৬৮.৫৮) ও রোহিত শর্মা (৬৩.২২)। অন্তত ২ হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যাটিংগড়ে কোহলির ওপরে শুধু তাঁর সাবেক সতীর্থ মহেন্দ্র সিং ধোনি (১০২.৭১)। শুধু ম্যাচ জেতানোর পথে গড়েই নয়, অপরাজিত ইনিংসেও ধোনি (৪৭) কোহলির চেয়ে এগিয়ে (৩০)। তবে এর কারণও সহজেই অনুমেয়। ধোনি ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় ৬-৭-এ ব্যাট করলেও কোহলি মূলত টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান।
আর রানতাড়ায় ব্যাটিং গড়ের শীর্ষ দশে সবাই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান—সেখানে অপরাজিত থাকার ইনিংসংখ্যায় কোহলি জ্যাক ক্যালিসের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয়। ৩১ ইনিংস অপরাজিত থেকে শীর্ষে রিকি পন্টিং। তবে কোহলি একটি জায়গায় আপাতত বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে! ওয়ানডেতে সফল রানতাড়ায় সবচেয়ে বেশি ২২ সেঞ্চুরি কোহলির। এই তালিকায় সেঞ্চুরিসংখ্যা দুই অঙ্কে নিতে পেরেছেন মাত্র তিনজন এবং সবাই ভারতীয়—বিরাট কোহলি (২২), শচীন টেন্ডুলকার (১৪) ও রোহিত শর্মা (১১)। মাঝের জন যেহেতু অবসরে, তাই কথাটা বললে মোটেও অত্যুক্তি হয় না—বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে সেঞ্চুরিসংখ্যায় ‘দ্বিগুণ’ এগিয়ে কোহলি।
কোহলি গতকালের ইনিংসটি খেলেছেন তিনে নেমে। ৩ নম্বর পজিশনে তাঁর পারফরম্যান্সটা একটু দেখে নেওয়া যাক—কোহলি গতকাল এশিয়ার প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে তিনে নেমে ১১ হাজার রানের ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন! এই তালিকায় কোহলির আগে ছিলেন শুধু অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি পন্টিং (৩৩৫ ম্যাচে ৩৩০ ইনিংসে ১২৬৬২ রান)। কোহলি ২১৮ ম্যাচে ২১৫ ইনিংসে তুলেছেন ১১০৪৭ রান। পন্টিং-কোহলি দুজনেই তিনে নেমে ৩২ বার অপরাজিত থেকেছেন, সেঞ্চুরিসংখ্যায় অবশ্য পন্টিং (২৯) কোহলির (৪০) চেয়ে পিছিয়ে। ব্যাটিংগড়ে তো বটেই—পন্টিং ৪২.৪৮ আর কোহলি ৬০. ৩৬। ওহ্, আরেকটি কথা। ওয়ানডেতে তিনে নেমে দ্রুততম ১১ হাজার রানের রেকর্ডও এখন কোহলির—২১৮ ম্যাচ ও ২১৫ ইনিংস।
বিষয়টিকে আরেকটু ভেঙে নেওয়া যায়। যদি প্রশ্ন করা হয়, তিনে নেমে সফল রানতাড়ায় কে কতটা সফল? এখানেও কোহলির প্রতিদ্বন্দ্বী নেই! ৭৫ ইনিংসে ৮৯.১৬ ব্যাটিং গড়ে ৪৪৫৮ রান কোহলির। স্ট্রাইক রেট ৯৭.৬৫ এবং সেঞ্চুরিসংখ্যা ১৭। তাঁর ধারেকাছে থাকা পন্টিং (৯২ ইনিংসে ৫৮.৩৬ ব্যাটিং গড়ে ৩৮৫২ রান) তো আগেই অবসর নিয়েছেন। সেঞ্চুরিতে পন্টিং (৮টি) শুধু একাই পিছিয়ে নন, কোহলি ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যানই এই তালিকায় সেঞ্চুরিসংখ্যা দুই অঙ্কে নিতে পারেননি! বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে কোহলির ধারেকাছে আছেন শুধু বাবর আজম—২৯ ইনিংসে ৭৬.৪০ গড়ে ১৫২৮ রান। সেঞ্চুরি ৫টি। ধারেকাছে নয় আসলে, সৌজন্যতার খাতিরেই বলা!
কিন্তু পরিসংখ্যান তো সৌজন্যতা জানে না! হিসাবে সে স্পষ্ট ও নির্মোহ। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, গতকালের ইনিংসটি দিয়ে ভারতের হয়ে আইসিসির সাদা বলের টুর্নামেন্টে টেন্ডুলকারকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও গড়েছেন কোহলি। ৬১ ম্যাচে ২৭১৯ রান করেছিলেন টেন্ডুলকার। নিজের ৬৭তম ম্যাচে এসে মোট ২৭৮৫ রানের রেকর্ডটি নিজের করে নিলেন কোহলি। শুধু কী তা–ই, ক্যাচের হিসাবেও বিশ্বকাপে ভারতের ক্রিকেটারদের মধ্যে কোহলির ওপরে কেউ নেই।
গতকাল মিচেল মার্শের ক্যাচটি নেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপে ভারতের আউটফিল্ড খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার (২৮ ম্যাচে ১৫ ক্যাচ) রেকর্ড গড়েছেন কোহলি। এর আগে ১৪ ক্যাচ নিয়ে রেকর্ড ছিল অনিল কুম্বলের। গতকাল দারুণ ফিল্ডিংয়ের জন্য টিম ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন কোহলি। আর বেচারা মিচেল মার্শ! কোহলি তাঁর ক্যাচ নিলেও পরে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কোহলি ১২ রানে ক্যাচ তুললে সেটি ফেলে দিয়েছেন!
১৯৮৭ বিশ্বকাপে চেন্নাইয়ের এই চিদাম্বরম স্টেডিয়ামেই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ১ রানে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সে ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন মিচেল মার্শের বাবা জিওফ মার্শ। ৩৬ বছর পর সেই একই মাঠে একই টুর্নামেন্টে এবং দলের প্রথম ম্যাচে মার্শ ‘ডাক’ মারার পাশাপাশি ছেড়েছেন এমন একজনের ক্যাচ, যাঁকে রানতাড়ায় ‘ওস্তাদ’ মানে বিশ্ব!
কোহলি সেই ওস্তাদের মার তিনে নেমে ফের দেখিয়ে দেওয়ার পর মার্শকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন। ক্যাচটা নিতে পারলে যে রেকর্ডবই (অন্তত এই ম্যাচে) এভাবে ওলটপালট হতো না!