লাফ দেওয়ার আগে ‘বাঘ’ তো একটু পেছাবেই
পিটার ডেলা পেনা ইএসপিএনক্রিকইনফোর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ গতকাল তাঁর পোস্ট দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা একগাল হেসে নিতে পারেন, ‘টেক্সাসে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে বাংলাদেশকে। বিশ্বাস করুন।’
ডেলা পেনার পোস্ট অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য। তবে সেটি ব্র্যাকেটবন্দী করে লিখে দিলে ভালো হতো। কারণ, পোস্টটি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছেও পৌঁছেছে। তাতে হাসির রোল উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে এই দেশের সমর্থকেরা যেকোনো পরিস্থিতির জন্যই তৈরি থাকেন। তাই আসলে লিখে বিশ্বাস করানোর কিছু নেই। পরিস্থিতি এমন যে কিছু ঘটার আগেই মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া থাকে। আসলে অভিজ্ঞতা থেকে শেখা তো!
হংকং, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, স্কটল্যান্ড অতীতে এই একই ‘অভিজ্ঞতা’ উপহার দিয়েছে। গতকাল রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারটা একটু বেশি বেশি হয়ে গেলেও স্বাদটা তো একই—হার। তাই খুব একটা ব্যথা লাগার কথা নয়। ব্যথায় ব্যথায় এত দিনে সয়ে যাওয়ার কথা। আর যাঁরা এখনো সহ্য করে নিতে পারেননি, তাঁরাই–বা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে করবেনটা কী! ঘুরেফিরে ঠিকই ম্যাচের দিন আবার চোখ রাখতে হবে। এই ‘বন্ধন’ অনেকটাই পারিবারিক। কখনো কখনো আপনি ছুড়ে ফেলবেন, কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না সে বা তাঁরা আপনার নয়! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম মুখরোচক পোস্টে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ভান করে তাই লাভ নেই। ফিরতে যে হবেই।
আর কী-ইবা এমন হয়েছে বলুন তো! টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে ৯ম ও টেস্ট খেলুড়ে দেশ হেরেছে র্যাঙ্কিংয়ে ১৯তম এক সহযোগী দেশের কাছে। দুর্ভাগ্যবশত এই হারে আপনি টেস্ট খেলুড়ে দেশটির সমর্থক তাই তো! আচ্ছা, এবার বলুন তো, অন্য সময় যে আমরা খুব বড়াই করে বলি ‘ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা’—এই বেলা কথাটা মানতে আপত্তি কোথায়? নাকি কথাটা শুধু বাংলাদেশের জয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? তাহলে কিন্তু আর বড় দল হয়ে ওঠা হবে না। বড় দল এবং সেই দলের বড় সমর্থক হয়ে উঠতে চাইলে ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখতে হবে।
বাংলাদেশ দল সেই চর্চাটা সম্ভবত বেশ আগে থেকেই শুরু করেছে। কাগজে-কলমে শক্তিতে ছোট কোনো দলের কাছে হারের পর বাংলাদেশের অধিনায়কেরা কিন্তু কখনোই ‘গেল, গেল’ রব তোলেন না। তাঁরা ক্রিকেটীয় যুক্তিতে ব্যাপারগুলো বোঝানোর চেষ্টা করেন। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন যেমন গতকালের হারের পর বলে গেলেন সেই মুখস্থ ‘সাপের মন্ত্র’—‘আমরা ব্যাটিংয়ে ভালো করিনি। ভালো শুরুর পর মাঝে উইকেট পড়েছে। আরও ২০টি রান করতে পারলে সংগ্রহটা ভালো হতো...আশা করি পরের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াব।’
নিশ্চিত করে বলা যায়, এমন কথা বাংলাদেশ অধিনায়কের মুখে আপনি বহুবার শুনেছেন। সেটা হোক ছোট দল কিংবা বড় দলের বিপক্ষে হার—অধিনায়কেরা প্রায় কখনোই কথার ছাঁচ পাল্টাননি। ওই তো কথায়ই তো আছে, ভদ্রলোকের এককথা!
ভদ্রলোকেরা অন্যদের ব্যর্থতা-খামতি গোপন করেন। ভালো মানুষ হওয়ার এটাও অন্যতম বড় গুণ। বাংলাদেশ অধিনায়ককে এ জন্য ঠকাস করে একটা স্যালুট। আরও ‘২০টি রান’ করতে না পারার আক্ষেপের বর্মে কত কিছু যে তিনি আড়াল করলেন!
যুক্তরাষ্ট্রের বোলাররা মাত্র ৪৫টি ‘ডট’ আদায় করার পরও স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশের রান দেড় শর আশপাশে। ‘মিস্টার এক্সট্রা’র ১২ বাদ দিলে রানটা আসলে ১৪১। এর মধ্যে বাউন্ডারি থেকে এসেছে প্রায় অর্ধেক রান—৭২। গোটা ইনিংসে ৪টি ছক্কা ও ১২টি চার মেরেছে বাংলাদেশ। বাকি রানগুলো এসেছে সিঙ্গেলস-ডাবলসে।
বাংলাদেশের বোলাররা ডট আদায় করেছেন ৪৮টি। কিন্তু ‘মিস্টার এক্সট্রা’ গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই সমান ১২। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ব্যাটে রান তুলেছে ১৪৪। বাউন্ডারি থেকে এসেছে ৭৬। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পারফরম্যান্স দেখে বোঝার উপায় নেই কে টেস্ট খেলুড়ে আর কে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অভিষেকের অপেক্ষায়!
ওহ, বলাই হয়নি বাংলাদেশের বোলাররা ওয়াইড দিয়েছেন ৭টি। একটি সহযোগী দেশের বোলাররা ৫টি নো ও ৬টি ওয়াইড বল করলে ব্যাপারটা তেমন গায়ে লাগার কথা নয়। কিন্তু টেস্ট খেলুড়ে দেশের তারকা বোলাররা ৭টি ওয়াইড দিলে সেটি গায়ে লাগতে পারে। সেটাও যদি টেস্ট খেলুড়ে প্রতিপক্ষ হতো, তা–ও না হয় বোঝা যেত মানসিক চাপে ডেলিভারি বেগড়বাই হয়েছে। সম্ভবত এই চাপটা উল্টো এবং সেটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তুলনামূলক ছোট দলগুলোর বিপক্ষেই চাপটা বেশি থাকে। ক্রিকেটারদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রত্যাশার চাপটা সমর্থকদের তৈরি করা, ক্রিকেটারদের নয়।
প্রতিপক্ষ যে-ই হোক, কোনো সিরিজ বা টুর্নামেন্টের আগে বাংলাদেশের কোনো অধিনায়ক-ই ‘এটা করব, সেটা করব’ ধরনের কথা বলেন না। ‘ক্রিকেট গোল গুটির (বল) খেলা, যেকোনো কিছুই হতে পারে...’—একদম ব্যাকরণ মেনে ভদ্রস্থ এই কথা বাংলাদেশের এক তারকা ক্রিকেটারই বলেছেন বহু আগে। নিন্দুকেরা বলতে পারেন, বলেকয়ে কিছু করার সামর্থ্য থাকলে তো! নিন্দুকদের মুখে ছাই। প্রতিপক্ষ যত কম শক্তিরই হোক, আগ বাড়িয়ে বলে পরে কিছু করতে না পারাটা আর যা–ই হোক ভদ্রলোকের পরিচয় নয়। আর কে না জানে, ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা।
সেই খেলায় গতকাল রাতে অভদ্রোচিত কিছুই করেনি বাংলাদেশ। খেলায় হারজিত থাকেই। দল তার বাইরে যায়নি। বলবেন, ভুল তো করেছে। সেটা কে করে না! যুক্তি দেবেন, শেষ ওভারে যখন ৬ বলে ৯ রানের সমীকরণ তখন ‘পার্টটাইম’ বোলার মাহমুদউল্লাহকে আনা হলো কেন? সাকিব আল হাসানকে দিয়ে করানো যেত। তাঁর ১ ওভার বাকি ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়ক পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, মাহমুদউল্লাহ আগের ২ ওভারে মাত্র ৯ রান দিয়েছেন। সাকিব ৩ ওভারে দিয়েছেন ১৬। তাহলে ওভারপ্রতি গড়ে রান কে বেশি দিয়েছেন? সাকিব। শেষ ওভারে কাজটা যেহেতু রান আটকানোর, তাই সাকিব নয় মাহমুদউল্লাহই সঠিক পছন্দ। আর বল হাতে দিনটাও ভালো যাচ্ছিল মাহমুদউল্লাহর।
কথায়ই আছে, টি-টোয়েন্টিতে ছোট-বড় দল বলে কিছু নেই। ম্যাচের দিন যারা ভালো করবে, তারাই জয়ী। মাহমুদউল্লাহ ভালো করছিলেন। বোলার সাকিবের সুবিশাল অভিজ্ঞতা তাই হয়তো পরের ম্যাচের জন্য তুলে রেখে টি-টোয়েন্টির ‘ব্যাকরণ’ মেনেছেন নাজমুল। মাহমুদউল্লাহ এখন শেষ ওভারে গিয়ে রান দিয়ে ফেললে কী করার আছে! ক্রিকেট তো গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে—অন্য সময় এসব কথা মানলে এখন তবে অধিনায়ককে কাঠগড়ায় তোলা কেন?
কাঠগড়ায় যদি কাউকে তুলতে হয় তবে সমর্থকদের তোলাই নিরাপদ। যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের নিজেদের সামর্থ্যের ওপর আস্থা রাখার খোঁজটুকু তাঁরা না রেখেই প্রত্যাশার ঝাঁপি সাজিয়েছিলেন। ম্যাচ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের হারমিত সিংয়ের কথাগুলো শুনতে পারেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম মোস্তাফিজ বাতাসের বিপরীতে বোলিং করবেন। কিন্তু যখন দেখেছি বাতাসের অনুকূলে বোলিং করতে, তখন ভেবেছি, অন্য প্রান্ত থেকে কোনো ওভারে ২০ রান নেওয়ার সুযোগ আছে আমাদের...মোস্তাফিজের ৪ ওভার শেষ করে দেওয়ায় আমরা শেষ ওভারে ২০ রানও নিতে পারব—এমন বিশ্বাস ছিল।’
আত্মবিশ্বাস যেখানে ২০ রানের, সেখানে শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল মাত্র ৯। বাকিটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। তবে কৌশলগত একটি ব্যাপার জানিয়ে রাখা ভালো, হারমিত মনে করেন মোস্তাফিজকে বাতাসের অনুকূলে বোলিং করিয়ে বাংলাদেশ ভুল করেছে। মোস্তাফিজ বাতাসের অনুকূলে বোলিং করায় অন্য বোলাররা করেছেন বাতাসের বিপরীতে। প্রেইরি ভ্যালির বাতাসের তোড়ের বিপরীতে কাজটা কঠিন ছিল, তাতে রান তুলতে সুবিধা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বল তুলে খেললে বাতাস-ই তো সেটাকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে! মোস্তাফিজ ১৯তম ওভার বাতাসের অনুকূলে করার পর মাহমুদউল্লাহ শেষ ওভারটি করেছেন বাতাসের বিপরীতে।
কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়ক পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, বাতাসের বিপরীতে কিংবা অনুকূলে এই প্রথম বোলিং করেনি বাংলাদেশ। আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই কৌশলটা অমন ছিল। আসল ব্যাপারটা হলো দিন—টি-টোয়েন্টিতে যেদিন যার! গতকাল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সেটাও দীর্ঘ তিন যুগ অপেক্ষার পর।
টেক্সাসে গতকাল ম্যাচ চলাকালে ধারাভাষ্যকারেরা বলছিলেন—‘১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিকেট একই জায়গায় ছিল।’
নাইরোবিতে সেবার আইসিসি ট্রফিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে ১৪৫ রান তাড়া করতে নেমে একপর্যায়ে ৭৩ রানে ৬ উইকেট হারিয়েছিল বাংলাদেশ। আকরাম খানের ৬৪ রানের অপরাজিত ইনিংসে অবশেষে রক্ষা। তখন তো টি-টোয়েন্টি ছিল না, তবে দিনটা ছিল বাংলাদেশের। ৩০ বছর পর গতকাল তেমনই একটা দিন পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এই যা! তাতে কোনো কিছু অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিযানও শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়নি। বরং মনে মনে একটি মিল খুঁজে নিতে পারেন। তবে সেটি কাউকে বলাটা বিপজ্জনক হতে পারে। অন্তত আগে শুনে নেওয়া ভালো বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি কোন দলের সমর্থক।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপেই প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্যাপারটি আন্তর্জাতিকভাবেও পরিচিতি পেয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেও আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়তো থাকবেন দু-একজন। এই আর্জেন্টিনা কিন্তু কাতার বিশ্বকাপ জেতার আগে প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরেছিল।
এটুকু পড়েই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলার প্রয়োজন নেই। একটু ‘বাধা’ থেকে যায়।
সেটা হলো, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এখনই শুরু হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সিরিজ খেলে ২ জুন (বাংলাদেশ সময়) থেকে শুরু হতে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নেবে বাংলাদেশ। প্রথম দুটি ম্যাচ ডালাস ও নিউইয়র্কে। তবে অন্যভাবে ভাবলে একটি ইঙ্গিতও মেলে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভেন্যু যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম দুটি ম্যাচও খেলবে যুক্তরাষ্ট্রেই। আর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এই সিরিজকে ধরা হচ্ছে সেই বিশ্বকাপেরই প্রস্তুতি। অর্থাৎ ‘প্রস্তুতি’ শব্দটি বাদ দিলে বিশ্বকাপ অভিযানে বাংলাদেশ এক অর্থে প্রথম ম্যাচটা খেলেছে গতকাল। বাকিটা নিজ দায়িত্বে ভেবে নেওয়াই নিরাপদ।
লিওনেল মেসিরা সেবার লাফ দিয়ে বিশ্বকাপ ধরার আগে সৌদি আরবের বিপক্ষে একটু পিছিয়েছিলেন। তেমনি ওত পেতে থাকা বাঘও শিকার ধরতে লাফ দেওয়ার আগে একটু পিছিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে। কথাটা এমনিতেই বলা। ভাবনার খোরাক আরকি। ঘটনা যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। এখন ভাবনা-কল্পনা ছাড়া আর কী-ইবা করার আছে!