চোখ ছিল সাকিবের ওপর, আলো কাড়লেন আর্চি ভনও
‘তোমার হল শুরু, আমার হল সারা।’
না, সায়াহ্নে চলে এলেও সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ার এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু সাকিবকে সাক্ষী রেখে যখন আরেকজন অলরাউন্ডার রানে, উইকেটে, একে অন্যকে সামলানোর ক্ষেত্রে, এমনকি দলীয় অর্জনে তাঁকে ছাপিয়ে যান, তখন এমনটা লেখাই যায়। দুজন একই দলে খেললে না হয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কবিতার ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’ লাইনটা জুড়ে দেওয়া যেত। প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলেছেন বলেই কিনা সাকিবকে সবকিছুতেই হারিয়ে দিতে পেরেছেন।
কার কথা বলা হচ্ছে, এত দিনে নিশ্চয় সবাই জেনে গেছেন। আর্চি ভন; ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভনের ছেলে। দেড় যুগের বেশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে মাত্র একবার ভনের বিপক্ষে খেলার সুযোগ হয়েছিল সাকিবের; ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচে। সাকিব তখনো আজকের সাকিব হয়ে ওঠেননি। বার্বাডোজে হওয়া সেই ম্যাচে জিতেছিল ভনের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ডই। সেদিন সাকিব বোলিংয়ে আসার আগেই ভন ৩০ রান করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন বিসিবির বর্তমান নির্বাচক আবদুর রাজ্জাকের বলে।
সেই ম্যাচের ১৭ বছর পর সাকিব আরেকজন ভনের মুখোমুখি হবেন, তা সপ্তাহখানেক আগেও নিশ্চয় ভাবেননি! সে যা–ই হোক, বাবার মতো আর্চি ভনও ডানহাতি ব্যাটসম্যান ও অফ ব্রেক বোলার। তবে মাইকেল ভন খেলোয়াড়ি জীবনে অনিয়মিত বোলার হলেও তাঁর ছেলে পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাক পাওয়ার পর থেকেই আলোচনায় ছিলেন জুনিয়র ভন (আর্চি)। গত জুলাইয়ে লিস্ট ‘এ’ এবং আগস্টে অভিষেক হয়েছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও। তবে বিশ্ব ক্রিকেট আর্চিকে চিনেছে টন্টনে ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে সমারসেট-সারে ম্যাচ দিয়ে; যে ম্যাচ নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আগ্রহের কারণ ছিলেন সাকিব।
বাংলাদেশের ভারত সফরের দলে থাকা নিশ্চিত জেনে লন্ডনের ঐতিহাসিক ক্রিকেট ক্লাব সারের সঙ্গে শুধু এই ম্যাচটির জন্যই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব। এখন তাঁকে লন্ডন থেকে ভারতের বিমান ধরতে হচ্ছে সারে-অভিষেকে হার সঙ্গী নিয়ে। কারণ, ওই আর্চি ভন। দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশের তারকা অলরাউন্ডারের ৯ উইকেট যে ম্লান হয়ে গেছে আর্চির ১১ উইকেটের কাছে!
প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেটের পর গতকাল ম্যাচের শেষ দিনে আরও ৫ উইকেট নিয়েছেন ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ। তাঁর সঙ্গে সমারসেটের আরেক স্পিনার জ্যাক লিচের ঘূর্ণিজাদুতে মাত্র ১৪ রানের ব্যবধানে শেষ ৭ উইকেট খুইয়ে ১১১ রানের বড় ব্যবধানে হেরেছে সাকিবের সারে। কাল ম্যাচের শেষ দিনের শেষ সেশনের পড়ন্ত বিকেলে পাওয়া এই রোমাঞ্চকর জয়ে শিরোপা–দৌড়েও ভালোভাবে টিকে আছে সমারসেট।
আর্চি ভনই এখন এই শতাব্দীতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সমারসেটের হয়ে এক ম্যাচে কমপক্ষে ১০ উইকেট পাওয়া সর্বকনিষ্ঠ (১৮ বছর ৯ মাস ৫ দিন) বোলার। ক্লাবটির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সবচেয়ে কম বয়সে এক ম্যাচে কমপক্ষে ১০ উইকেট নিয়েছেন প্রয়াত ব্রায়ান অ্যান্থনি ল্যাংফোর্ড। ১৯৫৩ সালে ল্যাংফোর্ড কেন্টের বিপক্ষে ম্যাচে যেদিন ১৪ উইকেট নেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ৫ মাস ২৬ দিন।
ম্যাচের হাইলাইটস দেখতে চাইলেও বেশির ভাগ অংশজুড়ে থাকবেন দুই দলের দুই অলরাউন্ডার আর্চি ও সাকিব। চার দিনের এই ম্যাচকে দিনের নিরিখে ভাগ করলেও নায়ক তো আসলে এই দুজন। সোমবার ম্যাচের প্রথম দিন ৩১৭ রানে অলআউট হয় সমারসেট। আর্চি ওপেনিংয়ে নেমে করেন দলের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪৪ রান। সেদিন সাকিবের ৪৬ বল থেকে ১৯ রান নিতে পারেন তিনি, মারেন একটি চার। তবে ৪ উইকেট নিয়ে প্রথম দিনের নায়ক ছিলেন সাকিবই।
মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে বৃষ্টির বাগড়ায় ২০ ওভার কম খেলা হয়েছে। ওই দিন ৩ উইকেটে ১৬৯ রান তোলে সারে। সাকিব সেদিন ব্যাটিংয়ে নামেননি। তবে ৩ উইকেটের ৩টিই নিয়ে নায়ক হওয়ার আভাস দিয়ে রেখেছিলেন আর্চি। পরদিন বুধবার আর্চি আরও ৩ উইকেট নিলে বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড়ায় ৩৭ ওভার-৭ মেডেন-১০২ রান-৬ উইকেট; ঘরোয়া ক্রিকেটে যা তাঁর ক্যারিয়ার-সেরা। সারে প্রথম ইনিংসে ৪ রানের লিড নিলেও সাকিব ব্যাট হাতে ছিলেন ব্যর্থ। ২৪ বল খেলে করেন ১২ রান। ইনিংসে আর্চির ৫টি বল খেলার সুযোগ পান সাকিব। প্রথম বলেই চার মারার পর তিনটি ডট; এরপর নেন সিঙ্গেল।
তবে সেদিন বল হাতে আবারও জাদু দেখান সাকিব। তৃতীয় দিনে নেন ৪ উইকেট। এবার শিকারের তালিকায় আর্চিও (১১ বলে ৩ রান) ছিলেন। নিজের দ্বিতীয় বলেই জুনিয়র ভনকে বোল্ড করেন সাকিব। ওই দিনই সমারসেট অধিনায়ক লুইস গ্রেগরিকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন বাংলাদেশি তারকা। পরদিন সমারসেটের দ্বিতীয় ইনিংসের শেষ উইকেটটি নিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২৫তম বারের মতো পূর্ণ করেন ‘ফাইফার’। তাতে জয়ের জন্য সাকিবের সারের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২২১ রান।
কিন্তু আর্চি আর লিচের পাঁচ-পাঁচ ১০ উইকেটে মাত্র ১০৯ রানে গুটিয়ে যায় সারে। সাকিব প্রথম ইনিংসে তবু ১২ রান করতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে মেরেছেন ‘ডাক’। পঞ্চম বলেই তাঁকে ফিরিয়ে পরশুর প্রতিশোধও নিয়েছেন আর্চি ভন। এই ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি আর্চির ‘হাড়কিপটে’ বোলিংয়েরও প্রশংসা করতে হয়। ৩২ ওভারের মধ্যে ১৫ ওভারই নিয়েছেন মেডেন। রান দিয়েছেন মাত্র ৩৮; ইকোনমি রেট ১.১৮!
ম্যাচে আর্চির পারফরম্যান্স—ব্যাটিংয়ে ৪৪ ও ৩ রান, বোলিংয়ে ৬/১০২ ও ৫/৩৮। ইংলিশ কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে ম্যাচসেরার পুরস্কার দেওয়া হয় না। পুরস্কার দিলে তা যে আর্চির হাতেই উঠত, তা না বললেও চলছে।
সাকিব তো বটেই; সারের হয়ে এ ম্যাচে আরও যাঁরা খেলেছেন—এমন পাঁচজনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা আছে। চারজন তো টেস্টও খেলেছেন। অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের আউট করা প্রসঙ্গে আর্চি বলেছেন, ‘তাঁদের বিপক্ষে বল করা চ্যালেঞ্জিং। তবে টিভিতে আমি তাঁদের খেলা অনেকবার দেখেছি। আমি শুধু আমার সেরা বোলিংটা করার চেষ্টা করেছি। সেটাই কাজে দিয়েছে।’
ব্যাটিং নাকি বোলিং, কোনটিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন—এমন প্রশ্নে আর্চি বলেন, ‘কখনো ব্যাটসম্যান, কখনো বোলারের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে। আমি দুটিই উপভোগ করি। আমি আরও ধারাবাহিক হতে চাই, নিখাদ অলরাউন্ডার হতে চাই।’
ছেলের এমন পারফরম্যান্সের পর যেকোনো বাবার গর্বে বুক ভরে যাওয়া স্বাভাবিক। মাইকেল ভনেরও নিশ্চয় আর্চিকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে। এমনিতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সরব ভন। ক্রিকেটে আলোচিত যেকোনো ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে থাকেন ইংল্যান্ডের হয়ে ২০০৫ অ্যাশেজজয়ী এই অধিনায়ক। কিন্তু ছেলের চমক জাগানিয়া পারফরম্যান্সের পরও তিনি একেবারেই নীরব।
সমারসেট কাল ১৪ রানের মধ্যে সারের শেষ ৭ উইকেট ফেলে দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করেছে। এর মধ্যে ৩টি উইকেট আছে জুনিয়র ভনেরও। মাইকেল ভন সেই ভিডিও শুধু শেয়ার করেছেন। তিনি হয়তো আর্চির ওপর এখনই ভার্চ্যুয়াল জগতের চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন না কিংবা ছেলেকে তাঁর মতো করে এগিয়ে যেতে দিতে চাইছেন।
সদ্যই স্কুলজীবন শেষ করা আর্চির চাওয়াও তো অনেক। সমারসেট কোচ জেসন কের যেমন তাঁকে নিয়ে বলেছেন, ‘ওর সীমানা আকাশছোঁয়া।’ সেটা করতে পারলে কে জানে, একদিন হয়তো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারদের তালিকায় সাকিবের পাশে আর্চির নামও দেখা যাবে!