বিশ্বকাপ আসে, বিশ্বকাপ যায়...তা থেকে কী শেখে বাংলাদেশের ক্রিকেট? নতুন কী জানে?
যে বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশে এখন আলোচনা-সমালোচনার ঝড়, দায় এড়াতে চাপান-উতোরের খেলা; সেই ২০২৩ বিশ্বকাপের টাটকা স্মৃতিই না হয় একবার স্মরণ করুন। কী চোখে ভাসে? ব্যাটসম্যানরা রান করতে পারে না, বোলারদের কারও ক্ষমতা নেই বিধ্বংসী এক স্পেলে ম্যাচের রং বদলে দেওয়ার, সেমিফাইনালের স্বপ্ন নিয়ে এসে ফিরতে হয় ৮ নম্বরে থেকে...এ–ই তো!
তা, এর বাইরে কি জানার-শেখার কিছু নেই? বোঝার নেই, কেন বাংলাদেশ বারবার এমন ব্যর্থতার বৃত্তেই ঘুরপাক খায়! ব্যর্থতা তো দেশের অবকাঠামো, পরিকল্পনা, পরিচালনা, পেশাদারত্ব, ক্রিকেট সংস্কৃতি—সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার একটা সুযোগও। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কি তা করবে? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, কোনো সম্ভাবনাই নেই। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতায় যেহেতু এত হইচই হচ্ছে, দায়সারা একটা কিছু করে তাতে একটু রাশ টানার চেষ্টা হবে। হয়তো বলির পাঁঠা বানানো হবে কাউকে। তারপর চলতে থাকবে সেই থোড় বড়ি খাড়াকে উল্টে দেওয়ার গল্প। থোড় বড়ি খাড়া থেকে খাড়া বড়ি থোড়। এর মধ্যে হঠাৎ একটা সাফল্য আসবে আর তা নিয়ে শুরু হবে উদ্বাহু নৃত্য। কথার ফুলঝুরিতে আড়াল হয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে চলতে থাকা স্বেচ্ছাচার।
ক্রিকেট নিয়ে দেশের মানুষের এমন আবেগ, যে ক্রিকেট নিয়ে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের কাছে বিস্ময় (এই বিশ্বকাপ কাভার করতেই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন ৭০ জনের বেশি সাংবাদিক), সেই ক্রিকেট তো অনেক দিনই চলছে চরম অব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনাহীনতার মধ্য দিয়ে।
বলতে পারেন, অনেক দিনই এমন চললে এখন তা নিয়ে এত সবিস্তার বলার কারণ কী? কারণ অবশ্যই বিশ্বকাপে ব্যর্থতা। আবার শুধুই বিশ্বকাপে ব্যর্থতা নয়। টানা খেলতে থাকলে সাফল্য-ব্যর্থতা থাকবেই। তবে যদি জানেন যে সবকিছু ঠিকভাবে চলছে, তখন ওই ব্যর্থতাকে আপনি সাময়িক বলে ধরে নিয়ে আশাভরে সামনের দিকে তাকাবেন। আর যখন জানবেন, সবকিছু তো দূরের কথা, প্রায় কোনো কিছুই ঠিকভাবে চলছে না, তখন ব্যর্থতা আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সেসব সমস্যা। বাংলাদেশ দুটির বদলে আফগানিস্তানের মতো চারটি জয় পেলেই এটি সফল বিশ্বকাপের স্বীকৃতি পেয়ে যেত। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমস্যাগুলো কি তাতে নাই হয়ে যেত? অবশ্যই না। তখন বলতে হতো, এত অব্যবস্থা, এত পরিকল্পনাহীনতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। খারাপ করাটা বরং একদিক থেকে মন্দের ভালো। কারণ, তা সুযোগ হয়ে এসেছে আত্ম-অনুসন্ধানের।
বিসিবি তা করবে বলে মনে হয় না। কারণ, তাতে যে নিজেদেরই দাঁড়াতে হবে কাঠগড়ায়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে শেখার-জানার কথা বলছিলাম। এই যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের এত এত পরিচালক বিশ্বকাপের ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে একরকম প্রমোদভ্রমণই করে গেলেন, তাঁরা কী দেখলেন, কী শিখলেন, তা খুব জানতে ইচ্ছা করে। ভারতের প্রতিটি ভেন্যুতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম, অনুশীলনের দারুণ সুযোগ-সুবিধা...এসব কি তাঁরা দেখেননি? দেখে কি তাঁদের কোনো আত্মগ্লানি হয়েছে! বাংলাদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে একবারও কি মনে হয়নি, বাংলাদেশে কেন এত বছরেও এমন কিছু করা গেল না? কেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখনো আদতে ঢাকা ক্রিকেট বোর্ড হয়ে আছে! একবার তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগেনি, কেন দেশের প্রতিটি বিভাগে, প্রতিটি জেলায় ক্রিকেটের জন্য পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন–সুবিধা নেই? কেন পটুয়াখালীর একজন কিশোর বা তরুণ নিবিড় অনুশীলন করতে চাইলে তাঁকে ঢাকাতেই আসতে হবে?
তা ঢাকাতেই–বা এমন কী হাতি-ঘোড়া আছে? থাকার মধ্যে তো এক মিরপুর, অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধায় যেটিকে বিপুল ব্যবধানে হারিয়ে দেবে ভারতের যেকোনো আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা।
আচ্ছা, বাংলাদেশেও না এই আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা হওয়ার কথা ছিল! সেই অনাদিকাল থেকে হবে-হচ্ছের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে এখন যা পরিণত হয়েছে রসিকতায়। জেলায় জেলায় ক্রিকেট সংস্থা হবে। যাতে শুধু ক্রিকেট সংগঠকেরাই থাকবেন, তাঁদের ভোটেই নির্বাচিত হবে বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। সেই বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কোন জেলায় ক্রিকেট হয় আর কোন জেলায় হয় না, তার নজরদারি করবে। সেই বিভাগীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন হবে একেকটা ‘মিনি বিসিবি’, যাদের আলাদা সিলেকশন প্যানেল থাকবে, আলাদা বয়সভিত্তিক দল, আলাদা কোচিং স্টাফ, পেশাদার কর্মী। মাঠ থাকবে, ইনডোর থাকবে, থাকবে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারদের সঙ্গে চুক্তি, যেটি ঠিক করবেন বিভাগীয় নির্বাচকেরা। জেলা ক্রিকেট সংস্থাগুলোর বিভাগীয় অ্যাসোসিয়েশনের কাছে জবাবদিহি থাকবে বিভাগীয় অ্যাসোসিয়েশনের মূল বোর্ডের কাছে। যা বলছি, তা এমন কোনো মহাকাশবিজ্ঞান তো নয়ই, বৈপ্লবিক কোনো ধারণাও নয়, বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট এভাবেই চলে।
আর বাংলাদেশ হাঁটে উল্টো পথে। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির মূল প্রতিযোগিতা জাতীয় ক্রিকেট লিগের শুরুতে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে খেলা হতো। যেটিকে বলতে পারেন আঞ্চলিক যেকোনো প্রতিযোগিতাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তোলার পূর্বশর্ত। অথচ জাতীয় লিগ অনেক বছর সরে এসেছে সেখান থেকে। সিলেট হয়তো খুলনার সঙ্গে খেলছে রাজশাহীতে। ওই ম্যাচ নিয়ে দর্শকেরই কেন আগ্রহ থাকবে, ক্রিকেটাররাই–বা উদ্দীপিত হবেন কীভাবে!
এর সঙ্গে বিশ্বকাপে সাফল্য-ব্যর্থতার সম্পর্ক কী ? সম্পর্ক তো আছেই। সারা দেশের ক্রিকেটের প্রতিচ্ছবিই তো ফুটে ওঠে জাতীয় দলে। আর জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের কোনো বিকল্প এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তা সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ওয়ানডেই হোক বা টি-টোয়েন্টি। টেস্ট ক্রিকেটের কথা আর নাই–বা বললাম।
কদিন আগেই পাকিস্তানের একটা টিভি চ্যানেলে ছোট্ট একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলী। ভারতের সফলতম অধিনায়কদের একজন, ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতিও ছিলেন তিন বছর। আইপিএলের কারণেই মাঠের খেলায়ও ভারতের এমন সুসময়, তত্ত্বটা তিনি উড়িয়েই দিলেন। পরিষ্কার বলে দিলেন তাঁর নিজের উপলব্ধিটা। টি-টোয়েন্টি টাকা দেয়, তবে ক্রিকেটার বানায় দীর্ঘ পরিসরের খেলা। এরপর এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতে সেপ্টেম্বরে মৌসুম শুরু হয়ে তা চলে মার্চ পর্যন্ত। মার্চ থেকে এপ্রিল আইপিএল। যার মানে টানা আট মাস খেলার মধ্যে থাকে ক্রিকেটাররা। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটই তাদের এমন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দেয় যে খেলার বাইরে আর কিছুই ভাবতে হয় না। আর সেই খেলার প্রায় সবই আঞ্চলিক ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে যা সবচেয়ে অবহেলিত। হবে-হচ্ছে করেও বাংলাদেশের ক্রিকেট বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ার কারণটা অবশ্য বিসিবির গঠনতন্ত্র থেকেই পরিষ্কার। টেস্ট প্লেয়িং একটা দেশের ক্রিকেট বোর্ড বিস্ময়করভাবে এখনো পুরোপুরিই ক্লাবকেন্দ্রিক। তা-ও আবার শুধুই একটা শহরের ক্লাব। নির্বাচিত ২৩ পরিচালকের ১২ জনই ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিনিধি, বাকি সারা দেশ থেকে যেখানে ১০ জন। একবার ভেবে দেখুন তো, তৃতীয় বিভাগ, অর্থাৎ ঢাকাই ক্রিকেটের চতুর্থ স্তরের একটা ক্লাব, যারা বছরে শুধুই একটা মহাবিতর্কিত ৫০ ওভারের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়, সেই ক্লাব থেকে একজন বিসিবির সদস্য (কাউন্সিলর মানে তো তা-ই) হয়ে যাচ্ছেন; যেখানে একটা গোটা জেলা থেকে, তা রাজশাহী বা খুলনার মতো ক্রিকেট কেন্দ্র হলেই–বা কী, সেখান থেকেও একজনই, এটা কি কোনো টেস্ট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেট বোর্ডের আদর্শ কাঠামো হতে পারে? ঢাকার লিগগুলোতে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং আর পাতানো খেলার যে মহোৎসব চলেছে, তার মূল কারণও তো এই ভোটের রাজনীতিই। এই পাপের ফল তো ভোগ করতেই হবে।
নাজমুল হাসান প্রায় এক যুগ ধরে বিসিবির সভাপতি। ক্রিকেট ইতিহাসেই আর কেউ এত বছর কোনো দেশের টানা বোর্ডপ্রধান ছিলেন কি না, সন্দেহ। বাংলাদেশের ক্রিকেটে হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয়নি—এমন সবকিছুরই দায় তাই তাঁর ওপরই বর্তায়। টসে জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং না নিয়ে কেন বোলিং নিল, ব্যাটিং অর্ডার কী হবে, কে দলে আসবে, কে বাদ পড়বে—এসব নিয়ে কথা বলা কি তাঁর কাজ! বোর্ডপ্রধান হিসেবে তাঁর আসল কাজ তো সারা দেশের ক্রিকেট নিয়ে ভাবা। প্রায় এক যুগে তিনি কী করে যাচ্ছেন, যে কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেট মনে রাখবে তাঁকে?
একটা কাজ অবশ্য করেছেন। ক্রিকেটের এত বছরের প্রচলিত রীতিকে উড়িয়ে দিয়ে দল নির্বাচনের কাজটাকে শুধুই নির্বাচকদের হাতে রাখেননি, সেটিকে বানিয়ে ফেলেছেন সর্বজনীন দায়িত্ব। একসময় বোর্ড সভাপতি বা বোর্ডের অন্য কেউ দল নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করলে তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক হইচই হতো। নাজমুল হাসানের বোর্ড এটাকে এমনই নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে যে এখন আর এসব নিয়ে কথাই হয় না।
এসবকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে ভুল হবে। অনেক দিন ধরে চলে আসা অব্যবস্থাপনা, অনাচার, অপেশাদারত্ব মিলেই আজ বাংলাদেশের ক্রিকেটের এমন দুরবস্থা। এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ।