তামিম ও দলের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ নিয়ে ধোনির সেই উক্তি
দুটো মত। দুটো ভিন্ন যুক্তি। কেউ তামিম ইকবালকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। যাঁরা দেশসেরা ওপেনারকে দেশে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে, তাঁদের যুক্তি—চোটের কারণে ‘আনফিট’ কাউকে বিশ্বকাপের মতো লম্বা আসরে নেওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। এ কথার ওজন বাড়াতে অনেকেই আবার ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির উক্তিকেও টেনে আনছেন।
আর টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যাঁরা, তাঁদের যুক্তি সোজাসাপটা—আরে ভাই, বিকল্প তো দেখান!
কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল—সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২০০৮ সালে ধোনির সেই উক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমান প্রেক্ষাপটকে মেলানো কতটা যুক্তিসংগত কিংবা এই যে ‘বিকল্প নেই, বিকল্প নেই’ বলে যাঁরা আওয়াজ তুলছেন, এই আওয়াজ আর কত দিন!
ধোনি কী এমন বলেছিলেন? সে কথায় আসা যাক। ধোনি বলেছিলেন, ‘তুমি যদি শতভাগ ফিট না হও, সেরাটায় না থাকো, এরপরও খেলো, এটা প্রতারণা।’ ধোনির এ কথা যদি সবক্ষেত্রে কাজে লাগাতে যাই, তাহলে বলতে হবে, ধোনি নিজেই তাঁর দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আইপিএলে গত দুই মৌসুমে ধোনি তো শতভাগ ফিট না হয়েই খেলেছেন। এটা কী প্রতারণা নয়! অর্থাৎ ধোনির এ কথা সবক্ষেত্রে কাজে লাগবে না। কোন পরিস্থিতিতে ধোনি কথাটা বলছিলেন, সেটা বোঝাই গুরুত্বপূর্ণ।
মূলত ধোনি কথাটা বলেছিলেন ২০০৮ সালের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে। টেস্টে তখন ধোনি ভারতের নেতৃত্বেও ছিলেন না। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টে সিরিজের আগে টেস্ট থেকে ছুটি চেয়েছিলেন তিনি। কারণ হিসেবে বলেছিলেন তাঁর শতভাগ ফিট না থাকার কথা, ক্লান্তির কথা।
২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ধোনি খেলেছিলেন ১৪ টেস্ট, ৫৬ ওয়ানডে, ৮টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ও চেন্নাইয়ের হয়ে ১৬টি টি-টোয়েন্টি। এ কারণেই মূলত টেস্ট সিরিজে ছুটি নিয়েছিলেন তিনি। সেই ছুটি কেন নিয়েছিলেন, এ প্রশ্নে ধোনি সেই কথাগুলো বলেছিলেন। একটু মনে করিয়ে দিই, শ্রীলঙ্কা সফরের সেই দলে ভারতের ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম পাঁচজনের নাম ছিল—গৌতম গম্ভীর, বীরেন্দর শেবাগ, রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি। কী বুঝলেন! ধোনির প্রেক্ষাপট ও তামিমের প্রেক্ষাপট কি এক হলো?
টিম ম্যানেজমেন্টের কাছেও হয়তো যুক্তি আছে। কারণ, চোট নিয়ে তো বিশ্বকাপে অনেকেই খেলবেন। চোটের কারণে ইংল্যান্ড অলরাউন্ডার বেন স্টোকস বল করবেন না। কেইন উইলিয়ামসন কবে থেকে খেলতে পারবেন, সেটাও নিশ্চিত নয়। তবে তাঁদের থেকে তামিমের চোটের ধরন কিছুটা তো ভিন্ন। তামিমকে কবে থেকে নিয়মিত পাওয়া যাবে কিংবা কোন কোন ম্যাচে নিয়মিত পাওয়া যাবে, সেটা নিশ্চিত নয়। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য—তামিম ছাড়া বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি নিয়ে অস্বস্তি থেকেই যায়।
লিটনের সঙ্গে যিনি ওপেন করবেন, তাঁর ওপর চাপটা থাকবে কয়েক হাজার গুণ বেশি। তরুণ তানজিদ হাসান কিংবা অন্য কোনো ‘জোড়াতালি’র ওপেনার সেই চাপটা নিতে পারবেন তো! আর সবচেয়ে বড় বিষয় রানখরায় আছেন লিটন নিজেও। তাঁর আত্মবিশ্বাসও এখন তলানিতে। এমন পরিস্থিতি কি চারটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলা তামিমের পক্ষেই কথা বলছিল না?
বিশ্বকাপের বেশ আগে থেকেই যদি তানজিদ দলের সঙ্গে থাকতেন, হয়তো তাঁর জন্য চাপটা নেওয়া সহজ হতো। সেটা করার প্রয়োজনও ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। কারণ, তামিমের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর পিঠের চোট ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে। এই চোট তো নতুন কিছু নয়। চোটাক্রান্ত তামিম কেন চলতি বছরে আয়ারল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষেও দুই দফায় ৬টি ওয়ানডে খেললেন? এই দুই সিরিজেও কি তানজিদ হাসান, জাকির হাসানদের পরীক্ষা করে দেখা যেত না?
বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়া পেসার তানজিম হাসানেরও অভিষেকও হলো এশিয়া কাপে। বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়ার জন্য কি একটা ম্যাচে পারফর্ম করাই যথেষ্ট? বিসিবি হয়তো সেটাকেই যথেষ্ট মনে করে। কারণ, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে অভিষেক হওয়া জাকির হাসানও নাকি বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার দৌড়ে ছিলেন! প্রতিযোগিতায় ছিলেন সিরিজের প্রথম ম্যাচে ওয়ানডে অভিষিক্ত পেসার খালেদ আহমেদও।
প্রশ্নটি সে কারণেই উঠছে, এক ম্যাচে ভালো খেলাই যদি বিশ্বকাপ দলে থাকার মানদণ্ড হয়, তাহলে চারটি বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতার দাম কত? এককথায় অমূল্য। হ্যাঁ, বলতেই পারেন, যত অভিজ্ঞই হোক ‘আনফিট’ কাউকে দলে নেবে কেন? অকাট্য যুক্তি। তবে সে ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভালো, বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে কিন্তু তৃতীয় কোনো ওপেনার নেই। মেহেদী হাসান মিরাজকে দিয়ে হয়তো ‘মেকশিফট’ ওপেনারের কাজ চালানো হবে। আর তামিমকে ঘরে বসিয়ে আমরা এসবই দেখব টিভিতে।