বিবিসিতে এক কলাম লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা। এবারের অ্যাশেজ নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ উঠে এসেছে সেই কলামে। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের বহুল আলোচিত ‘বাজবল’ ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন। তাতে উঠে এসেছে জনি বেয়ারস্টোর স্টাম্পিং নিয়ে বিতর্কও। পাঠকদের জন্য সেই কলামের হুবহু অনুবাদ তুলে ধরা হলো...
শুরুতেই আমি বলে নিতে চাই জনি বেয়ারস্টোর বিতর্কিত আউটটি আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি। আমি এটা নিয়ে প্রচুর ভেবেছি। এ ব্যাপারে সব প্রতিক্রিয়াই দেখেছি, পড়েছি। এটি আমার ভাবনাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে।
ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর অ্যালেক্স ক্যারি যে বেয়ারস্টোকে স্টাম্পিং করেছে, সেই আবেদনটি যদি প্যাট কামিন্স প্রত্যাহার করে নিত, তাহলে আমি খুশিই হতাম, প্রথম প্রথম এটাই আমার মনে হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে আমি যতই ভেবেছি, ততই আমার মনে হয়েছে কামিন্স আউটের আবেদন প্রত্যাহার না করে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আমি মনে করি, বেয়ারস্টোর আউট নিয়ে বিতর্ক ইংলিশদের মানসিকতার গভীর একটা দিক।
আমি যেসব সাবেক ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা ইংলিশ হোন, কিংবা অস্ট্রেলিয়ান, সবাই বলেছেন বেয়ারস্টোর আউটটি ঠিক ছিল। এমনকি ক্রিকেট কিংবদন্তি ব্রায়ান লারাও বলেছেন, বেয়ারস্টো সেদিন আউট ছিলেন। আমি কিন্তু ‘বাজবলে’র খুব বড় ভক্ত। ভয়ডরহীন ক্রিকেট, প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করা কিংবা ক্রিকেটাররা যা-ই করুক, সেটির জন্যই পিঠ চাপড়ে দেওয়ার এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে।
কিন্তু বেয়ারস্টোর আউটের পর যা হয়েছে, সেটি এবারের অ্যাশেজে ইংল্যান্ড দলের একটা সারসংক্ষেপ বলা যেতে পারে। এবারের অ্যাশেজটা ইংলিশরা খেলছে খুবই হেলাফেলা করে, খুবই ‘ক্যাজুয়ালি’। আমি বাজবলের নতুন একটা নাম দিতে চাই। ইংলিশরা যেটি খেলছে, সেটি ‘বাজবল’ নয়, ‘ক্যাজবল’। লর্ডস টেস্টের প্রথম দিন থেকে ইংল্যান্ডের খেলা বিশ্লেষণ করুন, ইংল্যান্ড দলকে আমার খুবই ক্যাজুয়াল মনে হয়েছে।
লর্ডস টেস্টের পর ওলি রবিনসন বলেছে, অস্ট্রেলিয়ার ‘নাম্বার ১১’ তিনজন। এঁদের একজন হচ্ছেন নাথান লায়ন। যিনি ব্যাট হাতে অস্ট্রেলিয়াকে জেতাতে পারেন। অ্যাশেজে ইংল্যান্ড যে ধরনের স্বাধীনতা নিয়ে খেলছে, সেটি আমার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা এমন কিছু শট খেলেছে, যা নিয়ে খুব সহজেই প্রশ্ন তোলা যায়। ড্রেসিংরুমের মধ্যে সে শটগুলো নিয়ে যদি জবাবদিহি থাকে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু ড্রেসিংরুম থেকে ‘আমরা ব্যাটসম্যানদের স্বাধীনতা দিয়েছি’, ‘এসব শট খেলা তাদের নিজস্ব ব্যাপার’—কথাগুলো যেন কেমন লাগছে! ব্যাপারটা এমন যে দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ ২৭তম হয়েছে, কিন্তু আপনি দৌড়ে গিয়ে তাঁর গলায় পদক ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। ভাই, এটা টেস্ট ক্রিকেট! এটা অ্যাশেজ সিরিজ!
২০০৫ সালের অ্যাশেজের কথা মনে পড়ছে। আমরা সেবার যে ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে খেলেছিলাম, তাতে ছিলেন মাইকেল ভন, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, কেভিন পিটারসেনরা। তাঁরা দারুণ লড়াকু ক্রিকেটার ছিলেন। সব সময়ই নিজেদের তৈরি রাখতেন যেকোনো লড়াইয়ের জন্য। তাঁরা খুবই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। সেই ক্রিকেটাররা যদি এবারের অ্যাশেজে ইংল্যান্ড দলে থাকতেন, তাহলে বলে রাখি এজবাস্টন ও লর্ডস, দুই টেস্টে হেরেই সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকত। বেয়ারস্টো যেভাবে সেদিন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেল, তাতে রীতিমতো মনে হয়েছে খেলাটারই মালিক তিনি। আর বেয়ারস্টোর এভাবে ক্রিজ ছাড়াটাই এবারের অ্যাশেজ ইংলিশ দলের সবকিছু বলে দিচ্ছে।
‘ক্রিকেটীয় চেতনা’ বিষয়টি নিয়ে অনেক কিছু পড়লাম কয়েক দিন ধরে। আসলে টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হয় নিজেদের আচরণ দিয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে খেলতে নেমে বেয়ারস্টোর মতো এভাবে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া যায় না। এ ঘটনাটা চোখে আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে ইংল্যান্ড দল একটা লড়াইয়ে যেভাবে লড়ছে, সেটি খুবই হতাশাজনক।
স্টুয়ার্ট ব্রডের কথাই ধরুন। সে যেভাবে ব্যাটিং করতে নামল, তাতে মনে হলো সে যেন মারামারি করতে নেমেছে। যখন ঘটনাগুলো সমর্থকদের প্রভাবিত করছে, তখন ইংলিশ ক্রিকেটাররা যেন হঠাৎ করেই ফুঁসছে। কিন্তু তারা সিরিজে এরই মধ্যে ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছে। ঘোড়দৌড় শেষে ঘোড়াকে আবদ্ধ করে ফেলার পর উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা মনে হয়েছে আমার। তারা কেন বেয়ারস্টোর আউটটিকে ঘিরে দর্শক, সমর্থকদের অযথা উসকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে? আমি জানি না।
আমি আশা করি, পুরো ব্যাপারটাই লর্ডস টেস্টে বেন স্টোকসের বীরত্বপূর্ণ ১৫৫ রানের ইনিংসটাকে আড়ালে ফেলে দেবে না। সে যেভাবে ওই পরিস্থিতি ৯টি ছক্কায় মারকুটে এক ইনিংস খেলল, সেটি ছিল অবিশ্বাস্য। স্টোকস যখন অবসরে যাবে, তখন তাকে ক্রিকেট খেলাটারই অন্যতম কিংবদন্তি হিসেবে মনে রাখবে সবাই। তবে আমি মনে করি, এখনই সে ক্রিকেটের অন্যতম এক কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।
লর্ডস টেস্টে আরেকটি বিতর্কিত মুহূর্ত আড়ালে চলে গেছে। সেটি হচ্ছে চতুর্থ দিনে মিচেল স্টার্কের ক্যাচটি। বেন ডাকেট সেটিতে আউট হতে পারত। কিন্তু আমি হতাশ হলেও ক্রিকেটের আইনের কারণে তা মেনে নিয়েছি। ক্রিকেটের নিয়ম বলে, যেকোনো ক্যাচ নেওয়ার সময় অবশ্যই বলের ওপর ফিল্ডারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
কিন্তু আমি আমার জীবনে কখনোই এত সুন্দর করে নেওয়া একটা ক্যাচ বাতিল হতে দেখিনি। যে নিয়মে ক্যাচটি বাতিল করা হয়েছে, সেটি নিচু হয়ে আসা ক্যাচের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অথবা কোনো ডাইভিং ক্যাচের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত। যেখানে বলকে শুধুই আঙুলের সাহায্যে লুফে নিতে হয়। আমার সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু আমি দুঃখিত। স্টার্কের ওই ক্যাচটির ক্ষেত্রে এই আইনটি ব্যবহার করা ঠিক হয়নি।
সব মিলিয়ে হেডিংলিতে তৃতীয় টেস্ট শুরু হবে বেশ উত্তপ্ত একটা পরিবেশের মধ্যেই। অস্ট্রেলিয়া দলকে কিছুটা বিরুদ্ধ স্রোতের বিপক্ষে থাকতে হবে। তবে আমি আশা করি লর্ডসে যা যা ঘটেছে হেডিংলির কোনো কিছুই সেগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে না। বিশেষ করে লর্ডসের লং রুমে যা ঘটেছে। হেডিংলি মাঠের ওয়েস্টার্ন টেরেস আর এজবাস্টনের হলিস স্ট্যান্ড নিয়ে অনেক কথা হয়েছে।
কিন্তু সত্যি বলছি, আমি যখন খেলতাম, তখন এই হেডিংলিতে যতবার খেলতে গিয়েছি, প্রায় সব বারই আমরা জিতেছি। ২০০৫ সালের অ্যাশেজ আমরা শেষ দিন জয় পেয়েছিলাম। সেদিন কেভিন পিটারসেন সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু হেডিংলির দর্শকেরা আমাদের যথেষ্ট চাপে রেখেছিলেন। আমি ২০১৯ সালেও হেডিংলিতে ছিলাম। যে টেস্টে বেন স্টোকসের বীরত্বে ঐতিহাসিক এক জয় তুলে নিয়েছিল ইংলিশরা। স্টোকস সেদিন প্রায় এক হাতেই হারিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে। হেডিংলিতে সেদিন অবিশ্বাস্য পরিবেশ দেখেছি আমি।
অস্ট্রেলিয়ানরা হেডিংলির চাপের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেবে—এটা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। এই টেস্ট ইংল্যান্ড দলের ঘুরে দাঁড়ানোর, অস্ট্রেলিয়ারও একই ধরনের বিষয় থাকবে। তারা মনে করবে, তারা একধরনের আক্রমণের মুখে আছে। সুতরাং গোটা দল ঐক্যবদ্ধ হয়েই খেলবে হেডিংলিতে।
অস্ট্রেলিয়াকে অবশ্যই সাবধান হতে হবে, মনোযোগী হতে হবে। কারণ, ইংল্যান্ড অবশ্যই মরণকামড় দিতে চাইবে। আমি সত্যিকারের অ্যাশেজ রোমাঞ্চের অপেক্ষায় আছি এই টেস্টে।
সিরিজের আগে আমি বলেছিলাম, এবারের অ্যাশেজে প্রতিটি টেস্টই খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া জিতবে ৫-০ ব্যবধানে।
এখন পর্যন্ত...সব ঠিকঠাকই চলছে!