২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দলের চিকিৎসা কী

টি–টোয়েন্টিতে সমস্যাগুলো কি ঠিক করতে পারবে বাংলাদেশছবি: এএফপি

দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ততক্ষণে মেলা ভেঙেছে। সুউচ্চ গ্যালারি আর বিশাল বাউন্ডারির মাঝে মাঠ কর্মীরা পানি ঢালছেন। দৃশ্যটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন স্টেডিয়ামেরই এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাঁর বাড়ি রাজশাহী।

মাত্রই বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিয়েছে। শূন্য স্টেডিয়ামের দিকে তাঁর হতাশ দৃষ্টির কারণ আর অনুমান করতে হলো না।

আরও পড়ুন

এমন একটা ফাঁকা ক্যানভাসেই নতুন করে টি-টোয়েন্টির ছক আঁকার চেষ্টা করছেন সাকিব আল হাসান। সেটির শুরু হয়েছে এশিয়া কাপ দিয়ে। এক এক করে তিনি টি-টোয়েন্টির রোগ নির্ধারণ করবেন। চেষ্টা করবেন সেগুলো শুধরানোর। সে জন্য যদি এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খারাপও করে, তাতেও আপত্তি নেই। সাকিবের লক্ষ্য, দলটাকে নতুন করে গড়া। সে জন্য যে শক্ত গাঁথুনি দরকার, সেটা তো এক-দুই ম্যাচে গড়া সম্ভব নয়।

ব্যাটিংয়ে বাড়াতে হবে রান তোলার গতি
ছবি: এএফপি

সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেগুলোর মধ্যে এক নম্বর—ব্যাটসম্যানদের মন্থর ব্যাটিং। এ প্রসঙ্গটা এলেই সাকিবের একটা কথা খুব মনে পড়ে। গত বছর বিশ্বকাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ দল এমন উইকেটে খেলেছে, যেখানে খেললে ‘ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে’ বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সাকিব। কাগজে কলমে এখনো কারও টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার শেষ না হলেও কাছাকাছি পর্যায়ে এসেছে ঠিকই।

আরও পড়ুন

সেটা কীভাবে? মুশফিকুর রহিমকে দিয়েই উদাহরণটা দেওয়া যায়। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মুশফিক ৪৪ ইনিংসে ব্যাটিং করেছেন। ১২০ স্ট্রাইক রেট ও ২০ গড়ে রান করেছেন ৭৬২। বাংলাদেশ দলের টি-টোয়েন্টি মান ও উইকেটের চরিত্র বিবেচনায় মুশফিকের পারফরম্যান্স ভালোই ছিল। গত দুই বছরে স্ট্রাইকরেট কমে এসেছে ৯৩-এ, গড় ২১। শুধু মুশফিক নন, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ নাঈম—প্রত্যেকের স্ট্রাইক রেটে পড়েছে ভাটার টান।

ভাটার টান পড়েছে মাহমুদউল্লাহদের স্ট্রাইক রেটে
ছবি: এএফপি

মরা উইকেটে খেলার আগে লিটনের স্ট্রাইক রেট ছিল ১৪০ এর আশপাশে। সেটি এখন ১২০ এর ঘরে এসে ঠেকেছে। সৌম্য আগে থেকেই মন্থর উইকেটের দুর্বল ব্যাটসম্যান। সেবার এতটাই মন্থর উইকেটে খেলানো হয়েছে যে, ব্যাটিং ছন্দটাই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম! অথচ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠের সেই সিরিজের আগে সৌম্য ছিলেন জিম্বাবুয়ে সফরের সেরা ক্রিকেটার। এখন সেই সৌম্য জাতীয় দলে নেই। নাঈমও বাদ পড়েছেন। কিন্তু আবার ফিরেছেন দলে চোটের মিছিলে। এনামুল হকও ২০১৫ সালের পর টি-টোয়েন্টি দলে ফিরেছেন বাকিদের ব্যর্থতায়।

আরও পড়ুন

দুর্ভাগ্য, এনামুল-নাঈম জুটিও ব্যর্থ। এক এক করে ওপেনার হারিয়ে বাংলাদেশ যখন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন সাব্বির রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজকে উদ্বোধনে খেলায়। ফাটকা লেগেও যায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ দল পাওয়ার প্লেতে পেয়েছে ৫৫ রান। কিন্তু এই বাজি যে প্রতিদিন কাজে আসবে না সেটা টিম ম্যানেজমেন্টও জানে। প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার মূল পেসারদের কেউই খেলেননি। মূল বোলাররা খেললে যে পাওয়ারপ্লে রানের সংখ্যাটা যে আরও কমে আসত, সেটি বুঝতে ক্রিকেটবোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এবার একবার ভেবে দেখুন, এমন ঘোর বিপদের শুরুটা সেই গত বছরের বাজে উইকেট থেকে। যার পরিণতি সাব্বির-মিরাজের ‘অবিশ্বাস্য’ যুগলবন্দী। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়! কাল সাকিব যেমন হতাশা থেকেই বলছিলেন এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনের কারণ, ‘মিরাজ সব সময় ওপেনিংয়ের চিন্তায় ছিল, যেহেতু আমরা তেমন কার্যকর কাউকে পাচ্ছিলাম না।’

কাল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওপেন করেন সাব্বির ও মিরাজ
ছবি: এএফপি

একটা দেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কোনো বিশেষজ্ঞ ওপেনার নেই, ভাবা যায়! তামিম ইকবালের টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায়, লিটনের চোট—আর তাতেই ওপেনিং দুর্ভিক্ষে দল। দুটি সিরিজে বাজে উইকেটে খেলার সিদ্ধান্ত কত বড় ক্ষতিই না করল ক্রিকেটের।

এ তো গেল ব্যাটিং দৈন্যর কথা। বাজে উইকেটে খেলে ঘরের মাঠে মোস্তাফিজুর রহমানের রেকর্ড হয়েছে চোখ কপালে তোলার মতো। গত দুই বছর ঘরের মাঠে তাঁর ইকোনমি ৫, গড় ১২। আর দেশের বাইরে ইকোনমি ওভার প্রতি ১০ এর কাছাকাছি, গড় ২৫। নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ইকোনমি ৯ এর ঘরে হলেও গড় ৪৯! বাজে উইকেটে খেলিয়ে ক্যারিয়ারের দারুণ শুরুর পর শরীফুল ইসলামের বোলিংয়েরও বেজেছে বারোটা। এখন তিনি দলের বাইরে। আর মিরপুরের মরা উইকেটে তাসকিন আহমেদ ও ইবাদত হোসেনদের মতো ফাস্ট বোলারদের একাদশে জায়গাই হয় না। টি-টোয়েন্টি সুলভ উইকেটে তাদের খেলার অভিজ্ঞতাও কম। ভালো উইকেটের বোলিং কি জিনিস, সেটা এভাবেই ভুলতে বসেছে বাংলাদেশ দলের পেসাররা।

ডেথ ওভারে মোস্তাফিজের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না বাংলাদেশ
ছবি: এএফপি

সে জন্যই ডেথ ওভারে অধিনায়ক সাকিবকে খুঁজতে হয় শেখ মেহেদী হাসানকে। অফ স্পিনার হিসেবে তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ডেথ ওভারে বোলিং করেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এত বড় ঝুঁকিটা নিতে সাকিব বাধ্য হয়েছেন পেসারদের ওপর আস্থাহীনতার জায়গা থেকে। মোস্তাফিজকে বলা হয় বাংলাদেশের সেরা ডেথ বোলার। কিন্তু শারজায় নজিবুল্লাহ জাদরানের হাতে মার খাওয়ার পর সাকিব আর কাল মোস্তাফিজের হাতে ডেথ ওভারে বল দিতে চাননি। তাসকিন আগে থেকেই ডেথ ওভারে খরুচে বোলার। হাতে থাকেন অভিষিক্ত ইবাদত ও মেহেদী। অধিনায়কের এই হাতবাঁধা অবস্থা হতো না যদি মোস্তাফিজদের টি-টোয়েন্টিসুলভ উইকেটে নিয়মিত বোলিংয়ের অভ্যস্ততা থাকত।

বড় রানের ম্যাচের চাপ সামলানোও অভিজ্ঞতার ব্যাপার। ১২০ বনাম ১২০ ম্যাচ খেলে খেলে বাংলাদেশ দলের টি-টোয়েন্টি ভাবনায় মরিচা ধরেছে। সে জন্য বড় রানের চাপের মুখে বোলিং-ব্যাটিংয়ের সমীকরণটা ঠিক থাকে না। এ ধরনের ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের হয় শুধু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতেই। অথচ চাপ সামলানোর এই পরীক্ষাটা ক্রিকেটারদের ঘরোয়া ক্রিকেটেই হওয়ার কথা।

শ্রীলঙ্কার সামনে চাপে ভেঙে পড়েছে বাংলাদেশ দল
ছবি: এএফপি

কিন্তু ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি বলতে যে বিপিএলকে ধরা হয়, সেটিও হয় মন্থরতম উইকেটে। বড় রান করার অভ্যাসটা তাহলে হবে কোথায়? ওভার প্রতি দশ বা তার বেশি রানের পেছনে ছোটার যে অভ্যস্ততা, সেটি তো আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে তৈরি হবে না। বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের যে চাপ, সেটার সঙ্গে অন্তত কিছুটা হলেও মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা পাওয়া সম্ভব তাতে। কিন্তু এমন ভরাডুবির পরও যদি আগামী বিপিএলটা হয় সেই ভাঙা উইকেটে, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে কি করে সেটাই এখন আসল প্রশ্ন।

আরও পড়ুন

সাকিবের কাছে তো আর আলাদিনের চেরাগ নেই, যা দিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে হাতে গোনা কিছু ম্যাচ খেলেই বদলে যাবে টি-টোয়েন্টির চিত্র। এশিয়া কাপে ব্যর্থতার পর হয়তো নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দলে পরিবর্তন আসবে। মুশফিক, মাহমুদউল্লাহদের জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। চোট থেকে ফিরবেন নুরুল হাসান, লিটন দাস, ইয়াসির আলী ও হাসান মাহমুদরা। তাতে হয়তো টি-টোয়েন্টির ছবিটা হুট করেই বদলে যাবে না। কারণ নুরুল-লিটনরা চোটে পড়ায় নতুন কাউকে তো আর সুযোগ দেয়নি বাংলাদেশ। ঘুরে ফিরে সেই মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর অভিজ্ঞতার আঁচলেই আশ্রয় বাংলাদেশের। আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বাড়াতে হবে বেঞ্চের শক্তি।

কিন্তু নতুনদের উঠে আসার মঞ্চটাই যে নেই! গোড়ার গলদ না শুধরালে এই কথাগুলোই নতুন করে বলা হবে টি-টোয়েন্টির বৈশ্বিক আসরের পর। তার আগে টি-টোয়েন্টি সমস্যার চিকিৎসা হবে কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।