মোস্তাফিজদের দিল্লি কেন হেরেই চলেছে
আইপিএলের পয়েন্ট তালিকায় চোখ রাখলে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মন খারাপ হওয়ার কথা। ১০ দলের আসরে একেবারে তলানিতে পড়ে আছে মোস্তাফিজুর রহমানের দিল্লি ক্যাপিটালস। ভারতের রাজধানীর ফ্র্যাঞ্চাইজিটির অবস্থা যাচ্ছেতাই। ৫ ম্যাচের সব কটিতে হেরেছে। এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচ জিততে না পারা একমাত্র দলও দিল্লি।
এর চেয়েও অস্বস্তির ব্যাপার, ৫ ম্যাচের চারটিতেই ন্যূনতম লড়াইটুকুও করতে পারেনি দিল্লি। পরশু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষেও একরকম অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে দিল্লি। আর দুটি ম্যাচ হারলেই প্লে-অফের দৌড় থেকে ছিটকে পড়বে তারা।
অথচ দিল্লিতে বাংলাদেশের মোস্তাফিজ ছাড়াও আছেন মিচেল মার্শ, রাইলি রুশো, রোভম্যান পাওয়েল, আনরিখ নরকিয়া, লুঙ্গি এনগিডি, অক্ষর প্যাটেলদের মতো পরীক্ষিতরা। নেতৃত্বে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে ২০১৬ সালে শিরোপা জেতা ডেভিড ওয়ার্নার। দিল্লির কোচিং স্টাফও যেন এক নক্ষত্রপুঞ্জ—প্রধান কোচ রিকি পন্টিং, ক্রিকেট পরিচালক সৌরভ গাঙ্গুলী, সহকারী কোচ শেন ওয়াটসন ও অজিত আগারকার। তবু ম্যাচের পর ম্যাচ সব বিভাগেই ব্যর্থ হচ্ছে দলটি।
আইপিএলে আগের চার মৌসুমের তিনটিতেই প্লে-অফ পর্ব নিশ্চিত করা দিল্লির এবার এমন হাল কেন—সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।
নিয়মিত অধিনায়ক পন্তের অনুপস্থিতি
২০২১ সাল থেকে দিল্লি ক্যাপিটালসের অধিনায়কত্ব করে আসছিলেন ঋষভ পন্ত। এবারও তাঁর নেতৃত্বেই দলটির খেলার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন পন্ত। পুরোপুরি সেরে না ওঠায় খেলতে পারছেন না এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। যদিও দলকে অনুপ্রাণিত করতে একাধিক ম্যাচ মাঠে বসে দেখেছেন। দিল্লিও তাঁকে দ্বাদশ খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি দিয়ে একটি ম্যাচে ডাগআউটে জার্সি টানিয়ে রেখেছে। কিন্তু ২২ গজে তাঁর অনুপস্থিতি দলকে বেশ ভোগাচ্ছে।
ওয়ার্নারের অধিনায়কত্ব ও স্ট্রাইক রেট প্রশ্নবিদ্ধ
যে বছর পন্ত দিল্লির নেতৃত্ব পান, সে বছরই ডেভিড ওয়ার্নারের নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে তাঁকে দল থেকে বাদ দেয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। গত বছর দিল্লিতে যোগ দেন ওয়ার্নার। পন্তর অনুপস্থিতিতে সেই ওয়ার্নারকেই নেতৃত্বভার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। বৈচিত্র্যময় বোলিং লাইনআপ থাকা সত্ত্বেও বোলারদের ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারছেন না। শীর্ষ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় চারে থাকলেও স্বভাবসুলভ মারকুটে ব্যাটিং করতে যেন ভুলে গেছেন! এবারের আইপিএলে শীর্ষ ১০ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তাঁর স্ট্রাইক রেট ও বাউন্ডারি সবচেয়ে কম। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, আসরে সবচেয়ে বেশি ১৯৫ বল খেলে ফেললেও এখনো কোনো ছক্কা মারতে পারেননি ওয়ার্নার।
টপ অর্ডারের ব্যর্থতা
বেশির ভাগ দলের ওপেনাররা যেখানে উড়ন্ত শুরু এনে দিচ্ছে, সেখানে ম্যাচের পরপর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে দিল্লির টপ অর্ডার। উদাহরণ হিসেবে আইপিএল ইতিহাসের সফলতম দল মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের কথাই ধরা যাক। প্রথম দুই ম্যাচেই হেরে গিয়েছে রোহিত শর্মার দল। ওই দুই ম্যাচে দলের টপ অর্ডার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। পরের দুই ম্যাচে টপ অর্ডারের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা। এর একটি মুম্বাই পাওয়ার প্লেতে তুলেছে বিনা উইকেটে ৬৮ রান, অন্যটিতে ১ উইকেটে ৭২। ওপেনাররা ভিত গড়ে দেওয়ায় বড় লক্ষ্য তাড়া করতে পেরেছে তারা। কিন্তু দিল্লির টপ অর্ডার উড়ন্ত শুরু এনে দেওয়া দূরে থাক, পাওয়ার প্লেতে একাধিক উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়ছে। ওয়ার্নারের স্ট্রাইক রেট টি-টোয়েন্টির সঙ্গে মানানসই না হওয়ার অন্যতম কারণও এটা। যোগ্য সঙ্গী না পাওয়ায় দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে তাঁকে। সেটা করতে গিয়ে কিছুটা রয়েসয়ে খেলতে হচ্ছে।
সেরা একাদশ বাছাইয়ে সমন্বয়হীনতা
তারকাসমৃদ্ধ দল ও প্রতিটি বিভাগে পরীক্ষিত ক্রিকেটারদের রেখেও জিততে পারছে না দিল্লি। এতে করে খেলোয়াড়দের সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠলেও বীরেন্দর শেবাগ দায় দিচ্ছেন কোচিং স্টাফকে। পন্টিং, সৌরভ, ওয়াটসনরা এখনো সেরা একাদশ বাছাই করতে পারছে না বলে মত তাঁর। দিল্লির সাবেক অধিনায়ক ও ভারতের সাবেক মারকুটে ওপেনার ক্রিকবাজকে বলেছেন, ‘সত্যি বলতে কোচিং স্টাফে যাঁরা আছেন, তাঁরা কোনো অবদান রাখতে পারছেন না। খেলোয়াড়েরা খারাপ খেললে দল কতটা শক্তিশালী, তাতে কিছু যায়-আসে না। আপনার ড্রেসিংরুমে বড় মানের অনেকে থাকতে পারে। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা রান না পেলে, বোলাররা উইকেট না পেলে তাঁদের থেকে কী লাভ?’ ম্যাচ জেতাতে পারে কিংবা এই মুহূর্তে ভালো ছন্দে আছেন, এমন খেলোয়াড়দের একাদশে রাখা হচ্ছে না বলেও দাবি করেছেন শেবাগ। তাঁর কথাগুলো অমূলক নয়। ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী পৃথ্বী শকে সব ম্যাচেই খেলিয়েছে দিল্লি। মার্শ ৩ ম্যাচে করেছেন মাত্র ৪ রান। শ ও মার্শের তুলনায় রাইলি রুশো ও সরফরাজ খান ভালো করলেও তাঁদের সেভাবে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
পিচ বুঝতে না পারা
দিল্লি টিম ম্যানেজমেন্টের পিচ পড়তে না পারাও ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। উইকেট না বুঝেই টস জিতে ফিল্ডিং নিচ্ছেন ওয়ার্নার। আবার যে উইকেটে স্পিন ভালো ধরছে, সে উইকেটে একজন বেশি পেসার খেলানো হচ্ছে। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরও সঠিক ব্যবহার করতে পারছে না তারা। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ম্যাচেই যেমন নিচু-মন্থর পিচে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে খেলানো হয়েছে পেসার মুখেশ কুমারকে। শুরু থেকে বেধড়ক মার খেলেও তাঁর ওপরই আস্থা রেখেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। কৌশলগত ভুলে দিল্লির শোচনীয় হারগুলোকে হাতুড়িপেটার সঙ্গে তুলনা করেছেন রবি শাস্ত্রী। ভারতের সাবেক কোচ সৌরভ গাঙ্গুলীকে ডাগআউট ছেড়ে ওপরে (ভিআইপি বক্স বা কমেন্ট্রি বক্সে) চলে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে দ্রুততম সময়ে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারলে এখনো প্লে-অফে খেলার সুযোগ আছে দিল্লি ক্যাপিটালসের। শুধু প্লে-অফ কেন, শিরোপা জয়ের স্বপ্নও দেখতে পারে। এ ক্ষেত্রে তারা প্রেরণা খুঁজে নিতে পারে মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের কাছ থেকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সেটা মুম্বাই-কলকাতার চেয়ে ভালো কে জানে! টানা ৪ ম্যাচ হেরেও আইপিএলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির আছে এ দুটি দলের।