বাংলাদেশ কবে ‘আফগানিস্তান’ হতে পারবে

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপনএএফপি

তুলনাটা না চাইলেও ওঠে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটি দলের বয়স হয়ে গেল ২৮ বছর। এখনো শুধু প্রত্যাশা আর প্রতিশ্রুতি পূরণ হয় সামান্যই। প্রস্তুতি যেমনই হোক, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টুর্নামেন্টে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচামরার ম্যাচে বোলিংয়ে আসতে হয় স্বয়ং অধিনায়ককেই, যিনি আসলে ব্যাটসম্যান।

আরেকটি দলের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বয়স হলো ১৬ বছর। শুরুতে তাদের কেউ গোনায় ধরেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ, যেখানকার ক্রিকেট–সংস্কৃতি আবার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান থেকে ধার করা। শরণার্থী হিসেবে দেশটির নাগরিকেরা পাকিস্তানে না গেলে ক্রিকেট তারা আদৌ খেলত কি না, কে জানে!

কিন্তু পর্বতসংকুল প্রতিকূল প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষদের বুকের বলটা হয় অদম্য। ভাঙবে তবু মচকাবে না! প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ব্যাট করেও তাই হয়তো সে দেশের একটি ছেলের পায়ে ‘ক্র্যাম্প’ হয় না। প্রতিপক্ষের সামনে ১২ বলে ১৬ রানের সহজ সমীকরণ থাকতেও তাঁদের ম্যাচ ধরার মুঠো এতটুকু ঢিল হয় না, উল্টো চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় সেই ম্যাচ তারা বেরও করে আনে।

জানি, দল দুটির নাম না বললেও চলে। বাংলাদেশের সমর্থক হিসেবে যে দলটির সঙ্গে হামেশাই তুলনা ওঠে, সেই আফগানিস্তান কাল রাতে যা করেছে, তাতে তুলনাটা বোধ হয় এখন আর চলে না। যে গল্পটি আমরা পড়েছিলাম ইশপের—সেই খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড়, সেখানে কচ্ছপকে হেলা করে খরগোশ যেমন একটু দৌড়ে আরেকটু থামি করতে করতে হেরেছে, তেমনি বাংলাদেশও বুঝি হেরে যাচ্ছে আফগানিস্তানের কাছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় দল হয়ে ওঠার দৌড়ে।

আরও পড়ুন

তুলনাটা তাই এখন একটু অন্যভাবে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে চায়ের দোকানে, বাংলাদেশ দল কবে আফগানিস্তানের মতো হবে?

অথচ সবাই একসময় ভেবেছিলেন প্রশ্নটি উল্টো হবে। কারণ, ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব—সবকিছুতেই বাংলাদেশ এগিয়ে। তারকাদের আবির্ভাব ধরলেও তাই নয় কি! আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম থেকে মোহাম্মদ আশরাফুল, আফতাব আহমেদের সময়ে আফগানিস্তান ক্রিকেটের নামগন্ধ ছিল কতটা, কিংবা আদৌ কি ছিল?

আরও পড়ুন

কিন্তু কালের ঘরে শনি ডেকে আজ উল্টে গেছে পাশার দান। বিশ্বব্যাপী টি–টোয়েন্টির ফ্র্যাঞ্চাইজি বাজারে আফগানদের রমরমা অবস্থা। এদিকে বাংলাদেশ থেকে ছিলেন এক সাকিব আল হাসান, তাঁর বাইরে বাকিদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই শুধু নাম জমা দেওয়া পর্যন্তই। কারণ, যুগের চাহিদা মিটিয়ে আফগানিস্তান যে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে, প্রজন্মকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে খেলতে শেখাচ্ছে, বাংলাদেশ কি তা পারছে? ওয়ানডে ক্রিকেটে সময় এখন তিন শ পেরিয়ে সাড়ে তিন শ ছোঁয়ার। বাংলাদেশের নব্বই দশকের আড়াই শর ঘর ছুঁতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে!

১৭৭ রান করে ইতিহাস গড়েছেন আফগানিস্তানের ইব্রাহিম জাদরান
এএফপি

কারণ আছে আরও। বড় মঞ্চে ধারাবাহিকতা। মাত্র ১৬ বছরে আফগানিস্তান টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের দেখা পেয়েছে। ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও উঠত। পারেনি ২০২৩ সালের আসরে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংসে, যাকে আপনি সমর্থকের ভাষায় দুর্ভাগ্যও বলতে পারেন। বৈশ্বিক আসরে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য সেখানে ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল। আর বড় দলকে হারিয়ে বড় দল হয়ে ওঠা? সেখানেও আফগানিস্তান স্রেফ অবিশ্বাস্য।

২০২৩ বিশ্বকাপ, ২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আফগানিস্তানের কাছে হেরেছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড। আইসিসি ইভেন্টে এ পর্যন্ত ১১০ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় যেখানে মাত্র ৩০টি, আফগানিস্তানের ৫৮ ম্যাচেই ১৮টি। বাংলাদেশের জয়ের হার যেখানে ২৭.২ শতাংশ, আফগানিস্তানের ৩১.০৩ শতাংশ।

যুগের চাহিদা মিটিয়ে আফগানিস্তান যে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলছে, প্রজন্মকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে খেলতে শেখাচ্ছে, বাংলাদেশ কি তা পারছে?

এই উন্নতির পেছনের কারণ কি শুধুই দক্ষতা? নাহ, সেটা তো পরে, সবার আগে প্রয়োজন বুক চিতিয়ে ও হৃদয় নিংড়ে খেলার উদগ্র বাসনা, যেটা আফগানিস্তানের কাছ থেকে নিয়মিত দেখে এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে রিকি পন্টিংয়ের মতো কিংবদন্তি বাংলাদেশের তুলনায় তাদের এগিয়ে রেখেছিলেন এবং হলোও ঠিক তা–ই।

এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়েই দুটি উদাহরণ দেওয়া যায়। আট দলের এই টুর্নামেন্টে ৫টি দল এর মধ্যে অন্তত এক ইনিংসে তিন শ পার করেছে। ভারত পারেনি তা নয়, দুবারই পরে ব্যাটিং করে আড়াই শর কম রান তাড়া করে জিতেছে। বাকি রইল শুধু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। বিশ্লেষকেরা বলেন, ২০২৫ সালে এসে শুধু এই দুটি দলই নব্বই দশকের ব্যাটিং করছে। পাকিস্তানের তবু ফখর জামান–সাইম আইয়ুবরা আছেন। বাংলাদেশে কী আছে? হ্যাঁ, তারকা তো আছেই। কিন্তু প্রয়োজনের সময় সেসব তারকা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে কতটা?

গ্যালারিতেও দেখা গেছে আফগান উল্লাস
এএফপি

আজ পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়ার আগে নিজেদের দুই ম্যাচেই বাংলাদেশ আগে ব্যাট করেছে। ভারতের বিপক্ষে ২২৮ ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২৩৬। ভারতের বিপক্ষে যেহেতু ৩৫ রানে ৫ উইকেট পড়েছিল, তাই সেই ম্যাচে তিন শর প্রসঙ্গটা একটু বাড়াবাড়ি হয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে পার্থক্যটা বোঝা যায় পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। সেটা ছিল বাংলাদেশের টুর্নামেন্টে বাঁচামরার ম্যাচ, ঠিক যেভাবে কাল লাহোরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও আফগানিস্তানের ম্যাচটি ছিল বাঁচামরার।

আরও পড়ুন

নিউজিল্যান্ড ম্যাচে ২০.৩ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ৯৭। সেখান থেকে স্কোর থেমেছে ২৩৬ রানে। ইংল্যান্ড ম্যাচে আফগানিস্তান আরও দ্রুত বিপদে পড়েছিল। ৮.৫ ওভারে ৩৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে শেষ পর্যন্ত ৩২৫/৭। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসলে সেই দলই বড় হয়ে ওঠে, যারা প্রয়োজনের মুহূর্তে জ্বলে উঠতে পারে। সেটা না পেরে প্রায় প্রতি ম্যাচের পর শিয়াল পণ্ডিতের সে গল্পের একই কুমিরের বাচ্চাকে বারবার ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখানোর মতো বারবার ‘প্রসেস, সিস্টেম, ইনটেন্ট’–এর পর্দা টাঙানোটা আসলে সামর্থ্যের ঘাটতির লক্ষণ।

ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আফগানিস্তান আরও বড় কিছুর স্বপ্ন দেখছে
এএফপি

সামর্থ্য প্রসঙ্গে শেষ একটি উদাহরণ টানা যায়। গত দুই বছরে ৪৩টি ওয়ানডে খেলে ছয়বার দলীয় সংগ্রহে তিন শ দেখেছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানও ৬ বার, তবে ম্যাচ খেলেছে ৩৬টি। পার্থক্যটা হলো প্রতিপক্ষে—বাংলাদেশের ছয়বারের তিনবারই প্রতিপক্ষ ছিল আয়ারল্যান্ড। একবার করে আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আফগানিস্তানের ছয়বারে চারবারই প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড। বাকি দুবারের প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড ও বাংলাদেশ। কিছু বোঝা গেল? বড় দলের বিপক্ষে তিন শর ছাপ যতটা থাকে, অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দলের বিপক্ষে সেই একই স্কোর লোকে ভুলে যায়।

এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে রিকি পন্টিংয়ের মতো কিংবদন্তি বাংলাদেশের তুলনায় আফগানিস্তানকে এগিয়ে রেখেছিলেন এবং হলোও ঠিক তা–ই।

সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে আরও একটি। এই ছয়বারে তিন শ করে শুধু পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হেরেছে আফগানিস্তান। বাংলাদেশ কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হেরেছে। অর্থাৎ, বড় দলের বিপক্ষে তিন শ করে জয় ছিনিয়েও নেওয়াটাও বড় দল হয়ে ওঠার ক্রিকেটীয় বিবৃতি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেটা কোথায়? গতকালের সংবাদ সম্মেলনেও তো বলা হলো, পরিকল্পনার অভাব, প্রস্তুতিতে ঘাটতি ও বরাবরের মতোই ছিটকে পড়ার পর শেষটা ভালো করার প্রত্যাশা।

২৮ বছরেও একটি দলের প্রস্তুতি শেষ হয় না। আরেক দল ১৬ বছরে নিয়মিত হাতি–ঘোড়া মেরে বলে ফেলে, ‘অস্ট্রেলিয়াও আমাদের হালকাভাবে নেবে না।’ কী বুঝলেন তাহলে? হিংসে হয়? নিশ্চয়ই ওদের মতো হতে ইচ্ছে হয়!