পুরোনো একটা বাক্য দিয়ে শুরু করা যাক—আজ সব স্রোত গিয়ে মিশবে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি)। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল এ মাঠে। তার ওপর আজ রোববার, ছুটির দিন। মেলবোর্ন শহরের ট্রেনে, ট্রামে, বাসে চড়ে মানুষজন ছুটবে এমসিজির দিকে—এটাই তো স্বাভাবিক।
যখন ফুটবল ফাইনাল হয়, ৫০ ওভারের ক্রিকেটের ফাইনাল হয় কিংবা যেখানে যে খেলার ফাইনালই হয়, ঘটনা তো এটাই। দর্শকদের স্রোত গিয়ে মেশে কোনো এক জায়গায়, যেখানে ওই ফাইনাল খেলাটা হয়।
মজার ব্যাপার হলো, মেলবোর্নে এ রকম জনস্রোত গিয়ে মেশার জায়গার অভাব নেই। ক্রিকেটের সুবাদে এমসিজির খ্যাতিই হয়তো বেশি, তবে এই শহর অন্যান্য খেলাকেও এত বেশি ঠাঁই দিয়েছে যে, ‘সিটি অব স্পোর্টস’ মেলবোর্নের আরেকটা পরিচয় ‘স্পোর্টিং ক্যাপিটাল অব অস্ট্রেলিয়া।’
ক্রিকেটের কথাই আগে বলি। মেলবোর্ন যে ভিক্টোরিয়া প্রদেশের রাজধানী, সেখানে ক্রিকেট ক্লাবই আছে এক হাজারের ওপরে। ক্রিকেটারের সংখ্যাটা কত হতে পারে, তাহলে ভাবুন। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ এমসিজির সামনে শেন ওয়ার্নের লেগ স্পিন করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্য যেন ভিক্টোরিয়ার সেই ক্রিকেট গৌরবেরই প্রতিকৃতি। আর ক্রিকেটের প্রথম টেস্ট ও প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের ভেন্যু এমসিজি তো ইতিহাসেরই স্বাক্ষী। প্রথম অ্যাশেজ সিরিজও হয়েছে এই মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডেই। তবে অ্যাশেজের জন্মস্থান বলা হয় এই শহরেরই সানবুরি এলাকাকে।
অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল (এএফএ), যেটি কিনা পরিচিত ফুটি নামে, সেটিরও প্রাণকেন্দ্র মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। আর এমসিজি থেকে হেঁটে ইয়ারা নদীর দিকে ৮–১০ মিনিট এগোলে মেলবোর্ন পার্ক। বছরে একবার এখানেও এসে মিশে যায় জনস্রোত। প্রতি জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন টেনিসের আসরটা যে মেলবোর্ন পার্কেই বসে!
মেলবোর্ন পার্ক থেকে আরও মিনিট পাঁচেক হাঁটলে অলিম্পিক বুলেভার্ড। অস্ট্রেলিয়া যখন ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক হতে চেয়েছিল, তখন বানানো হয়েছিল এই মাঠ। প্রস্তাব ছিল এখানেই হবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। কিন্তু পরে তো বিশ্বকাপের আয়োজক হয়ে যায় কাতার।
মেলবোর্নের খেলাধুলার আরেক আকর্ষণ আলবার্ট পার্ক গ্রাঁ প্রি সার্কিটে অবশ্য এমসিজি থেকে হেঁটে যেতে একটু কষ্টই হবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনের ফাঁকা রাস্তা দিয়েও গাড়িতে সেখানে যেতে ১৫–২০ মিনিট লেগে যায়। আলবার্ট লেকের পাড়ঘেঁষা এই সার্কিটেই ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবছর মার্চে হয়ে আসছে ফর্মুলা ওয়ান অস্ট্রেলিয়ান গ্রাঁ প্রি।
গ্রাঁ প্রির সময়টা ছাড়া অবশ্য কার রেসের এই ট্র্যাক সাধারণ রাস্তার মতোই। সেখানে রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, সাধারণ গাড়ি চলে, বাচ্চারা সাইকেল–স্কুটি চালায়, পাশের লেকের ধারে বেড়াতে আসে মানুষ। তবে মসৃণ আঁকাবাঁকা ট্র্যাকের আবেদনটাই এমন যে একটু ফাঁকা পেলেই স্টিয়ারিং হাতে যেকোনো চালক হয়ে উঠতে চাইবেন ফর্মুলা ওয়ান রেসার। তাঁদের নিবৃত্ত করতেই জায়গায় জায়গায় দেওয়া আছে প্রতিবন্ধকতা।
আলবার্ট পার্ক গ্রাঁ প্রির ট্র্যাক দিয়ে যেতে যেতে দুই পাশে তাকালে একটার পর একটা মাঠই চোখে পড়বে শুধু। এক মেলবোর্ন স্পোর্টস সেন্টারেই আছে কত কিছু! সেটি পেরিয়ে এলে বাস্কেটবল, হকি, ফুটবল, ক্রিকেট, বোলিং—কী নেই আলবার্ট লেকের পাড়ে!
ছুটির দিনে এসব মাঠের একাডেমিতে বাচ্চাদের নিয়ে আসেন বাবা–মায়েরা। একাডেমিতে না খেললেও সমস্যা নেই। মেলবোর্ন শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই খোলা জায়গা গ্রাঁ প্রির সময়টা ছাড়া উন্মুক্ত সবার জন্যই।
এত মাঠ, খেলার এত সুযোগ সেই শহরে; সেখানে খেলতে কার না মন চাইবে! ‘স্পোর্টস সিটি মেলবোর্ন’ তাই শুধু খেলারই শহর নয়, খেলানোরও শহর। আর মেলবোর্নের মানুষের রক্তে খেলাটা এমনভাবে মিশে আছে যে প্রয়াত অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক ও লেখক কিথ ডানস্টান খেলাধুলায় এই শহরের মানুষকে তুলনা করেছেন পিরানহা মাছের সঙ্গে। কারণ, লড়াইয়ে জেতার ক্ষুধা মেটাতে এই শহরের মানুষ নাকি যেকোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকেই স্রেফ গিলে ফেলে!