স্টোকস-বেয়ারস্টোদের সময়ে একজন আবদুল্লাহ শফিক

গল টেস্টে পাকিস্তানের জয়ের পর আবদুল্লাহ শফিকের উদযাপনছবি: এএফপি

জনি বেয়ারস্টো কিংবা বেন স্টোকসের সঙ্গে তাঁর তুলনা চলে না। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মারমার কাটকাট ব্যাটিংয়ে রান তাড়া করে টেস্টে ব্যাটিংয়ের ধারাই পাল্টে দিয়েছেন তাঁরা। আবদুল্লাহ শফিককে সে তুলনায় ‘ওল্ড স্কুল’ ঘরানার বলতে পারেন অনেকে।

উইকেটে এসে খুঁটি গেড়ে বসেন, ঠুকঠুক ব্যাটিংয়ে কৌশলগতভাবে কোনো ভুল করতে চান না। এখনকার ক্রিকেটপ্রেমীরা নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। টি–টোয়েন্টির সময়ে টেস্টে এই দুই ঘরানার ব্যাটসম্যানদেরই বাজিমাত করতে দেখছেন তাঁরা।

গল টেস্টে পাকিস্তান ইতিহাস গড়ে জয়ের পর তুলনাটা উঠছে। ১ জুলাই শুরু হওয়া এজবাস্টন টেস্টে ভারতের ছুড়ে দেওয়া ৩৭৮ রানের লক্ষ্য মাত্র ৭৬.৪ ওভারে জিতে নেয় ইংল্যান্ড। জো রুট আশির ওপরে এবং বেয়ারস্টো আশি ছুঁই ছুঁই স্ট্রাইক রেটে শতক তুলে নিয়ে ম্যাচটা জেতান। ওই টেস্টের আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজেও চতুর্থ ইনিংসে আরও আক্রমণাত্মক ব্যাট করে ম্যাচ জিতিয়েছেন স্টোকস, রুট ও বেয়ারস্টো। কিন্তু আজ গলে ঠিক উল্টোটা দেখিয়েছেন আবদুল্লাহ শফিক।

ঘাম, শ্রম ও নিবেদন দিয়ে আবদুল্লাহ শফিকরা তৈরি হন
ছবি: টুইটার

শ্রীলঙ্কার এই মাঠে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান (৩৪২) তাড়া করে জিতেছে পাকিস্তান। সে জন্য খেলতে হয়েছে ১২৭.২ ওভার। মানে ৭৬৪ বল। এর মধ্যে শফিক একাই খেলেছেন ৪০৮ বল—অর্থাৎ, দলের মোট খেলা বলের প্রায় ৫৩ শতাংশই খেলেছেন পাকিস্তানি ওপেনার। তাঁর ১৬০ রানের এই ইনিংসটি ঠিক কীভাবে ব্যাখ্যা করলে প্রাপ্য মর্যাদা পাবে, তো বোঝাতে অনেকের হয়তো কষ্ট হবে।

তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা আক্ষেপ করতে পারেন। টেস্টে একজন পরীক্ষিত ‘ওল্ড স্কুল’ ধরনের ওপেনার তো এখনো পাওয়া হলো না! এমন কয়েকজন এলেও দলে থিতু হতে পারেননি কিংবা সময় লাগবে।

অথচ শফিককে দেখুন, দলকে জেতানোর তাড়না এতটাই যে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম বল ও শেষ বল—দুটোই খেললেন, অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থেকে দল জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন। এর মধ্যে ভুল বলতে পাকিস্তান জয়ের সুবাস পাওয়ার সময় শেষ দিকে ছক্কা মারতে গিয়ে ক্যাচ তোলা। এ ছাড়া পুরো ইনিংসটি যেন নিখাদ সোনার মোহর। গল টেস্টে সিলমোহর হয়ে থাকবে এই ইনিংস।

ধাতু গলিয়ে যেমন মোহর বানানো হয়, তেমনি উইকেটে পড়ে থেকে ঘাম ও শ্রমে নিজেকে গলিয়ে মোহরের মতো দামি ইনিংস শফিক আগেও খেলেছেন। এই তো গত মার্চেই করাচিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে ৫০৬ রান তাড়া করতে নেমে হারের মুখে পড়েছিল পাকিস্তান। সে টেস্টে বাবর আজমের ৪২৫ বলে ১৯৬ রানের ইনিংসটি যেমন মূল্যবান, শফিকের ৩০৫ বলে ৯৬ রানও তেমন পিছিয়ে থাকবে না। কিংবা গত বছর নভেম্বরে বাংলাদেশের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে দুটি ইনিংস (১৬৬ বলে ৫২ এবং ১২৯ বলে ৭৩)—তখনই বোঝা গিয়েছিল ২২ বছর বয়সী এই ছেলে টেস্ট ক্রিকেট থাকতেই এসেছেন আর তাঁকে দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আক্ষেপও বেড়েছে। ছেলেটির ক্যারিয়ার মাত্র ৬ টেস্টের—মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই কী দারুণ সব ইনিংস খেলে পায়ের তলায় মাটি শক্ত করে ফেললেন!

ম্যাচ শেষে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজমের কথায়ও তেমন ইঙ্গিত মিলল। তৃতীয় উইকেটে শফিকের সঙ্গে ১০১ রানের জুটি গড়েন বাবর। সে জুটির প্রসঙ্গ তুলেই বললেন, ‘শফিকের সঙ্গে ব্যাট করার সময় আমরা জুটি গড়ার চেষ্টা করেছি। সে (শফিক) নিজের জাত চিনিয়েছে।’ আর শফিক? দলে নতুন আসায় গা থেকে অভিজ্ঞতার গন্ধ যেহেতু ছোটেনি, তাই সরল কথাই বলেছেন, ‘শেষ দিনে লক্ষ্য তাড়া করতে পেরে ভালো লাগছে। রান করতে হবে—এটাই ছিল পরিকল্পনা। পিচ ব্যাটিংয়ের জন্য কঠিন হলেও সময় কাটানোর সঙ্গে সহজ হয়ে এসেছে। ওদের স্পিনাররা নতুন বলে বোলিংয়ের সময় সাহায্য পেয়েছে।’

সময় কাটানো? শফিকের ব্যাটিংয়ে এটাই সম্ভবত ‘এক্স ফ্যাক্টর।’ শুধু আজকের ইনিংসটির একটি বৈশিস্ট্য দিয়েই তা বোঝানো যায়। গত ২২ বছরে মধ্যে টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বল (৪০৮) খেলার রেকর্ড গড়েছেন শফিক। ওই যে করাচি টেস্টের কথা বলা হলো, সেখানে বাবরের খেলা ৪২৫ বলের ইনিংস ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। আর উইকেটে বেশি সময় টিকে থাকলে রান তো আসবেই। শফিকের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ টেস্ট পর্যন্ত অনেক কিংবদন্তিই তাঁর সমান রান করতে পারেননি। পাকিস্তানেরই কিংবদন্তি জাভেদ মিঁয়াদাদেরই যেমন ষষ্ঠ টেস্ট শেষে রানসংখ্যা ছিল ৬৫২। ফ্রাঙ্ক ওরেল, রঞ্জি সিংরাও শফিকের পেছনে। ষষ্ঠ টেস্ট শেষে তাঁর রানসংখ্যা ৭২০। এ পথ পর্যন্ত শফিকের চেয়ে যাঁরা এগিয়ে ছিলেন, তাঁদের নামগুলো একবার দেখুন—সুনীল গাভাস্কার (৯১২), ডন ব্র্যাডম্যান (৮৬২) ও ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’—জর্জ হ্যাডলি (৭৩০)।

উইকেটে সময় কাটিয়ে আরও কী কী বিবিধ রতন মেলে, সেটার আরও একটি তথ্য না জানালে অন্যায় হবে। পরিসংখ্যান বলছে, টেস্ট ইতিহাসে শফিকই প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি রান তাড়া করে দলের জয়ের ইনিংসে একাই ৫০০ মিনিটের বেশি সময় ব্যাট করেছেন। শফিক গল টেস্টে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করেছেন ৫২৪ মিনিট—অর্থাৎ, ৮ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট! অথচ এই একই খেলোয়াড় কি না, ২০২০ সালে টি–টোয়েন্টিতে শতক হাঁকিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নিজের খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন। পাল্টে ফেলেছেন—কথাটা বলা একটু ভুল হয়। যখন যে পরিস্থিতিতে যা দরকার, সেটা করার চেষ্টা করাই বোধ হয় শফিকের ব্যাটিংয়ের সারবস্তু।

ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ও বাংলাদেশের সাবেক কোচ গর্ডন গ্রিনিজের সঙ্গে এখনই তাঁকে এক ছাঁচে ফেলার দুঃসাহস হয়তো কেউ করবেন না। দুজনের ব্যাটিংয়ের ধাঁচও আলাদা। মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে শুধু এক জায়গায়—দুজনেই জাত ওপেনার। দলের হয়ে নিজের কাজটা যতটা সম্ভব করে আসতে চান। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্টে ৩৪২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ২১৪ রানে অপরাজিত থেকে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন গ্রিনিজ। গলে পাকিস্তান কত রান তাড়া করতে নেমেছিল? সেই ৩৪২–ই! আর শফিক হলেন গ্রিনিজের পর টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় ওপেনার, যিনি ৩০০ রানের বেশি তাড়া করতে নেমে অপরাজিত থেকে ম্যাচ জিতিয়েছেন।

আবদুল্লাহ শফিকের ব্যাটিং উঠতি ক্রিকেটারদের জন্য উদাহরণ হতে পারে
ছবি: এএফপি

তখন গ্রিনিজের বয়স ছিল ৩৩ বছর। অর্থাৎ, অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে গেছেন তত দিনে। অভিজ্ঞ সেই গ্রিনিজের কীর্তিই শফিক ছুঁয়ে ফেললেন মাত্র ২২ বছর বয়সে। সামনে এখন তাঁর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার সময়।