মুশফিকুর রহিম, একটু বাড়তি নিবেদন ও ফেসবুক রিলসের গল্প
আপনার ফেসবুক রিলসে কী ভেসে আসে? প্রশ্নটা শুনে ভড়কে যাবেন না, আপনি ভুল করেননি—লেখাটা খেলা নিয়েই। শিরোনামেও ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের নামই পড়ে এসেছেন। তবু কেন রিলসের আলাপ এল শুরুতে? উত্তরটা দেওয়ার জন্য আপনি ক্রিকেট অনুসরণ করেন কি না, তা জানা জরুরি। অন্তত ফেসবুকে তেমন ভিডিও দেখেন কি না, সেটিও।
বদলে যাওয়া সময়ে ফেসবুক অ্যালগরিদম নিয়মিত হাজির করে আপনার পছন্দের ধরনের ভিডিও। হয়তো আপনার পৃথিবীও আটকে থাকে ওখানকার স্ক্রলিংয়ে। ক্রিকেটীয় ভিডিওতে, অন্তত বাংলাদেশে আপনি খেলার চেয়ে ধুলাই দেখে থাকেন একটু বেশি—ক্রিকেটারদের অনুশীলন যেখানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পণ্য।
ক্রিকেট ও অনুশীলন—আপনি এখন একসূত্রে গাঁথতে পারছেন হয়তো। স্মৃতির দুনিয়ায় রিওয়াইন্ড করলে আপনি কি মুশফিকের নিবেদনের গল্প দেখেননি বা পড়েননি? কয়েকটা ‘কমন’ শিরোনাম দিয়ে দিলে মনে করা সহজ হতে পারে হয়তো, ‘দলের তিন ঘণ্টা আগে থেকে অনুশীলনে মুশফিক…’, ‘সবাই টিম হোটেলে, মুশফিক…’ বা এমন আরও অনেক কিছু দেখে আপনি মুশফিকের পরিশ্রমের গল্প জেনেছেন প্রযুক্তির দুনিয়ায় এসে।
অতিরঞ্জনের দুনিয়ায় কখনো কখনো আপনার বাড়াবাড়িই মনে হতে পারে এমন কিছু, সঙ্গে মুশফিকের এই নিবেদনের গল্পও ভীষণ ক্লিশে লাগাটাও স্বাভাবিক। শেষ দিকে তাঁর ঘণ্টা কয়েক আগে অনুশীলনে চলে আসাও হয়ে গিয়েছিল সাধারণ ঘটনা। ‘এসব আর কত দেওয়া যায়...’ ভাবনায় হয়তো ফেসবুক অ্যালগরিদমও বিরক্ত হয়ে আপনাকে এসব ভিডিও পাঠানো এক রকম বন্ধই করে দিয়েছিল।
কিন্তু এগুলো তো নতুন দিনের গল্প। ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই দৌরাত্ম্যও খুব বেশিদিনের নয়। অনেকে এই সময়েও মুশফিকের পরিশ্রম দেখে বিরক্ত বোধ করেছেন, হাস্যরসের জন্য বেছে নিয়েছেন ওই ফেসবুককেই। অথচ মুশফিক কিনা ধ্যানমগ্ন কোনো এক ঋষির মতো করে ব্যাটের সঙ্গে বলের সংযোগের ‘টাং’ শব্দটাকে আপন করে রেখেছেন ১৯ বছর!
হ্যাঁ, ১৯ বছর। কাল তিনি যে ওয়ানডে দিয়ে সাদা বলের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন, তার আগে ৬ হাজার ৭৮৭ দিন। এই দিনগুলোয় তিনি বহুবার বিরক্তির কারণ হয়েছেন কোনো থ্রোয়ার কিংবা নিরাপত্তাকর্মীর। হয়তো ছুটির দিন ভেবে গা এলিয়ে দেওয়া সংবাদকর্মীর জন্য হয়েছেন একটা শঙ্কা, ‘মুশফিক যদি অনুশীলনে চলে আসেন...’ ভেবে ব্যাকপ্যাক গোছাতে হয়েছে তাঁকে।
এমন তো অনেক দিনই হয়েছে, দলের অনুশীলন নেই—কোনো এক ধকলের ক্লান্তি ছুয়ে গেছে পুরো দল, এমনকি খেলা–সংশ্লিষ্ট সবাইকে। একটা দিন তাই অনুশীলন নেই, সবাই ক্লান্তি কাটানোর ঢঙে দিন কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কিন্তু মুশফিক তো ঋষি—তাঁর ধ্যান ব্যাটের সঙ্গে বলের সংযোগের ‘টাং’ শব্দটা। এ জন্য তিনি ছুটে চলে এসেছেন অনেকটা দূরের স্টেডিয়ামে। তিনি আসা মানে একজন থ্রোয়ার, জাতীয় দলের একজন নিরাপত্তাকর্মী কিংবা আরও কয়েকজনের ক্লান্তি কাটানোর ফুরসত না পাওয়া।
কিন্তু এসব ‘বিরক্তি’ যদি থোড়াই কেয়ার না করতেন, তাহলে তাঁর অবসরের পর অধিনায়ক নাজমুল হোসেন কি আর লিখতেন, ‘আমাদের মতো লাখোজনকে অনুপ্রাণিত করেছেন আপনি। আপনার খেলাটার প্রতি নিবেদন আমাদের জন্য আদর্শ, অনেকগুলো প্রজন্মকেও তা অনুপ্রেরণা জোগাবে।’
প্রজন্মের গল্পে মুশফিক কোথায় থাকবেন, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাঁর প্রভাব কোথায় গিয়ে থামবে, তা–ও। শেষটা জুড়ে সমালোচনার কাঁটায় বিঁধতে হয়েছে। অবসরের সময়ও তাই তাঁর লিখতে হয়েছে, ‘গত কয়েকটা সপ্তাহ আমার কঠিন কেটেছে...’ আরও একটি বৈশ্বিক আসরে ব্যর্থতার পর মুশফিকের জন্য তা অবধারিতই ছিল।
ব্যর্থতার গল্প মুশফিক হয়তো লিখেছেন আরও অনেকবারই। কখনো তিন বলে দুই রানে নিতে পারেননি, বহুবার বনেছেন খলনায়কও। কিন্তু নিবেদনের তালিকায় তিনি তো এই দেশে কোনো সংশয় ছাড়াই প্রথম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা—সেখানে এসে কেউ হয়তো বলে ফেলতে পারেন, মাঠে জেতাতে না পারলে এত নিবেদনের কাজ কী?
প্রশ্নটা যৌক্তিক। উত্তর দেওয়াও কঠিন। সময় অনেক বাস্তবতা বদলে দেয়। ছোট কিছু ঘটনা জীবনের মোড় উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়, ভাবমূর্তি এনে ঠেকায় শূন্যের কোঠায়। তবু কারও কারও জীবনের গল্পে নিবেদন থাকতে হয়। হেরে যাওয়ার পরও ফিরে আসার চেষ্টাটা প্রয়োজন হয় কোথাও কোথাও।
কেন? কারণ, তেমন কেউ না থাকলে, বিশেষত দুই যুগের ক্রিকেট সংস্কৃতির একটা দেশে, কেউ ‘মিলিয়ন ক্রিকেটারের’ জন্য অনুপ্রেরণা না হলে খেলাটাই তো কোথাও না কোথাও থমকে যাওয়ার শঙ্কায় আটকে থাকে।
এ জন্যই হয়তো ফেসবুকে বিদায় বলা মুশফিককে পরদিন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে গার্ড অব অনার দেন সতীর্থরা—কে জানে হয়তো তাঁর নিবেদনকেই। তাঁকে নেটে বল করতে করতে সাময়িকতভাবে বিরক্ত হয়ে যাওয়া কেউও কি দূর থেকে ‘সালাম আপনার নিবেদন’ বলে ফেলেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না অবশ্য।
তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটই কি মুশফিকের বেঁধে দেওয়া পরিশ্রমের মানদণ্ডের কাছে দায়বদ্ধ না? উত্তরটা সময়ের হাতেই তোলা থাক। আপাতত তাঁকে সাদা পোশাকে উপভোগ করার সময়—নিবেদনের জন্য নয় অবশ্যই, তিনি যদি পারফর্ম করেন, কেবল তাহলেই।