মিরাজ–সাব্বিরের ওপেনিং জুটি যেন তুকতাকে বিশ্বাস
শৈশবে এমন কুসংস্কার অনেকেরই ছিল। দেখা যেত বাসায় বিদ্যুৎ নেই। অপেক্ষা করতে করতে গরমে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখন সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা রেখে বিজলি বাতির দিকে তাকিয়ে থাকা—যদি বিদ্যুৎ আসে! কিংবা ১০০ থেকে উল্টো গণনাও করেছেন কেউ কেউ। এভাবে গুনতে গুনতে কখনো–সখনো বিদ্যুৎ চলেও আসত। ব্যস, মনের মধ্যে বিশ্বাস জন্মাত, এভাবে গুনলে আসে! এরপর যতবারই বিদ্যুৎ যেত, ততবারই গণনা, বেশির ভাগ সময়ই হয়তো বিদ্যুৎ আসত না, কিন্তু তারপরও কুসংস্কার থেকে সরা হতো না।
ধান ভানতে শিবের গীত নয়, শৈশবের স্মৃতি টানতে হলো সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ দলের ওপেনিং জুটি দেখে। সংস্করণ যা–ই হোক, ওপেনিং জুটি নিয়ে বাংলাদেশের সমস্যা তো আজকের নয়। লিটন দাস গত কয়েক বছরে হয়তো ওপেনিংয়ে নিজের ভিত শক্ত করেছেন, তাঁকে ঠিক কী কারণে নিচে নামানো হলো, তা টিম ম্যানেজমেন্টই ভালো জানে। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভালো কিছুই হবে এমন কিছু ভেবেই এই সিদ্ধান্ত।
যেহেতু দেশের ক্রিকেটের প্রায় সবকিছুই ভবিষ্যত–নির্ভর—‘উন্নতি করতে হবে...সব বিভাগে ভালো করলে ভালো কিছু হবে...।’ আর ম্যানেজমেন্টের একটা অন্যতম কাজও যেহেতু পথ দেখানো, তাই তারা ভবিষ্যৎ নিয়েই থাকুক, এই ফাঁকে অতীতের আলোকে বর্তমানের ওপেনিং জুটিতে একটু তাকানো যাক।
চার বছর আগের এশিয়া কাপ ফাইনালটা কি আপনার মনে আছে? থাকার কথা। ভারতের বিপক্ষে সেই ফাইনালে জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও হার কী আর ভোলার মতো! সেই ২০১৮ এশিয়া কাপে তামিম ইকবাল চোটে পড়ায় লিটনের উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে পেতে ব্যর্থতার পর ফাইনালে লিটনের সঙ্গে ওপেন করানো হয় মেহেদী হাসান মিরাজকে।
‘মেকশিফট’ ওপেনার হিসেবে সেই ম্যাচে লিটনের সঙ্গে ২০.৫ ওভারে ১২০ রানের জুটি গড়েছিলেন মিরাজ—যেখানে লিটনের অবদান ছিল ৬৬ বলে ৮৬ আর মিরাজের ৫৯ বলে ৩২। ম্যাচটি ছিল ওয়ানডে, যাতে মিরাজের স্ট্রাইক রেট ছিল ৫৪.২৩।
বলতে পারেন, ওয়ানডেতেও এই স্ট্রাইক রেট চলে না। তা ঠিক। কিন্তু সে সময়ের সংকট বিচারে মিরাজ পাস মার্ক পেয়ে যান। আর তাতে নির্বাচকেরাও অনেকের শৈশবের সেসব কুসংস্কারের মতো ওপেনিংয়ে কোনো ‘আলো নিভলে’ বা নিবু নিবু হতে থাকলে মিরাজে ঠাঁই নেন। তাতে কাজ হোক বা না হোক। একটা ওয়ানডে ফাইনালে ছয়–সাতে ব্যাট করা কেউ ওপেনিংয়ে মাত্র ৫৪ স্ট্রাইক রেটে রান তুললেও তাই তাঁকে টি–টোয়েন্টিতেও ওপেন করতে দেখা যায়।
ওপেনিংয়ে মিরাজের অন্তর্ভুক্তি তাই শৈশবের সেসব কুসংস্কারের মতোই—লেগে গেলে ‘আলো’, না লাগলেও অন্তত অন্ধকার নিয়ে কেউ কিছু বলবে না। কারণ, ওপেনিংয়ে ‘লোডশেডিং’ তো সবারই জানা।
ওপেনিংয়ে মিরাজে অন্তর্ভুক্তি তাই শৈশবের সেসব কুসংস্কারের মতোই—লেগে গেলে ‘আলো’, না লাগলেও অন্তত অন্ধকার নিয়ে কেউ কিছু বলবে না। কারণ, ওপেনিংয়ে ‘লোডশেডিং’ তো সবারই জানা। সবাই আরও যা যা জানেন, এমন ‘কুসংস্কার’ শুধু ওপেনিংয়েই না, উইকেটে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান থাকলে কোনোমতেই বাঁহাতি স্পিনার নয়...একটু নিচে যে ভালো করছেন, তাঁকে ওপরে তোলা যাবে না...এসব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মনন থেকে মস্তিস্কে তুকতাক বিশ্বাসীদের সংখ্যা কম নয়। অস্ট্রেলিয়ায় টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সামনে রেখে এবার এই বিশ্বাসের ময়নাতদন্তে যে শুভংকরের ফাঁকিটা উঁকি মারছে, তার ঘোমটা খোলা যাক।
২০১৮ এশিয়া কাপ ফাইনালের ভেন্যু ছিল দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। প্রতিপক্ষ ভারত। এক যশপ্রীত বুমরা ছাড়া ভারতের সেই দলে পেসার ছিলেন মাত্র একজন—ভুবনেশ্বর কুমার। দুজনেই ভালো, ক্ষেত্রবিশেষে খুব ভালো, তবু দুবাইয়ের ব্যাটিং–স্পিনবান্ধব উইকেটে এই দুই পেসারকে খেলতে অন্তত ব্যাটিং পারেন, এমন কারও কাঁপাকাঁপি করার কথা নয়। ভারত চার স্পিনারকে খেলিয়েছিল ঠিক এ কারণেই।
দুবাইয়ের পিচে আর যা–ই হোক, ভালো লেংথ থেকে বল বুকসমান উচ্চতায় ওঠে না, আর ভারতের কোনো পেসারই প্যাট কামিন্স কিংবা হারিস রউফ নন যে, মরা উইকেটেও তা করতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে মিরাজের ৫৪.২৩ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং—কষ্টকর হলেও সত্য যে তবু প্রশ্ন তোলা যায় সামান্যই, কারণ তখনকার সংকট।
কিন্তু চার বছর পরের চিত্রটা ভিন্ন।
গত আগস্টে এশিয়া কাপের আগে বলা হলো, মিডল অর্ডার থেকে প্রয়োজনে ওপেন করানো হবে...প্রয়োজনে সাকিব–মুশফিক ওপেন করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। গাছে ঝাঁকি দিয়ে যেমন বরই পাড়া হয়, তেমনি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মাথায় রেখে দলের মধ্যে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওপেনার পেড়ে আনার বলিহারি পরিকল্পনা। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের প্রথম দুই ম্যাচে তাই দেখা গেল চারজন ওপেনারকে।
প্রথম ম্যাচে এনামুল হকের সঙ্গে মোহাম্মদ নাঈম, যাঁকে পরে যোগ করা হয়েছিল দলে। এই জুটির ব্যর্থ হলে পরের ম্যাচেই সেই ‘কুসংস্কার’ ফিরিয়ে আনা হয়—মেহেদী হাসান মিরাজ। আর সাব্বির রহমান। হ্যাঁ, অনেক বছর দলের বাইরে থাকা এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারা সাব্বিরের ওপেনিংয়ে মিরাজের সঙ্গী।
মিরাজের বিষয়টি যদি কুসংস্কার হয়, সাব্বিরকে ফেরানো তাহলে কুসংস্কারের চেয়েও আরও বড় কিছু! ডাকিনীবিদ্যা? সে যা–ই হোক, সাব্বিরকে এক সময় টি–টোয়েন্টিরই ব্যাটসম্যান ভাবা হতো, দশ–বারো ম্যাচ পর দু–একটি ম্যাচে সেই দ্যুতিও দেখা যেত, সেই সাব্বিরকে মিরাজের সঙ্গে ওপেনিংয়ে পাঠানো হলো দুবাইয়ের উইকেটে। সে ম্যাচ এবং পরে আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজ মিলিয়ে দুবাইয়ে তিন ম্যাচে সাব্বিরের স্কোর—৫, ০, ১২।
মিরাজের বিষয়টি যদি কুসংস্কার হয়, সাব্বিরকে ফেরানো তাহলে কুসংস্কারের চেয়েও আরও বড় কিছু! ডাকিনীবিদ্যা? সে যা–ই হোক, সাব্বিরকে এক সময় টি–টোয়েন্টিরই ব্যাটসম্যান ভাবা হতো, দশ–বারো ম্যাচ পর দু–একটি ম্যাচে সেই দ্যুতিও দেখা যেত, সেই সাব্বিরকে মিরাজের সঙ্গে ওপেনিংয়ে পাঠানো হলো দুবাইয়ের উইকেটে। সে ম্যাচ এবং পরে আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজ মিলিয়ে দুবাইয়ে তিন ম্যাচে সাব্বিরের স্কোর—৫, ০, ১২। এর মধ্যে শেষ ম্যাচে একটি ছক্কা মেরেই ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সের মন জিতে নেন সাব্বির। ১২ রানের ইনিংসের সেই শট নিয়ে সে কি আদিখ্যেতা!
কিন্তু ব্যাটিং তো এক শটের ব্যাপার নয়। ধরে নেওয়া যাক, সিডন্স তাঁর ব্যাটসম্যানকে আত্মবিশ্বাসী রাখতে এমন ‘আলিফ লায়লা’সুলভ কথা বলেছিলেন। কিন্তু ভুলে যাওয়া হয়েছিল, দুবাইয়ের উইকেট আর নিউজিল্যান্ডের উইকেট এক নয়, অস্ট্রেলিয়ার উইকেট তো নয়–ই। দুবাইয়ে বল আসে একটু থেমে, রয়েসয়ে খেলা যায়, তবু সাব্বির রান পাননি। স্কুপসহ এটা–সেটা খেলে আউট হয়ে সাব্বির ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা নির্বাচকেরাই ভালো জানেন। মিরাজ দুবাইয়ের উইকেটে ওপেন করে সাব্বিরের চেয়ে ভালো করেন। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কা ও আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুই ম্যাচ মিলিয়ে তাঁর স্কোর ৩৮, ১২, ৪৬। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, শ্রীলঙ্কা ও আরব আমিরাত মোটেও পেসার–নির্ভর দল নয়। দুবাইয়ের উইকেট তো নয়–ই।
নিউজিল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজকে ধরা হয়েছে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে। উইকেট ও কন্ডিশনে যেহেতু মোটামুটি মিল আছে দুই আয়োজক দেশের, তাই টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মাথায় রেখেই তো এই সিরিজটা খেলার কথা তিন দলের। বাংলাদেশও কি তাহলে অস্ট্রেলিয়াকে মাথায় রেখে ওপেনিংয়ে নামিয়েছে মিরাজ ও সাব্বিরকে?
নিউজিল্যান্ডের উইকেট বাউন্সি, বল স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে ওঠে। হারিস রউফের ১৪৪–১৪৫ কিমির বলে সাব্বির যে শটটা খেললেন তাঁকে ঠিক পুল কিংবা ‘শর্ট আর্ম জ্যাব’ও বলা যায় না। আসলে যে উচ্চতায় তিনি বলটি আশা করেছিলেন, সাধারণত ওই লেংথ থেকে যে উচ্চতায় উঠে আসা বল খেলে তিনি অভ্যস্ত, ক্রাইস্টচার্চে বল উঠেছে তার চেয়েও বেশি উচ্চতায়। তাই শটটা না হলো গ্লান্স, না পুল না শর্ট আর্ম জ্যাব। শরীরও ঘুরে গিয়েছিল আগেই, সামনের পা ঠিক জায়গায় ‘প্ল্যান্ট’ করতে না পারায় নিজেই বেকায়দা পজিশনে দাঁড়িয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ তুলে দেন।
এর একটা অন্যতম কারণ হতে পারে, বেশির ভাগ সময়ই সাব্বিরের অনসাইডে টেনে খেলার প্রবণতা, অস্ট্রেলিয়ার বড় মাঠের উইকেটে যা রীতিমতো আত্মঘাতী হতে পারে। তবে সেটি নির্বাচক এবং বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। এ নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্চ্য না করাই ভালো। সামনে বিশ্বকাপ, খেলোয়াড়দের মনের ওপর চাপ পড়তে পারে।
চাপ আসলে এমনিতেই পড়ে। আজকের ম্যাচের আগে বিসিবির এক ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, মিরাজ নেটে হাফ ভলি লেংথের বল তুলে মারার অভ্যাস করছেন। বোঝা গিয়েছিল, পাওয়ার প্লে–টা ব্যবহার করতে এই কৌশল। কিন্তু মিরাজ সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ডের উইকেটে হাফ ভলি নয়, বেশির ভাগ ডেলিভারি একটু পেছনে, থ্রি কোয়ার্টার লেংথে পড়বে।
উদ্দেশ্য একটাই, বল যেন তোলা যায়। পাকিস্তানের বিপক্ষে অবশ্য একটা হাফ ভলি পেয়ে দারুণ একটি ছক্কাও মেরেছেন মিরাজ। তাতে অবশ্য টানা তিন–চার বলে রান বের করতে না পেরে তাঁর জোর করে মারার অদ্ভুত সব চেষ্টার কদর্য ছবিটা মুছে ফেলা যায় না।
আসলে নিউজিল্যান্ডের উইকেটে ভালো ব্যাট করতে পেছনের পায়ে খেলার দক্ষতাটা একটু বেশিই লাগে। তা মূলত বলের বাড়তি বাউন্সের কারণেই। কিন্তু মিরাজের স্টান্স দেখলেই বোঝা যায়, সামনের পায়ে খেলার একটা তাড়না সব সময় তাঁর মধ্যে কাজ করে। সেটি দেশের কম বাউন্সের উইকেটে খেলার অভ্যাস থেকে বোধ হয়।
যা–ই হোক, ছক্কা মেরে পরের তিন বলে রান না পাওয়ায় মিরাজ সম্ভবত একটু উত্তেজিতই হয়ে পড়েছিলেন। নইলে মোহাম্মদ ওয়াসিমের গুড লেংথের বলটি তিনি জোর করে আড়াআড়ি খেলে সীমানা পার করার চেষ্টা করতেন না। এই যে অপরিণামদর্শী দুঃসাহস, তা তো একঅর্থে বোকামিই। নির্বাচক থেকে খেলোয়াড়েরা অবশ্য সবচেয়ে বাজে হার থেকেও ‘ইতিবাচক’ কিছু খুঁজে নিতে জানেন। তাই মিরাজের এই বোকামি ভুলে দুঃসাহসটুকু সম্ভবত টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য তুলে রাখা হতে পারে।
এদিকে পরিসংখ্যানও কিছু তথ্য–উপাত্ত তুলে রেখেছে। টি–টোয়েন্টিতে চার ম্যাচে মিরাজ–সাব্বির ওপেন করে রান তুলেছেন মোট ৮২। সর্বোচ্চ ২৭ রানের ওপেনিং জুটি। গড় ২০.৫০। ওভারপ্রতি রান তোলার গড় ৬.৬৪। এই চার ম্যাচে মিরাজ–সাব্বির ওপেনিং জুটি কখনোই পাওয়ার প্লে–র ৬ ওভার পার হতে পারেননি। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এই হলো বাংলাদেশের বর্তমান ওপেনিং জুটির খতিয়ান। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই। কারণ, নির্বাচকেরা তাকিয়ে ভবিষ্যতে।
অস্ট্রেলিয়ায় যে ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে, তার একটু নিদান দেওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ার উইকেটে নিউজিল্যান্ডের মতো বল স্প্রিংয়ের মতো লাফ দেয় না। কিন্তু জায়গামতো ফেললে বল বুকসমান উচ্চতায় উঠে আসে। ভালো গতিবান্ধব। এবার কল্পনা করার চেষ্টা করুন, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার পেসারদের বিপক্ষে অ্যাডিলেড, ব্রিসবেন, হোবার্টে ওপেন করছেন মিরাজ ও সাব্বির। হুম, চোখ দুটো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুজে আসে। আরামে নয়, ভয়ে!