ছোটখাটো পরিসরে হলেও বেশ একটা উৎসব উৎসব আবহ। ছেলেদের বিশ্বকাপের সংবাদ সম্মেলন হলে সংবাদমাধ্যমের যে রকম উপচে পড়া ভিড় লেগে যায়, তা হয়নি। তবে সমাগম যতটুকু হলো, তাতেও বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহটা বোঝা গেছে।
শুরুতেই ছেলেদের ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনায় নিগার সুলতানার ভ্রু কিছুটা কুঁচকে যেতে পারে। সংবাদ সম্মেলনের পর হওয়া উন্মুক্ত মিডিয়া সেশনে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক পরিষ্কার বলেছেন, ছেলেদের ক্রিকেটের সঙ্গে মেয়েদের ক্রিকেটের তুলনা কোনোভাবেই চলে না। ছেলেদের ক্রিকেট অনেক এগিয়ে। সেখানে সাফল্য, সুযোগ-সুবিধা, প্রচারের আলো সবই বেশি। সে তুলনায় মেয়েদের ক্রিকেটে সবই অনেক কম হলেও তাঁরা এতেই খুশি যে বাংলাদেশ দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছেন, সংবাদমাধ্যম তাঁদের সঙ্গে কথা বলছে।
উপলক্ষটা ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠেয় আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাক্-ফটোসেশন, সংবাদ সম্মেলন ও উন্মুক্ত মিডিয়া সেশন। বৃহস্পতিবার সকালে নিগারের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল যাবে বিশ্বকাপে খেলতে। তার আগে আগামীকালের দিনটা সবাইকে পুরোপুরি বিশ্রামের সুযোগ দিতে সব হয়ে গেল আজই। সংবাদ সম্মেলনে শুধু কোচ আর অধিনায়ক এলেও মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মিডিয়া ডাইনিং ও মিডিয়া প্লাজায় অনুষ্ঠিত উন্মুক্ত মিডিয়া সেশনে থাকলেন দলের অন্য ক্রিকেটাররাও।
সংবাদ সম্মেলন যথারীতি একটু তাত্ত্বিকই হলো। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নারী দলের লক্ষ্য, বিশ্বকাপের প্রস্তুতি, টপ অর্ডারের ব্যাটিং নিয়ে সমস্যা, ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টির মানসিকতা, টেকনিক, নবীন ও অভিজ্ঞদের কাছে প্রত্যাশা—এসবই ঘুরেফিরে এল আলোচনায়।
লক্ষ্য প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অধিনায়ক নিগার ছিলেন স্পষ্টভাষী। আকাশকুসুম স্বপ্ন না দেখিয়ে বলেছেন, বিশ্বকাপে তিনি অন্তত একটা ম্যাচ জিততে চান এবং এটাই তাদের মূল লক্ষ্য। কারণটা না বোঝার কিছু নেই। গত চারটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নারী দল জিততে পারেনি কোনো ম্যাচই। ২০১৪ সাল থেকে পাঁচটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মেয়েদের অর্জন বলতে সেই প্রথমবার শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ড নারী দলের বিপক্ষে পাওয়া দুটি জয়।
দলের হয়ে নিগারের চাওয়াটা তাই পরিষ্কার এবং বাস্তব, ‘আমি নিজেও চারটি বিশ্বকাপ খেলেছি, এখন পর্যন্ত একটা ম্যাচ জিততে পারিনি। অবশ্যই এবার বিশ্বকাপে আমার ব্যক্তিগতভাবে যেমন লক্ষ্য, তেমনি গোটা দলেরই লক্ষ্য যেন আমরা একটা ম্যাচ জিতে শুরু করতে পারি।’
আর শুরুটা জয় দিয়ে হলে সেমিফাইনালের স্বপ্নই–বা কেন নয়! নিগারের কথায় প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেল সে আশাও, ‘প্রতিটি ম্যাচের আগে যদি ওই দলের প্রতি বেশি মনোযোগ দিই এবং আমরা যদি ম্যাচ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারি, আমাদের জন্য ভালো হবে। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে এসেছি টি-টোয়েন্টিতে (তাদের দেশে)। তাদের বিপক্ষে আমাদের ভালো স্মৃতি আছে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের বরাবরই শুধু বিশ্বকাপে দেখা হয় এবং খুব কম খেলা হয়। বলা যায় নতুন প্রতিপক্ষ, ওদের জন্যও কিন্তু কঠিন হতে পারে। শারজায় খেলা, আমাদের স্পিন ভালো (হাসি)। যেকোনো কিছুই হতে পারে।’
পরে আরেক প্রশ্নে বলেছেন, ‘প্রথম লক্ষ্য থাকবে ম্যাচ জেতা। এরপর যখন আমরা ছন্দ পাব, সেই ছন্দেই (হাসি), …সেমিফাইনাল কে না খেলতে চায়! আমাদেরও লক্ষ্য থাকবে তেমন কিছু করা।’
বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটকে পরের ধাপে নিতে বড় মঞ্চে বড় কিছু করার বিকল্প দেখেন না নিগার, ‘বাকি যে মেয়েরা, বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলতে চায় বা স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের হয়ে বড় কিছু করবে, তাদের জন্যও আমরা ভালো কিছু করতে চাই।’
কোচ হাশান তিলকারত্নে তো আরেক ধাপ বেশি আশাবাদী, ‘আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী। এই দলে সব উপকরণই আছে। অনেক দূর যাওয়ার সামর্থ্য আছে তাদের।’
স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচটা নিগারের জন্যও বিশেষ এক ম্যাচ হবে। শততম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি হবে সেটি তাঁর। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে রোমাঞ্চিত নিগার, ‘প্রথম ম্যাচ জিততে চাই, এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার জন্য ও গোটা দলের জন্য বড় একটি অর্জন হবে তা। ব্যক্তিগতভাবে ১০০তম ম্যাচ অবশ্যই বড় ব্যাপার। যদি সুস্থ থাকি ও খেলি, তাহলে লক্ষ্য তো এটাই থাকবে, এটা যেন স্পেশাল হয়ে থাকে, স্মরণীয় হয়ে থাকে সবার জন্য।’
স্কটল্যান্ড এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মেয়েদের বিপক্ষে চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে সব কটিতেই হেরেছে। তাদের বিপক্ষে জয়টা যেন অবধারিত। তবে পরে নিগার এবং উন্মুক্ত মিডিয়া সেশনে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার জাহানারা আলমসহ অন্যরাও বলেছেন, এমন নয় যে স্কটল্যান্ড খুব সহজ প্রতিপক্ষে হবে আর তাদের বিপক্ষে খেলা মানেই জয়। স্কটল্যান্ডকেও কষ্ট করেই হারাতে হবে এবং সেই কষ্টটা অন্যদের সঙ্গেও করতে হবে।
নিগারের ভাষায়, ‘যদি আমরা নিজেদের ক্রিকেটটা খেলতে পারি, তাহলে জয়ের আশা করা যেতে পারে অন্য দলের বিপক্ষেও।’ ‘বি’ গ্রুপে বাংলাদেশের অন্য প্রতিপক্ষরা অবশ্য বেশ জাঁদরেল—ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
নিগার না চাইলেও ছেলেদের ক্রিকেটের সঙ্গে তাদের আরেকটা তুলনা চলেই আসে। তবে এই তুলনায় জয়ী মেয়েরাই। বাংলাদেশের ছেলেদের ক্রিকেটে বড় বড় সাফল্য থাকতে পারে, তবে একটা জায়গায় কেবলই শূন্যতা। আজ পর্যন্ত কোনো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি তারা। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ দল।
সেই স্মৃতি জাগিয়ে দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে নিগারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, টুর্নামেন্ট খেলাটা সহজ নাকি দ্বিপক্ষীয় সিরিজ? ছেলেদের ক্রিকেটে এটা এখন প্রমাণিত যে টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে তারা হাঁপাতে থাকে। মেয়েদের বেলায় ব্যাপারটা কী? নিগার চমকে দিয়ে বললেন, তিনি নাকি দ্বিপক্ষীয় সিরিজের তুলনায় টুর্নামেন্ট খেলাটাই বেশি উপভোগ করেন। টুর্নামেন্টে একেক ম্যাচে একেক প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলার চ্যালেঞ্জটাই টানে তাঁকে।
এই একটা জায়গায় তাই ছেলেদের সঙ্গে তুলনায় আপত্তি থাকার কথা নয় অধিনায়ক নিগারের। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তো আইসিসিই কোনো বৈষম্য রাখেনি ছেলে-মেয়েদের ক্রিকেটে।
গত বছরের জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত আইসিসির বার্ষিক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, পুরুষ ও নারী ক্রিকেটের প্রাইজমানি ও উইনিং মানি এখন থেকে সমান হবে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আইসিসির এই সিদ্ধান্তকে অনুপ্রেরণাদায়ক বলেছেন বাংলাদেশ নারী দলের সব ক্রিকেটার। নিগারের কথা, ‘টাকা তো সব সময়ই উৎসাহ দেয়। আইসিসির এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। এটা ভালো যে তারা অন্তত কোনো বৈষম্য রাখেনি।’