ফেসবুকে একটা পোস্টে জানতে চেয়েছিলাম, ফিল্ডিংয়ের কথা বললে প্রথমেই আপনার কার কথা মনে হয়?
পোস্টটা করার পরই মনে হলো, অকারণ পোস্ট। প্রশ্নটারই তো কোনো মানে হয় না। নাম তো ওই একটাই আসবে।
হ্যাঁ, জন্টি রোডসের নামটাই বেশি এসেছে। তবে সঙ্গে আরও অনেক নামও। বিস্মিত হতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে সেটিকে গিলে ফেললাম কারণটা বুঝতে পেরে। জন্টি রোডস খেলা ছেড়েছেন প্রায় ২১ বছর আগে। ফেসবুক-প্রজন্মের অনেকের তখন জন্মই হয়নি। রোডসের ফিল্ডিংয়ের কথা বললে প্রথমেই যে দৃশ্যটা চোখে ভাসে, সেটি তো আরও পুরোনো। নির্দিষ্ট করে বললে ৩২ বছর। ব্রিসবেনের সেই স্বর্গীয় দৃশ্য ১৯৯২ বিশ্বকাপে। জানতে চাইলে তারিখটাও জানিয়ে দিতে পারি। ১৯৯২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ফেসবুকে ওই পোস্টটা দেওয়া অনেকটা ওই দিনটিকে উপলক্ষ করেই।
ওই ১৯৯২ বিশ্বকাপেই জন্টি রোডসের অভিষেক। দক্ষিণ আফ্রিকা দল নির্বাসন থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছে আগের বছর। বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই তেমন চেনা নন। আর ব্লন্ডচুলো নতুন ওই ছেলেটাকে বলতে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে কেউই চেনে না। সেই চেনানোর কাজটা প্রথম ম্যাচ থেকেই করতে শুরু করেছিলেন জন্টি রোডস। সেটি তাঁর দুর্দান্ত ফিল্ডিং দিয়েই। প্রথম চার ম্যাচে সর্বোচ্চ রান তো মাত্র ২৮।
প্রথম চার ম্যাচে যদি ফিল্ডিং চোখে পড়ে থাকে, পঞ্চম ম্যাচে বিস্ময়ে সেই চোখ সবার কপালে তুলে দিলেন জন্টি। নন স্ট্রাইকার ইমরান খান ‘না’ করে দেওয়ায় রান নিতে গিয়ে ফিরে আসতে চাইছিলেন ইনজামাম-উল হক। জন্টি রোডস বলটা হাতে নিয়ে উইকেটের দিকে দৌড় শুরু করলেন। শেষ প্রায় এক মিটার বাতাসে উড়ে গিয়ে বল লাগালেন স্টাম্পে। স্টাম্পে থ্রো না করে দৌড় কেন? পরে বলেছেন, থ্রো করলে ৫০ পার্সেন্ট চান্স ছিল স্টাম্প ভাঙার দৌড়ে গেলে ১০০ পার্সেন্ট। সহজ সমীকরণ। সহজ তো বটেই। তবে দৌড়ে গিয়েও যখন হচ্ছে না, তখন ওভাবে উড়াল দেওয়ার চিন্তা এবং সেটিকে কার্যকর করার ক্ষমতা থাকলে না অমন ভাবা যায়!
রোডসের যে তা ছিল, তার প্রমাণ তিনি পরেও অনেক দিয়েছেন। তবে প্রথম বলে কথা, মাটির সঙ্গে দেহকে সমান্তরাল রেখে বিমানের মতো উড়ে গিয়ে স্টাম্প ভেঙে দেওয়ার ওই ছবি দ্রুতই আইকনিক মর্যাদা পেয়ে যায়। আজকের দিনে হলে বলা যেত, ভাইরাল হয়ে যায়। ক্রিকেট ইতিহাসেই ফিল্ডিংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিও কি এটাই!
সেই শুরু, এরপর তো দিনে দিনে জন্টি রোডসের ফিল্ডিংই হয়ে উঠল বড় এক দর্শক আকর্ষণের নাম। দর্শক মূলত ব্যাটিং দেখতে মাঠে যায়, অবশ্যই কারও কারও বোলিংও, তবে যে ম্যাচে জন্টি রোডস থাকতেন, তাঁর ফিল্ডিং দেখতেও হয়তো মাঠে আসতেন অনেকে।
ক্রিকেটারের পরিচয় তো আর ফিল্ডার হয় না। ফিল্ডার তো সবাই। জন্টি রোডসের ক্রিকেটীয় পরিচয় ছিল মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। ৫২ টেস্টে ৩টি সেঞ্চুরি আছে, ২৪৬ ওয়ানডেতে ২টি। কিন্তু এসবের জন্য জন্টি রোডসকে কেউ মনে রাখেনি। জন্টি রোডস সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসেরই একমাত্র খেলোয়াড়, ফিল্ডারই হয়ে গেছে যাঁর মূল পরিচয়। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেব আসতে পারেন একজনই--রোডসেরই স্বদেশী কলিন ব্ল্যান্ড। তবে ব্ল্যান্ড তো টেস্ট খেলেছেন মাত্র ২১টি। সেটিও ষাটের দশকে ক্রিকেটের সাদাকালো যুগে। যখন টেলিভিশন এখনকার মতো বিশ্বের প্রতিটি কোণে পৌঁছে দিত না ক্রিকেটারদের।
জন্টি রোডসের সময় যা দিয়েছে। ম্যাচের পর ম্যাচ তাই রোডসের অবিশ্বাস্য ফিল্ডিং প্রদর্শনীর সাক্ষী হয়েছেন সবাই। ফিল্ডিংয়ের কথা উঠলে অবধারিতভাবেই যাঁদের জন্টি রোডসের কথাই প্রথম মনে পড়ে।
ফিল্ডিং করতেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে। আশপাশের বিস্তীর্ণ একটা জায়গাকে রীতিমতো দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে ফেলতেন। ব্যাটসম্যানরা সভয়ে ওদিকে তাকাতেন, আর নিজেই হয়তো নিজেকে সাবধান করে দিতেন, ওখানে বল গেলে রান নেওয়ার চেষ্টা মানেই আত্মহত্যা। টেস্টে আড়াই হাজারের মতো রান করেছেন, ওয়ানডেতে প্রায় ৬ হাজার। পরিসংখ্যানটা অসম্পূর্ণ লাগে। ইদানীং না ক্রিকেটে ফিল্ডাররা কে কত রান বাঁচিয়েছেন, সেই হিসাব পাওয়া যায়। তখন তো আর এসবের বালাই ছিল না। নইলে হয়তো প্রমাণ করে দেওয়া যেত, জন্টি রোডস ব্যাট হাতে যত রান করেছেন, সম্ভবত ফিল্ডিংয়ে রান বাঁচিয়েছেন তার চেয়েও বেশি ।
রান বাঁচানোর সবচেয়ে ভালো উপায় ব্যাটসম্যানকে আউট করে দেওয়া। কারণ একজন ব্যাটসম্যান যত ভালোই হোন না কেন, আউট হয়ে গেলে আর রান করতে পারেন না। উইকেট যোগ হয় বোলারের অ্যাকাউন্টে, তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সেই সময়ের বোলাররা রোডসের সঙ্গে এর কিয়দংশ ভাগাভাগি করার সুযোগ থাকলে হয়তো আপত্তি করতেন না। সেই বোলারদের কত উইকেট যে অবিশ্বাসে চোখ কচলাতে হয়, জন্টি রোডসের এমন ক্যাচে, তার প্রমাণ ইউটিউবে মজুত আছে।
দুর্দান্ত অ্যাথলেট তো ছিলেনই। সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ছিল, যেকোনো দিকে খুব দ্রুত গতি সঞ্চার করতে পারা। আমাকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে যেটির কৃতিত্ব দিয়েছিলেন হকিকে। হকি শুধু শখে খেলতেন, এমন নয়। বেশ ভালো খেলতেন। এতটাই যে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় হকি দলের ট্রায়ালেও ডাক পেয়েছিলেন। হকি না ক্রিকেট, এই দোলাচলেও ভুগেছেন। ১৯৯২ বিশ্বকাপ দলে ডাক পেয়ে বিস্মিত হওয়ার কথা শুনেছি তাঁর মুখেই। বিস্মিত হওয়ার কারণ, তখন ক্রিকেটের চেয়ে হকিই বেশি ভালো খেলছিলেন বলে তাঁর নিজের ধারণা। তা হকি কিভাবে ফিল্ডার রোডসের উপকারে এলো? ব্যাখ্যাটাও দিয়েছিলেন। হকিতে স্টিক ধরার জন্য নুয়ে থাকতে হয়, বল নিয়ে দৌড়ানোর সময় তো আরও। এতেই পা আর পিঠের নিচের অংশের মাংসপেশি সবল হয়েছিল বলে রোডসের ধারণ। পাঁচ–দশ গজের মধ্যে তাঁর অমন দ্রুতগতির রহস্য ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবেই।
মাঠে নিজেকে নিংড়ে দিতেন, থাকতেন তো ডাইভের ওপরই। সেই ডাইভও শুধু মাটিতে নয়, পাখির মতো শূন্যেও উড়ত শরীর। তারপর আছড়ে পড়ত মাটিতে। শরীরের ওপর ধকলটাও যেত ও রকমই। ম্যাচের পরদিন বিছানা ছাড়তে কষ্ট হতো। প্রতি মাসে একবার কার্ডিয়াক টেস্ট করাতে যেতেন। ডাক্তারের পরামর্শেই। বলেছিলেন কারণটাও। শূন্যে ডাইভ দিয়ে পড়ার সময় প্রথমে মাঠে পড়ে বুক। পড়ে মানে প্রচণ্ড বাড়ি খায়। বুকে হাত বোলাতে বোলাতে জন্টি রোডস বলেছিলেন, ‘প্রতিদিনই আমার কার ক্র্যাশের অভিজ্ঞতা হয়।’
তা হতো প্র্যাকটিসেও। প্র্যাকটিসে অমন করতে না পারলে মাঠে কীভাবে তা করবেন? ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময় হেডিংলিতে জন্টি রোডসের সেই ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখার সুযোগ হয়েছিল। সুযোগ না সৌভাগ্য বলা উচিত। দলের বাকিরা প্র্যাকটিস শেষ করে ড্রেসিংরুমে উঠে গেছে। মাঠে শুধু জন্টি রোডস আর হার্শেল গিবস। কোচ বব উলমারও ছিলেন সহযোগী হিসেবে। মিনিট পনেরো–বিশের ওই ফিল্ডিং প্র্যাকটিস দেখে বুঝেছিলাম, মাঠে আমরা যা দেখে বিস্মিত হই, তার পেছনে কত পরিশ্রম, কত ঘাম, কত রক্ত...। ‘রক্ত’ কথাটা আক্ষরিক অর্থেই, রোডসের ছড়ে যাওয়া কনুই থেকে নিজেই সেদিন সত্যিই রক্ত ঝরতে দেখেছি।
ফেসবুক পোস্ট দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। কমেন্টে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের সবাই দুর্দান্ত ফিল্ডার। একজন অবশ্য দুষ্টুমি করে রোডসের সবচেয়ে বিখ্যাত শিকার ইনজামাম-উল হকের কথাও লিখেছেন। দুষ্টুমি বোঝাতে কারণটাও যোগ করে দিয়েছেন। ইনজামামের নিচ দিয়ে (অঙ্গটা আর সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করলাম না) বল চলে যেত।
যেটা বলছিলাম, ক্রিকেট ভালো ফিল্ডার অনেক দেখছে। নিজেদের অসাধারণ বলে দাবি করতে পারেন, এমন ফিল্ডারও কম নয়। তবে শুধু ফিল্ডিংয়ের কারণেই সুপারস্টার হতে পেরেছেন শুধু একজনই।
জন্টি রোডস।