জো’বার্গ ফিরল সেঞ্চুরিয়নে, ক্যালিস ফিরলেন রাবাদায়
জ্যাক ক্যালিস কথাটা যখন বলেছিলেন, কাগিসো রাবাদার বয়স তখন ১০ বছর। ওই বয়সে যদি না–ও শুনে থাকেন, পরে নিশ্চয়ই শুনেছেন। রূপকথার অংশ হয়ে যাওয়া ক্যালিসের সেই মন্তব্যটি এমন সব সময়েই যে স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠার জ্বালানি দেয়!
ম্যাচের আবহ, সম্ভাব্যতা, সময় আর অর্জনের মাহাত্ম্যে ব্যবধান অনেক। তবে ম্যাচের মাঝপথে বলা দুটি মন্তব্যই মিলে গেল একবিন্দুতে। মিলে গেল শেষের ফল আর দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট ইতিহাসের কীর্তিতেও। সাহস আর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠা কথাটি অতি সাধারণ—ওরা ১০ রান কম করেছে।
২০০৬ সালের ১২ মার্চ, জোহানেসবার্গে সেটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা–অস্ট্রেলিয়া ওয়ানডে সিরিজের পঞ্চম ম্যাচ। প্রথমে ব্যাট করে রিকি পন্টিংয়ের ১৬৪ রানে ভর করে ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৪৩৪ রান তুলে ফেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। ওয়ানডে ইতিহাসে চার শ পার করার সেটিই প্রথম ঘটনা।
তিন শ রানই নিরাপদ মনে হওয়ার সেই সময়ে সফল রান তাড়ার রেকর্ড ছিল ৩৩১ রান। আগের বছরই যেটা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাড়া করেছিল নিউজিল্যান্ড। কিন্তু এখানে তো দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দাঁড়িয়েছে আরও এক শ রানেরও বেশি।
ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবার চার শ রানের ভুক্তভোগী প্রোটিয়া বোলাররা যখন কাচুমাচু হয়ে বসে, তখনই ড্রেসিংরুমে ক্যালিস বলেছিলেন কথাটা। ব্যাটসম্যানদের ভয় তাড়াতে হোক বা সাহস জোগাতে, কিংবদন্তি অলরাউন্ডার সতীর্থদের বলে ওঠেন, ‘ওরা তো ১০–১৫ রান কম করেছে।’
এরপর যা ঘটেছে, ওয়ানডে ক্রিকেটে জ্বলজ্বলে ইতিহাস হয়ে আছে তা। হার্শেল গিবসের ১৭৫ আর গ্রায়েম স্মিথের ৯০ রানে চড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ জিতে যায় ১ বল আর ১ উইকেট হাতে রেখে। ওয়ানডে ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যা সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড।
২১ বলে ২০ রান আর ৬ ওভারে ৭০ রান দেওয়া ক্যালিস সেদিন ব্যাটে–বলে অবদান রাখতে পারেননি। কিন্তু জেতার আগেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের ‘পাগলাটে’ ওই মন্তব্য করে।
১৭ বছর পর ক্যালিসের সেই কথাটাই ফিরিয়ে আনলেন রাবাদা। তিন ম্যাচ টি–টোয়েন্টি সিরিজের প্রথমটিতে হেরে দক্ষিণ আফ্রিকা এমনিতেই ব্যাকফুটে। সিরিজের সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখতে জিততেই হতো সেঞ্চুরিয়ানের ম্যাচটি। আর এমন ম্যাচেই চার–ছক্কার ঝড় বইয়ে দিয়ে ক্যারিবীয়রা তুলে ফেলল ৫ উইকেটে ২৫৮ রান।
হালের টি–টোয়েন্টিতে আড়াই শ রান অসাধ্য কিছু নয়। কিন্তু প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে বোলারদের তুলাধোনা করে রান তোলা, আর নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ছোটা তো এক কথা নয়। চারদিকে টি–টোয়েন্টির মচ্ছব চললেও আড়াই শর বেশি রান তাড়া করার নজির নেই একটিও। আন্তর্জাতিক ম্যাচে তো নয়ই, যেকোনো পর্যায়ের স্বীকৃত টি–টোয়েন্টিতেও না।
কেউ না ছুঁতে পারা সেই পাহাড়–চূড়া জয়ের চ্যালেঞ্জ যখন সামনে, রাবাদা যেন ‘ক্যালিস’ হয়ে গিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওরা তো ১০ রান কম করেছে।’ ম্যাচের শেষের সংবাদ সম্মেলনে ওপেনার রিজা হেনড্রিকসই মিলিয়ে দিলেন ১৭ বছর আগে–পরের ক্যালিস–রাবাদাকে, ‘ব্যাপারটা খুব মজার। আমরা যখন মাঠ ছাড়ছিলাম, রাবাদা বলল, ওরা ১০ রান কম করেছে। এটা সম্ভবত ক্যালিস যে রকমটা বলেছিলেন, সে রকমই।’
২৫৯ রানের লক্ষ্যে নেমে রিজা আর কুইন্টন ডি ককের উদ্বোধনী জুটি ৬ ওভারেই তুলে ফেলে ১০২ রান। ডি কক ৪৪ বলে ১০০ রান করে আউট হয়ে গেছেন। রিজা ২৮ বলে ৬৮ রান করে। ততক্ষণে দক্ষিণ আফ্রিকা দূরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। ৭ বল ও ৬ উইকেট বাকি থাকতেই এসে গেছে রেকর্ড–গড়া জয়।
ক্রিকেটের বিশ্বায়ন ঘটানোর ভাবনায় এক শর বেশি দেশকে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টির মর্যাদা দিয়ে রেখেছে আইসিসি। এর সুফল কতটা পাওয়া গেছে, সেটা আলোচনাসাপেক্ষ। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে এসেছে রেকর্ড বইয়ে নিরন্তর কাটাকুটির প্রবণতা। পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন কে কোন রেকর্ড গড়ে ফেলছে, কে আবার তা ভেঙে ফেলে নতুন চূড়ায় উঠে যাচ্ছে, সেই হিসাব রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদদের জন্য।
টি–টোয়েন্টি রেকর্ডের মধ্যে ‘কুলীন’ জাতের কীর্তিগুলোর বেশির ভাগই এমন সব দেশের, যারা এখনো পেশাদার ক্রিকেটার পেতে হিমশিম খাচ্ছে। রানে সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ডটা যেমন চেক প্রজাতন্ত্রের, বেশি বল বাকি রেখে জয়ের রেকর্ড স্পেনের, আর টানা জয়ের রেকর্ড মালয়েশিয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এসব ‘পুঁচকে’ দেশের রেকর্ডের ভিড়ে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলো অনেকটা প্রান্তিক গোষ্ঠীর মতো।
আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ল আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রান তাড়ার বিশ্ব রেকর্ড। দুই দল মিলিয়ে গড়েছে সবচেয়ে বেশি রান আর ছক্কার বিশ্ব রেকর্ডও। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এই রেকর্ড আর জয়ের মাহাত্ম্য আরও বড়। সাদা বল ক্রিকেটের আরেক সংস্করণ ওয়ানডের সর্বোচ্চ সফল রান তাড়ার রেকর্ডটাও যে তাদেরই।
দুই রেকর্ড রান তাড়াতেই অমর ওই একটা কথা—ওরা ১০ রান কম করেছে।