রোমারিও শেফার্ড: যিনি হতে চলেছেন পোলার্ড-রাসেলদের ‘যোগ্য’ উত্তরসূরি

চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার রোমারিও শেফার্ডপ্রথম আলো

ড্যারেন স্যামি, ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেল, কার্লোস ব্রাফেট…এরপর কে?

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকদের এ প্রশ্নটা দীর্ঘদিনের। যে নামগুলোর কথা বলছিলাম, তাঁদের হাত ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছে দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০ ওভারের খেলাটাকে ‘ফ্যাশনেবল’ করেছেন এই হার্ড হিটিং ফিনিশাররা। পেস বোলিংয়ের পাশাপাশি ইনিংসের শেষ দিকে ছক্কা মারার অবিশ্বাস্য সামর্থ্যের কারণেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যোগ হয়েছে শেষের রোমাঞ্চ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে পেস বোলিং অলরাউন্ডারদের বাজার রমরমা হয়েছে পোলার্ড-রাসেলদের কারণেই।

কিন্তু যাঁরা পথ দেখিয়েছেন, সেই পোলার্ড-ব্রাভোরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সোনালি যুগের টি-টোয়েন্টি ফিনিশারদের মধ্যে এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন শুধু রাসেলই। ৩৫ বছর বয়সী রাসেল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ঘরের মাঠে এ বছরের বিশ্বকাপ হবে তাঁর সর্বশেষ অ্যাসাইনমেন্ট। দুবারের বিশ্বকাপজয়ী এই অলরাউন্ডার ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে আরও একবার দেখাতে চান সেই নির্মম আগ্রাসন, বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের সেই অবিশ্বাস্য ঔদ্ধত্য।

এরপরও ঘুরেফিরে আসে শুরুর সেই প্রশ্নটা—রাসেলের পর কে? কে হবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরবর্তী প্রজন্মের পেস বোলিং অলরাউন্ডার, যিনি মারকুটে ব্যাটিংয়ে ভীতি ছড়াবেন বোলারদের মনে? বিপিএলের অন্যতম সেরা দল রংপুর রাইডার্সের বোলাররা হয়তো এই প্রশ্নের উত্তরে একজনের নামই বলবেন—রোমারিও শেফার্ড। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে খেলতে আসা শেফার্ড কী পারেন, সেটির সাক্ষী যে কদিন আগেই হয়েছেন তাঁরা!

এবারই প্রথম বিপিএল খেলতে এসেছেন রোমারিও শেফার্ড
প্রথম আলো

১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের ১৮৭ রানের পেছনে ছুটছিল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স। তাদের রান তাড়ার ১২তম ওভারে এবারের বিপিএলে নিজের প্রথম ইনিংস খেলতে নামেন শেফার্ড। চট্টগ্রামের জয়ের জন্য তখন দরকার ৫১ বলে ১১০ রান, দ্রুতই সমীকরণটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ বলে ৮৩ রানে।

এরপর সাগরিকা স্টেডিয়ামের ওপর দিয়ে বয়ে যায় শেফার্ড-ঝড়। ৩০ বলে ৫টি চার ও ৬টি ছক্কায় ৬৬ রানের অপরাজিত ইনিংসে ম্যাচটাকে নিশ্চিত হার থেকে নিয়ে আসেন নাগালের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত সঙ্গীর অভাবে চট্টগ্রামকে জেতাতে পারেননি, কিন্তু ২২০ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে তাঁর ফিনিশিং সামর্থ্য ঠিকই দেখান শেফার্ড।

আরও পড়ুন

দীর্ঘদেহী এই ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ৬৬ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। ১৪৯ ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেটের শেফার্ড আইপিএলে খেলছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের মতো দলে। যে দলে দীর্ঘ ১৩ মৌসুম ফিনিশারের ভূমিকায় ছিলেন পোলার্ড। ২০১০ সালে পোলার্ডকে মুম্বাই দলে ভেড়ায় আরেক ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার ডোয়াইন ব্রাভোর পরামর্শে। ২০২৩ সালে আইপিএল থেকে অবসর নেওয়া পোলার্ডের জায়গায় আসা শেফার্ডের অনুপ্রেরণা সেই ব্রাভোই।

চট্টগ্রামের টিম হোটেলে বসে সে গল্পই বলছিলেন শেফার্ড, ‘ডোয়াইন ব্রাভো আমার অনুপ্রেরণা। তিনি এমন একজন, যাকে দেখে আমি বড় হয়েছি। আমি ছোটবেলায় ব্যাটসম্যান ছিলাম। এরপর এক বছরে আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট থেকে ছয় ফুট হয়ে যায়। খুব দ্রুত শারীরিকভাবে বড় হতে থাকি। ক্লাব ক্রিকেটে আমার বলের গতিও বাড়তে থাকে। তখন থেকে বোলিংটাকেও গুরুত্ব দিতে থাকি।’

চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের টিম হোটেলে হাস্যোজ্জ্বল রোমারিও শেফার্ড
প্রথম আলো

তবে শেফার্ডের খেলায় ছক্কা মারার সামর্থ্য যোগ হয়েছে অনেক পরে। ছোটবেলা থেকেই দীর্ঘদেহী, ছক্কা মারার শক্তিও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু যে মাঠে শেফার্ডের বেড়ে ওঠা, সে মাঠটা ছিল খুবই ছোট। তার ওপর চারপাশ ঘেরা স্কুল ও হাসপাতালে। যে কারণে মাঠের চারপাশে সারাক্ষণ ভিড় লেগেই থাকত। ছক্কা মারা মানেই বল হারানো। জুনিয়র ক্রিকেটে তাই বল মাটিতে রাখাই শিখতে হয়েছে শেফার্ডকে।

বেশ মজা করেই শেফার্ড বলছিলেন গল্পটা, ‘আমি ছোট থেকেই বেশ বড়সড় ছিলাম। কিন্তু আমি বল মেরে বেশি দূর নিতে পারতাম না। আমার এটা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। অনেক রেঞ্জ হিটিং, অনেক অনুশীলনের পর এসে হিটিং-গেমটা রপ্ত করেছি। আমাদের ক্লাব মাঠটা খুব ছোট ছিল। মাঠের একদিকে স্কুল, আরেক দিকে হাসপাতাল। এ কারণে চারপাশ সব সময় ট্রাফিক থাকত। বল উড়িয়ে মারার সুযোগ ছিল না। কারণ, মারলেই বল হারাবে। সে কারণে ছোটবেলায় পাওয়ার-গেম রপ্ত করা কঠিন ছিল। আমি বরং বল মাটিতে রাখাই শিখেছি। পরে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে এসে মেরে খেলার চেষ্টা শুরু করি। এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি (হাসি)।’

আরও পড়ুন

পোলার্ড-রাসেলদের পারফরম্যান্সের মান ধরে রাখার চেষ্টাও করছেন শেফার্ড, ‘আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই। যাদের নাম বললেন, ওরাই আমাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে। বিশ্ব ক্রিকেটে তারা যা করেছে, তা অবিশ্বাস্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটকে নতুন করে চিনিয়েছে তারা। আমার মতো যারা আছে, তাদের সুযোগ হচ্ছে তাদের কারণেই। আমি প্রথমত তাদের দেখানো পথে হাঁটতে চাইব, ভালো করতে চাইব। আমার মতো আরও কয়েকজন উঠে আসছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটে। আমাদের কাজ হবে ওরা যা শুরু করে দিয়েছিল, সেটা যতটা সম্ভব ধরে রাখা।’

পোলার্ড–রাসেলদের পারফরম্যান্সের মান ধরে রাখতে চান শেফার্ড
এএফপি

শেফার্ডের ভাগ্য ভালো, ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে হলেও রাসেলকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন। দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের কাছ থেকে যে তাঁর শেখার আছে অনেক কিছু, ‘আমি রাসেলের সঙ্গে একই ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করছি, তার কাছ থেকে কৌশল শিখছি। সে আমাকে এর মধ্যেই অনেক কিছু দিয়ে সাহায্য করেছে। তার সঙ্গে আমি যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে পারি। ব্রাভোও একই রকম ব্যক্তিত্ব। আমি এটাকে চাপ হিসেবে নেই না। আমি বরং তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’

ক্যারিবীয়দের ভাগ্য ভালো, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রাসেলকে পাচ্ছে দলটি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসন্ন বিশ্বকাপের আয়োজন করবে। ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টির শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে কে না চাইবে!

শেফার্ডও সে স্বপ্নই দেখছেন, ‘আমরা আসলে ভাগ্যবান যে ড্রেকে (রাসেল) বিশ্বকাপে পাচ্ছি। সে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমাদের কোচও (ড্যারেন স্যামি) তাই। জেসন হোল্ডারের মতো খেলোয়াড়কেও পাচ্ছি। এই বিশ্বকাপ আমাদের জন্য বিরাট ব্যাপার হতে যাচ্ছে। আমরা দুবারের চ্যাম্পিয়ন, প্রথমবার সাবেক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছি। আমরা জানি যে ঘরের মাঠের শতভাগ সমর্থন পাব। এটা হবে বিরাট ব্যাপার।’

বিপিএল অভিষেকেই ব্যাট হাতে ঝড় বইয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের রোমারিও শেফার্ড
প্রথম আলো

কে জানে, এবারের বিশ্বকাপ দিয়েই হয়তো শেফার্ডদের কেউ একজন হয়ে উঠবেন ‘রিমেম্বার দ্য নেম—কার্লোস ব্রাথওয়েট!’