বয়সকে শুধুই ‘সংখ্যা’ বানানো অ্যান্ডারসনই অনুপ্রেরণা ওমানের বিলালের
শচীন টেন্ডুলকার ভর করেছিলেন বীরেন্দর শেবাগের ওপর। ব্যাটসম্যান শেবাগকে তাঁর ক্যারিয়ারের শুরুতে শচীনের ‘ক্লোন’ বলতেন অনেকেই। পরে তো শেবাগ শেবাগ হলেন। কিন্তু টেন্ডুলকারের মতো শেবাগের ব্যাটিংয়ের নেপথ্যে কী ছিল?
অবশ্যই প্রেরণা। মজার ব্যাপার হলো, ক্রিকেট মাঠে এমন ‘প্রেরণা’র নিদর্শন দেখে বোঝা যায়। যেমন ধরুন, আমরা খেলা দেখে বলি, অমুকের ব্যাটিং কিংবা বোলিং তমুকের মতো। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু ‘প্রেরণা’র উদাহরণ আছে, যা দেখে বোঝা যায় না। বড়জোর কল্পনা করে নেওয়া যায়, যতক্ষণ না খেলোয়াড় নিজে বলেন।
প্যাঁচ লাগছে নিশ্চয়ই। খুলে বলা যাক। ওমানের ৩৭ বছর বয়সী পেসার বিলাল খানকে দেখে কেউ কেউ হয়তো ভেবেছেন, এই বয়সেও ক্রিকেট খেলছেন! নিশ্চয়ই খেলাটির প্রতি ভালোবাসা থেকে। সে তো বটেই। কিন্তু এই বয়সেও বিলালের খেলে যাওয়ার প্রেরণা তো কিছু একটা আছেই। একটু ভুল হলো। কিছু একটা নয়, কেউ একজন। সে পারলে আমি কেন পারব না...এমন।
কিন্তু এটা তো আর ব্যাটিং কিংবা বোলিং নয় যে দেখেই বোঝা যাবে, অমুক তাঁর প্রেরণা। বিলাল খান নিজ থেকে বলায় জানা গেল এই বয়সেও তাঁর ক্রিকেট খেলার নেপথ্যে সেই প্রেরণাদায়ীর নাম—জেমস মাইকেল অ্যান্ডারসন। সংক্ষেপে, জিমি অ্যান্ডারসন।
প্রেরণার গল্পে পরে আসা যাবে। আগে বিলালকে আরেকটু ভালো করে চেনা যাক। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আজ নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে সুপার ওভারে ২১ রান দেন বিলাল। বাজে বোলিং করলেও তাঁকে সুপার ওভারে বোলিং করানোর পেছনে যুক্তি ছিল। বিলাল একে তো ওমানের বোলিং বিভাগের কান্ডারি, তার ওপর ম্যাচেও (১০৯ রানের পুঁজি) ৪ ওভারে ২৫ রানে ১টি উইকেট নিয়ে বেশ ভালো করেন। বিলালের জন্ম পাকিস্তানের পেশোয়ারে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খেলেছেন সেখানেই। সর্বশেষ বিপিএলে খেলে গেছেন চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে। এই টুর্নামেন্টে ১৫ উইকেট নেওয়া বিলালের সুইং বোলিংও তখন থেকেই দেখা বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের।
ম্যাচের আগে বিলাল বিশদ প্রস্তুতি নিতে ভালোবাসেন। ভোর সাড়ে পাঁচটার অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। ঘুম থেকে উঠে সকালের জিম সেশনটা সেরে নেন। এরপর প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের ভিডিও নিয়ে বসেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন কোথায় বোলিং করতে হবে আর কোথায় করা যাবে না। প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের নিয়ে মাথা ঘামালেও বিলাল একটি বিষয়কে মোটেও পাত্তা দিচ্ছেন না—বয়স। আপাতত এখন না। এর একটি কারণও আছে।
বিলালের এটি তৃতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০১৬ ও ২০২১ আসরে খেললেও টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে শুধু বোলিং করতে পেরেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। এবার ‘বি’ গ্রুপে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পাচ্ছে ওমান। বিলাল তাই আপাতত বয়স নিয়ে ভাবছেন না। ওমানের মতো দলে খেললে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বিপক্ষে বোলিং করার সুযোগ যে প্রতিদিন মেলে না!
টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর বিপক্ষে এই বয়সেও ভালো করার প্রেরণাটা বিলাল পাচ্ছেন অ্যান্ডারসনের কাছ থেকে। টেস্ট ইতিহাসে পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া ৪১ বছর বয়সী অ্যান্ডারসন আগামী মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লর্ডস টেস্ট খেলে ক্যারিয়ার শেষ করবেন। তাঁকে অনুসরণ করার ব্যাপারটি কথা প্রসঙ্গে জানালেন বিলাল, ‘শরীর এখনো ভালো আছে। আমি ওমানের হয়ে খেলতে ভালোবাসি এবং এ জন্য প্রচুর প্রস্তুতিও নিই। নিজের দক্ষতা ও কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাস রাখি। জেমস অ্যান্ডারসন এর নিখুঁত উদাহরণ। ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি এখনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছেন এবং আমি তাঁর পথই অনুসরণ করছি।’
বিলাল বলে যান, ‘বয়স কোনো ব্যাপার নয়। পিচে আপনি কী করেন সেটাই আসল। শরীরকে সেটাই নিশ্চিত করতে হয়। আমি জিমিকে খুব অনুসরণ করি, স্টুয়ার্ট ব্রডকেও। তারা ফাস্ট বোলিংয়ের কিংবদন্তি। জিমির ফিটনেস সূচি অনুসরণ করি। বয়স তো কেবলই সংখ্যা, এটাকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই।’
বার্বাডোজে ৫ জুন অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে ওমান। অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারকে ভোগানোর স্বপ্ন দেখছেন বিলাল। তাঁর এই স্বপ্নের শেকড় খুঁজতে যেতে হবে বেশ পেছনে, যখন বিলাল পাকিস্তান ছেড়ে ওমানের মাসকাটে স্থায়ী হলেন, এরপর ওমানের হয়ে খেলতে আইসিসির চার বছর মেয়াদি প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই পথে ২০১৫ সালে ওমানের হয়ে তাঁর অভিষেক। দুই বছর নিয়মিত হলেন ওমান জাতীয় দলে। গতি ও ইনসুইং দিয়ে নজর কেড়েছিলেন বিলাল।
বিলালের কাছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা মঞ্চ, ‘আমার কাছে এটাই ক্যারিয়ারের সেরা মঞ্চ। কন্ডিশনও মানানসই ওমানের জন্য। গরম ভাবাপন্ন এবং ভালো উইকেট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অঘটন ঘটানো সম্ভব, সেটা প্রতিপক্ষ যে-ই হোক। আমার মনে হয় এমন কয়েকটি অঘটন আমরা ঘটাতে পারব। তবে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর বিপক্ষে খেলা খেলোয়াড়দের কাছে স্বপ্নপূরণের মতো ব্যাপার। এটা আমাদের কাছে কতখানি তা বলে বোঝাতে পারব না।’
১৩ জুন অ্যান্টিগায় ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে ওমান। অ্যান্ডারসনের দল হওয়ায় এ ম্যাচে নিশ্চয়ই ভালো করতে মুখিয়ে থাকবেন বিলাল। নামিবিয়ার বিপক্ষে আজ হেরে যাওয়ায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিও ওমানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড টেস্ট খেলুড়ে বলেই বিলাল হয়তো ভালো করার অতিরিক্ত জ্বালানি পাবেন। আর অ্যান্ডারসন? শুধু বিলাল কেন, ইংল্যান্ড কিংবদন্তি ঠিক এভাবে কতজনের প্রেরণা, তা নিশ্চয়ই গুণে শেষ করা যাবে না!