শরীফুল–আগুন নিভে গেল বৃষ্টি আর ইয়াং–ল্যাথামে
বিজয় দিবসের রাতে ইস্ট লন্ডনে মেয়েদের তোলা জয়ধ্বনি তখনো মিলিয়ে যায়নি। এরই মধ্যে আজ ভোরে নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে শরীফুল ইসলামের আগুন ঝরানো প্রথম ওভার। ৫ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বৃষ্টিস্নাত দিনের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের ড্রেসিংরুম হয়ে পড়ছিল আরও জবুথবু।
ম্যাচের প্রথম বলে উইল ইয়াংয়ের ব্যাটে চার খেয়ে চতুর্থ বলেই শরীফুল উল্লাসে উদ্বাহু। অফ স্টাম্পের ওপরে বল ছিল। রাচিন রবীন্দ্র কি একটু খোঁচা মারতে গেলেন! যা–ই হোক, ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বল জমা পড়ল উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিমের হাতে। ওভারের শেষ বলে আবারও বাংলাদেশ দলের উদ্যাপনের মধ্যমণি বাঁহাতি শরীফুল। দ্বিতীয় স্লিপে এবার হেনরি নিকোলসের দুর্দান্ত এক ক্যাচ নিলেন এনামুল হক বিজয়।
ডানেডিনের বৃষ্টি সময়মতো খেলা শুরু হতে দেয়নি। খেলা শুরু হতে হতে নির্ধারিত সময়ের পর পেরিয়ে যায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ১০ মিনিটে)। ৫০ ওভারের ম্যাচ নেমে এসেছিল ৪৬ ওভারে। তবে বৃষ্টির ঝাপটা ওখানেই থামেনি। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের সময়ই আরও দুবার খেলা থেমেছে বৃষ্টির কারণে। ম্যাচটা তাই শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩০ ওভারের।
যখনই বৃষ্টি থেমে খেলা শুরু হয়েছে, তখনই কমিয়ে আনা হয়েছে ম্যাচের দৈর্ঘ্য, সঙ্গে কিউই ব্যাটসম্যানরা ব্যাটে তুলতে চেয়েছেন ঝড়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ঝড়টা তুলেছেন নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক টম ল্যাথাম এবং ওপেনার উইল ইয়াং। ল্যাথাম শেষ পর্যন্ত ৯২ রানে আউট হয়ে গেলেও ইয়াং ফিরেছেন ওয়ানডেতে নিজের তৃতীয় শতক নিয়েই।
এর আগে বৃষ্টিভেজা কন্ডিশনের সুবিধা নিতে টসে জিতে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হাসান নেন ফিল্ডিং। প্রথম ওভারে শরীফুলের ওই দুই উইকেট যেন অধিনায়কের সিদ্ধান্তটাকেই হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করল।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিশ্বের তিন মাঠে বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনে যার শুভ সূচনা করেছে মেয়েরা। কাল রাতে মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৫০ রান করে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকার মেয়েদের বিপক্ষে তিন ওয়ানডের সিরিজ শুরু করেছে ১১৯ রানের বিশাল জয়ে। আইসিসি উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ এই ম্যাচ জিতে ৩ ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়ে গেলেন ১-০ তে।
বাংলাদেশ সময় ভোরে নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে শুরু হয় বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথমটি। এখন অপেক্ষা বেলা সাড়ে ১১টায় দুবাই ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে শুরু হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ ফাইনালের জন্য। বাংলাদেশের যুবাদের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক সংযুক্ত আরব আমিরাত অনূর্ধ্ব-১৯ দল। ভালো খবরের আশা থাকবে সেখান থেকেও।
তারও আগে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ডানেডিনে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটি দেখার জন্য। খেলার শুরুটা দেরি করিয়ে দেওয়ার পরও বৃষ্টি দুবার বাধা হয়েছে নিউজিল্যান্ডের ৭ উইকেটে করা ২৩৯ রানের ইনিংসে। ডিএলএস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের লক্ষ্যটা অবশ্য ৩০ ওভারে ২৪৫ রানের।
শরীফুলের অমন শুরুর পরও কিউইরা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে ওপেনার ইয়াং আর অধিনায়ক টম ল্যাথামের কৃতিত্বে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে দুজনই করেছেন সতর্ক ব্যাটিং। বৃষ্টির বাধা টপকে ১৭১ রানের তৃতীয় উইকেট জুটিতে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসটা এগিয়ে নিয়েছেন তাঁরাই। অবশ্য এ জন্য সৌম্য সরকারকেও একটা ‘ধন্যবাদ’ দিতে পারেন ল্যাথাম।
ইনিংসের দশম ওভারের প্রথম বলে নিজের রান যখন ১৮, মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়তি বাউন্স পাওয়া বলে প্রথম স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন ল্যাথাম। সৌম্য লাফিয়ে উঠে শুধু হাতই ছোঁয়াতে পারলেন বলটাতে, ক্যাচ নিতে পারলেন না। অথচ ল্যাথাম ওই বলে আউট হলে ইয়াংয়ের সঙ্গে তাঁর জুটিটা শেষ হয়ে যেত মাত্র ৩০ রানে।
সেটি হয়নি, পরে কাজে লাগেনি ইয়াংয়ের বিপক্ষে নেওয়া রিভিউও। পেসার মাহমুদুল হাসানের বলে কট বিহাইন্ড চেয়ে রিভিউ নিয়েছিলেন অধিনায়ক নাজমুল। কিন্তু আল্ট্রা এজ দেখাল ব্যাটে কোনো স্পর্শই লাগেনি বলের। মোস্তাফিজের করা এর পরের ওভারেই বৃষ্টি, তবে তার ঠিক আগে ইয়াংয়ের বাউন্ডারি যেন আরেকবার জানিয়ে দিল, নিউজিল্যান্ড ভালোভাবেই ফিরে আসছে খেলায়।
ইনিংসের ১৩.৫ ওভার পর প্রথমবার বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়ার সময় নিউজিল্যান্ডের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৬৩ রান। পৌনে এক ঘণ্টার বিরতির পর ৪৬ ওভারের ম্যাচও নেমে এসেছিল ৪০ ওভারে। কিন্তু ৬ ওভার ৩ বল খেলা হয়েই আবার বৃষ্টি। মাঝের এই সময়টায় নিউজিল্যান্ডের দুই ব্যাটসম্যানই রানের প্রবাহ বাড়িয়ে নিয়েছেন।
১৯.২ ওভার পর দ্বিতীয়বার বৃষ্টিতে খেলা থামার আগে নিউজিল্যান্ডের রান ১০০ পেরিয়ে ১০৮, অর্ধশত হয়ে যায় ল্যাথামের। ১২তম কিউই ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে করে ফেলেন চার হাজার রানও। ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর আবার খেলা শুরু হলে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসে ৩০ ওভারে। এই দফা দুই কিউই ব্যাটসম্যান আগ্রাসী হয়ে ওঠেন আরও। জুটিটা ১৫০ ছুঁয়ে ফেলে শরীফুলের করা ২৪তম ওভারে।
বৃষ্টি থামার পরের ওভারেই সৌম্যর বলে উইকেটকিপার মুশফিকের মাথার ওপর দিয়ে স্কুপে ছক্কা মেরেছেন ল্যাথাম। আরেকটি দারুণ স্কুপে সৌম্যকে ওই ওভারেই ছক্কা মেরেছেন ইয়াংও। মিরাজকে মারা ল্যাথামের ছক্কা গিয়ে পড়েছে ইউনিভার্সিটি ওভালের কার পার্কে। পরের ওভারের শেষ তিন বলে সৌম্যকে পরপর তিন বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন ল্যাথাম।
বুঝতেই পারছেন, বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের হাইলাইটসে এ পর্বটাই প্রাধান্য পাবে বেশি। প্রায় প্রতি ওভারেই একের বেশি চার-ছক্কা। ২৫তম ওভারে ল্যাথাম আর ইয়াংয়ের বলে দুই ছক্কা খেতে হয়েছে ওই ওভারেই প্রথম বোলিংয়ে আসা আফিফ হোসেনকেও। ওই একটি ওভার করেই তিনি দিয়েছেন ১৭ রান। সৌম্যর করা ২৮তম ওভারে এসেছে চার বাউন্ডারিতে ১৮। চারটিই মেরেছেন ইয়াং।
৩ ছক্কা আর ৯ বাউন্ডারিতে ৭৭ বলে ৯১ রান করা ল্যাথাম শেষ পর্যন্ত ফিরেছেন মিরাজের বলে বোল্ড হয়ে। ব্যাটের ভেতরের কানায় বল লেগে স্টাম্প ভেঙেছে কিউই অধিনায়কের। তার আগে ইয়াংয়ের সঙ্গে হওয়া তাঁর ১৭১ রানের জুটিটা বাংলাদেশের বিপক্ষে যেকোনো উইকেটে নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
ল্যাথাম ফিরে যাওয়ার পর ইয়াংয়ের সঙ্গে দলে রানটাকে গতিশীল রাখার দায়িত্ব নেন মার্ক চ্যাপম্যান। দুজন মিলে ২৭তম ওভারেই ২০০ পার করিয়ে দেন নিউজিল্যান্ডকে। ১১ বলে দ্রুতলয়ে ২০ রান করে ফিরে যান চ্যাপম্যান, তবে ইয়াং ফিরছেন তাঁর তৃতীয় ওয়ানডে শতক করেই।
শেষ দিকে দ্রুত রানের জন্য ছুটতে গিয়ে ইয়াংসহ নিউজিল্যান্ডের চার ব্যাটসম্যানই রান আউট হয়েছেন। কিন্তু তাতে কী! ৩০ ওভারের ম্যাচেই যে বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো একটা লক্ষ্য দেওয়া গেছে। বারবার বৃষ্টির বাধা আর কিউই ব্যাটসম্যানদের চার-ছক্কার ঝড়ে শরীফুলের আগুন ঝরানো প্রথম ওভার তখন সুদূর অতীত।