আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাঁচাতে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে আইসিসি
বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের দাপটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এক রকম সংকটের মধ্যেই পড়ে গেছে। ক্রিকেটাররা দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার আগ্রহ হারাচ্ছেন। সম্প্রতি ওপেনার জেসন রয় ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ক্রিকেটে (এমএলসি) যোগ দেওয়ার পর শঙ্কাটা আরও বেড়েছে। রয় প্রথম ইংলিশ ক্রিকেটার, যিনি বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে রক্ষা করতে কয়েকটি বিশেষ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টি লিগগুলোতে প্রথম একাদশে বিদেশি ক্রিকেটারের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। একই সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে কোনো দেশের ক্রিকেটার চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় ওই দেশের ক্রিকেট বোর্ড যেন অর্থলাভ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করতে যাচ্ছে আইসিসি। ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এসব।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে চালু হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল টি–টোয়েন্টি লিগ। আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চালু হতে যাচ্ছে নতুন টি–টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। এমনকি সৌদি আরবেও টি–টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ চালু হচ্ছে বলে গুঞ্জন আছে। ভারতের আইপিএল, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ টি–টোয়েন্টি, পাকিস্তানের পিএসএল, বাংলাদেশের বিপিএল ছাড়াও এ বছরের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা চালু করেছে নতুন টি–টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ।
প্রথম একাদশে বিদেশি ক্রিকেটারের সংখ্যা নির্দিষ্ট করার পেছনে মূলত আছে নতুন কিছু লিগই। আরব আমিরাতের লিগে এক দলে সর্বোচ্চ ৯ জন বিদেশি খেলোয়াড় রাখার অনুমতি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের লিগে এই সংখ্যাটা হতে যাচ্ছে ৬। টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, আইসিসি আগামী মাসেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে প্রতিটি দলে বিদেশি খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৪–এ বেঁধে রাখার নিয়ম করে দিতে যাচ্ছে। প্রতি খেলোয়াড়ের চুক্তির বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট বোর্ডের নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তিও আইসিসি বাধ্যতামূলক করতে পারে আগামী মাসেই।
আইপিএলে প্রতি ম্যাচে সর্বোচ্চ চারজন বিদেশি খেলোয়াড় খেলাতে পারে দলগুলো। আপাতত সেটিকেই মানদণ্ড ধরে এগোতে চায় আইসিসি। ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার শঙ্কাটা মূলত সৌদি আরবের প্রস্তাবিত টি–টোয়েন্টি লিগ নিয়েই। এতে ইউরোপীয় ফুটবলের মতো বিদেশি খেলোয়াড়ের নির্দিষ্ট কোনো কোটা থাকবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। আইপিএলের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে যদি প্রতি ম্যাচে চারজন বিদেশি খেলোয়াড় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে এই লিগগুলোতে স্থানীয় খেলোয়াড়দের সুযোগও অনেক বেড়ে যাবে স্বাভাবিকভাবেই।
লিগগুলোতে প্রতি ম্যাচে বিদেশি খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৪–এ বেঁধে রাখা হলে ক্রিকেটারদের বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকিও অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করে আইসিসি। এতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যে সম্প্রতি হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে, সেই ঝুঁকিও অনেকটাই কমবে বলে ধারণা তাদের।
আইসিসি চায়, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর দলগুলো বিদেশি ক্রিকেটারদের দলভুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্রিকেটার যে বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, তাদের যেন মোট অর্থের ১০ শতাংশ দেয়। ধরা যাক, বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানকে আইপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি যদি ২ কোটি টাকায় দলভুক্ত করে, তাহলে অবশ্যই বিসিবিকে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে। আইসিসি মনে করে, যে হারে বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের প্রসার ঘটছে, এতে এই অর্থ প্রতিটি দেশের ক্রিকেট বোর্ডের রোজগারের ভালো একটা সুযোগ তৈরি করবে।
কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী রিচার্ড গোল্ড উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো খেলোয়াড় তৈরি কিংবা খেলোয়াড়দের উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না। কিন্তু বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ড খেলোয়াড় তৈরিতে প্রতিনিয়ত যে কাজ করে যাচ্ছে, ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো একেবারে বিনা পয়সায় সেই সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছে, ‘ইসিবির যে অর্থ আয় করে, সেটির সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এই টাকাটা অনেক জায়গায় খরচ করতে হয়। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলো আমাদের সেরা খেলোয়াড়দের নিলেও তারা এ জন্য আমাদের কোনো অর্থ পরিশোধ করছে না। তারা খেলোয়াড়দের টাকা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এই খেলোয়াড় সরবরাহের জায়গাকে কিছু দিচ্ছে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের উচিত খেলোয়াড় যেখান থেকে তৈরি হচ্ছে, তাদের টাকা দেওয়া।’
টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী জনি গ্রেভ এ ধরনের একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় তাঁর সেই প্রস্তাব বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডের কাছে খুব একটা পাত্তা পায়নি। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর দাপটে খেলোয়াড়দের দেশের হয়ে খেলার ব্যাপারে অনীহা ও তাঁদের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রবণতার মুখে গ্রেভের প্রস্তাবটি নিয়ে সবাই গভীরভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। রয় সম্প্রতি ইসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার আগে গত বছর এমনটি করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের ফাস্ট বোলার ট্রেন্ট বোল্টও। ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের তারকা ক্রিকেটাররা যদি এমন করা শুরু করেন, তাহলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রাসঙ্গিকতাই হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগও আইসিসির ভাবনার কারণ হতে পারে। আগামী মাসে দেশটিতে চালু হওয়া লিগটি যথেষ্টই অর্থকরী হতে যাচ্ছে। মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলা এই লিগের নেপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করছেন।
সম্প্রতি গলফে পিজিএ ট্যুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুরের বাইরে সৌদি মালিকানাধীন গলফ সার্কিট নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রাপ্ত অর্থে পরিচালিত এই এলআইভি গলফ সার্কিট পিজিএ ট্যুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুরের শীর্ষ গলফারদের টাকা দিয়ে কিনে ফেলছিল। এলআইভি গলফ গলফারদের রেকর্ড আড়াই কোটি মার্কিন ডলার পার্স ও আর্থিক নিশ্চয়তা দিয়েছিল, যেটি গলফ তারকাদের ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করে। এতে অংশ নেন ফিল মিকেলসন ও ব্রুকস কোয়েপকার মতো তারকা গলফাররা। তবে টাইগার উডস, ররি ম্যাকলরয়রা থেকে যান পিজিএ ট্যুরের সঙ্গেই। যদিও সম্প্রতি এ সমস্যার সমাধান হয়েছে। পিজিএ ট্যুর, ডিপি ওয়ার্ল্ড ও সৌদি মালিকানাধীন এলআইভি একত্রিত হয়েছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ব্যাপারে আইসিসি এ ধরনের কোনো উদ্যোগের কথাও মাথায় রাখছে। ১৯৭৭ সালে ক্রিকেটের সেই বিখ্যাত কেরি প্যাকার সিরিজের উদাহরণ তো আছেই। অস্ট্রেলিয়ার ধনকুবের প্যাকার ওই সময় বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় ক্রিকেটারদের নিয়ে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ চালু করেছিলেন। যেটি সে সময় খুব সুনজরে দেখেনি আইসিসি ও সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট বোর্ডগুলো। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল সে সিরিজ খেলতে যাওয়া ক্রিকেটের শীর্ষ তারকাদের ওপর। এখন কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ যদি আইসিসির বেঁধে দেওয়া নিয়মকানুন না মানে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়বে সেই লিগ। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার থেকেই যাচ্ছে। সেই লিগের দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়ও পড়ে যাবেন নিষেধাজ্ঞার কবলে। সে ক্ষেত্রে সেই খেলোয়াড় আইসিসি অনুমোদিত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার অধিকার হারাবেন।
আইসিসি চায় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে প্রতি ম্যাচে চার বিদেশি খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারটি টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর খেলোয়াড়দের মধ্যেই রাখতে। সে ক্ষেত্রে আইসিসি সহযোগী সদস্যদেশের ক্রিকেটার এই কোটার মধ্যে পড়বেন না। এতে আইসিসি সহযোগী সদস্যদেশগুলোর ক্রিকেটাররা এসব লিগে খেলে নিজেদের দেশের ক্রিকেটকে লাভবান করতে পারবেন।