বল হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ছক্কা মারেননি বেকহাম
ভারত ক্রিকেটপাগল দেশ। বিশ্বকাপ সেই পাগলামির পারদ আরও ছড়িয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটের এই উৎসবযজ্ঞের মধ্যে ফুটবলকে একটু অনাহূতই লাগতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে ডেভিড বেকহামের মতো একজনকে নামিয়ে দিলে তো ফুটবল আপনা–আপনিই চলে আসে!
গতকাল মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সেটাই দেখা গেল। সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে মাঠে নামেন সাবেক ইংলিশ ফুটবল তারকা বেকহাম। ঠিক ওই সময়ই মাঠের এক প্রান্তে ফুটবল নিয়ে গা গরমের পর্বটা প্রায় শেষ করে এনেছেন বিরাট কোহলিরা। বেকহামকে দেখে কোহলি তাঁকে বলটা পাস দিলেন। ইংল্যান্ডের সাবেক মিডফিল্ডারও ফিরতি পাসে জবাব দিলেন।
দুই ভুবনের দুই তারকার এই ‘ভাষাহীন’ যোগাযোগ চলল দুবার। ওয়াংখেড়ের ঘরের ছেলে টেন্ডুলকারের পাশে বেকহামকে দেখার অনুভূতি গ্যালারি তখনো পুরোপুরি হজম করতে পারেনি। ‘ঘরের ছেলে’র সঙ্গে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তির নামও জোরেশোরে শোনা গেল গ্যালারি থেকে। কে বলে, ফুটবল–ক্রিকেটের সম্পর্ক বন্ধুসুলভ নয়!
উল্টো মধুর আর স্মরণীয় কিছু মুহূর্তই দেখা গেল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ভারত ফাইনাল উঠল, কোহলি ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ শতকের রেকর্ড গড়লেন, সেটাও যাঁর রেকর্ড টপকালেন সেই টেন্ডুলকারকে সাক্ষী রেখে টেন্ডুলকারেরই ময়দানে—এসবই বেকহাম চাক্ষুষ দেখলেন। আর দেখলেন জনপ্রিয়তা। ভারতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা দেখে বেকহামের নিশ্চয়ই ফুটবলের দর্শকদের কথা মনে পড়েছে। তখন মনের মধ্যে অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা চলাই স্বাভাবিক—গ্যালারিতে কারা বেশি গলা ফাটায়? ফুটবল না ক্রিকেটের দর্শক? ইউরোপিয়ান ফুটবলে মাঠ ও মাঠের বাইরে তুমুল জনপ্রিয় বেকহামের মনের উত্তরটা আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। তবে সে আন্দাজ কিন্তু ভুলও হতে পারে!
আইসিসি নিজেদের অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম পেজে এবং ভারতীয় ক্রিকেট দল নিজেদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে আজ একটি ভিডিও পোস্ট করেছে। বেকহাম এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সেখানে। শুধু এটাই নয়, প্রথমবার ভারতে আসা, ক্রিকেটের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা দেখা, টেন্ডুলকারের সঙ্গে কাটানো সময় এবং ক্রিকেটে নিজের অতীত নিয়েও কথা বলেছেন লিওনেল মেসির দল ইন্টার মায়ামির সহমালিক। টেন্ডুলকারের সঙ্গে নিজের ক্লাবের জার্সিও বদল করেছেন ফুটবলের গ্ল্যামারাস জগতের কিংবদন্তি।
ভিডিওতে বেকহামের কাছে তিন শব্দে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দর্শকদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান, পিএসজি মাতানো বেকহাম উত্তরে সেই শব্দগুলোই বললেন, যেগুলো পৃথিবীর যেকোনো খেলার গ্যালারিভর্তি দর্শকদের সঙ্গে মানানসই—শিহরণ জাগানো, আবেগময় এবং অবিশ্বাস্য। এই ধারাবাহিকতায়ই ওই প্রশ্নটি করা। বেকহামের উত্তর, ‘আমি ফুটবলের দর্শকদের কথাই বলতাম। কিন্তু আজ (গতকাল) এখানকার (ওয়াংখেড়ে) পরিস্থিতি দেখার পর ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। দর্শকেরা চেঁচামেচি এবং নানা রকম উদ্যাপনে যে উৎসবের পরিবেশ তৈরি করেছে, তা শিহরণজাগানিয়া। তাই ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’
গ্যালারিভর্তি স্টেডিয়ামের টানেল দিয়ে বহুবার মাঠে নেমেছেন বেকহাম। তা কাল ওয়াংখেড়ের সিঁড়ি বেয়ে টেন্ডুলকারের সঙ্গে মাঠে নামতে কেমন লেগেছে? বেকহাম বলেছেন, ‘স্টেডিয়ামে ঢুকে গা শিউরে ওঠার অনুভূতিটা সব সময়ই ভালো লাগে। ঢুকেই বুঝেছি পরিবেশটা একটু অন্য রকম। সেটা সম্ভবত আমি শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে মাঠে নেমেছি বলে। সে কারণেই হয়তো অনুভূতিটা ছিল বিশেষ।’
বেকহামকে নিয়ে মাঠে নামার পর মাইক্রোফোনে তাঁকে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন টেন্ডুলকার। সেটুকু সম্ভবত সৌজন্যতা রক্ষার্থেই; কারণ, বেকহামের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। আর সে কারণেই বেকহামের নাম উচ্চারিত হতেই গর্জনে ফেটে পড়ে ওয়াংখেড়ের গ্যালারি। দর্শকেরা যেনে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, ফুটবলের মানুষকে ক্রিকেটে স্বাগতম!
বেকহাম অবশ্য একসময় ক্রিকেটেও বসত করেছেন। ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হয়ে ভারতে এসে তিনি কঁচি–কাঁচাদের সঙ্গে ক্রিকেটও খেলেছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান সেই খেলারই একটি ভিডিও নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়েছে। সেখানে বেকহামের ব্যাটিং দেখলে যে কেউ ভেবে নেবেন, এই লোকের সঙ্গে অতীতে অবশ্যই ব্যাট–বলের সম্পর্ক ছিল!
চোস্ত ব্যাটসম্যান না হলেও পুল ও কাটগুলো দেখে এমন দাবি অস্বীকার করা যায় না। বেকহামও স্বীকার করলেন তবে কখনো ক্রিকেট খেলেছেন কি না, এমন প্রশ্ন তাঁকে করা হয়নি। জানতে চাওয়া হয়েছিল, সুযোগ পেলে ব্যাটসম্যান, বোলার না অলরাউন্ডার হতেন? ৪৮ বছর বয়সী বেকহামের উত্তর, ‘স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্রিকেট খেলতাম। ব্যাটিং করতেই বেশি ভালো লাগত। বোলিং–ফিল্ডিং করতেও ভালো লাগত। সে জন্য হয়তো আমাকে অলরাউন্ডারও বলতে পারেন। তবে আমি নিজেকে ব্যাটসম্যান হিসেবেই দেখি।’
ভারতে প্রথম আসার অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলেছেন বেকহাম, ‘প্রথমবার এসেই অবিশ্বাস্য লাগছে। বিশ্বাসই হচ্ছে না ভারতে আসতে এত দেরি হলো। পরেরবার আসার জন্য তর সইছে না। এখানে এসে যা যা করেছি, ইউনিসেফের মিটিংয়ে অবিশ্বাস্য সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশেছি...এখানকার মানুষ, খাবার এবং এই যে স্টেডিয়ামের শিহরণজাগানিয়া পরিবেশ আর বিশ্বকাপ—এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।’
ভারত–নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনালের আগে কোহলির সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে বেকহামকে। পরে তো তাঁকে বুকেও টেনে নিয়েছেন কোহলি। টেন্ডুলকারও দূরে ছিলেন না। ভারতের ক্রিকেট ‘ঈশ্বর’খ্যাত টেন্ডুলকার ও কোহলিদের সঙ্গ বেকহামের কেমন লাগল, সেটি শুনুন তাঁর মুখেই, ‘শচীনের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হয়েছিল উইম্বলডনে। সেটাও বিশেষ কিছুই ছিল। প্রথমত যেটা বলতে চাই শচীনই সেরা, মানুষ হিসেবে আরও ভালো। আর তাই এখানে (ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম) তার সঙ্গে সময় কাটাতে পারাটা অবশ্যই দারুণ কিছু। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচের আগে সবাই এসে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে খুবই ভালো লেগেছে।’
টেন্ডুলকারের সঙ্গে বেকহামের আলাপচারিতার একটি ভিডিও–ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছে আইসিসি। ইংলিশ কিংবদন্তি সেখানেও ভারতীয় কিংবদন্তিকে জানিয়েছেন, তাঁর প্রথমবার ভারতে আসার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়ে অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুভূতি এবং কচি–কাঁচাদের সঙ্গে নিজের ক্রিকেট–অভিজ্ঞতার কথা। জানালেন, সুইপ শটটা বেশ ভালোই খেলতে পারেন। আর খুদেদের সঙ্গে খেলার সময় ‘ছক্কা, ছক্কা’ রোল উঠেছিল। বল হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ছক্কা মারেননি।
উত্তরে টেন্ডুলকার যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলেন ক্রিকেটের হাল পরিস্থিতিটা—এখনকার ছেলেমেয়েরা তো ছক্কা ছাড়া অন্য কিছু মারতেই চায় না!