পিকারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশ্বকাপকে স্বাগত জানিয়ে ফেস্টুন আছে। ত্রিনিদাদে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দলের পুরোনো ঠিকানা হিলটন হোটেলেও। যেখান থেকে পাহাড়ের ওপরে ব্রায়ান লারার বাড়ি দেখা যায়।
কিন্তু এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালটা এই শহরেই হচ্ছে তো! গত দুদিন পোর্ট অব স্পেনের এখানে-ওখানে ঘুরেও এর বিন্দুমাত্র উত্তাপও যে টের পাওয়া গেল না।
হোটেলে দুই–তিনজন ভারতীয় ফ্যানের সঙ্গে দেখা। যাঁরা দুটি সেমিফাইনালই দেখার দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করেছেন। দুঃসাহসিক; কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়াটা বড় ঝক্কির ব্যাপার। সরাসরি ফ্লাইট খুব কম। এক ঘণ্টা উড়ান-দূরত্বের কোথায় যেতে হয়তো দেখা গেল, আরও দুটি দেশের বিমানবন্দর ঘুরে ১০–১২ ঘণ্টা লেগে গেছে। কখনোবা আরও বেশি। আর টিকেটের অগ্নিমূল্য তো আছেই। সেখানে রাতে ত্রিনিদাদের সেমিফাইনাল দেখে পর দিন সকালে গায়ানায় দ্বিতীয় সেমিফাইনাল দেখার চিন্তাটাই তো উচ্চাভিলাষী। তাহলে কীভাবে তা হচ্ছে? ভারতীয় ফ্যানরা মিলে নাকি চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন!
হিলটনে বিশ্বকাপের সম্প্রচারক সংস্থা স্টার স্পোর্টসের লোকজন উঠেছেন। ধারাভাষ্যকাররাও এখানে। সোমবার দুপুরে হোটেলের লবিতে শন পোলকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সন্ধ্যায় প্রথম সেমিফাইনালের দুই আম্পায়ার রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ ও নিতিন মেননের সঙ্গেও। রিচার্ড ইলিংওয়ার্থের সঙ্গে দেখা হলেই তাঁকে প্রথম দেখার কথা মনে করিয়ে দিই। ১৯৯৩ সালে আবাহনীতে খেলতে গিয়েছিলেন আরেক ইংলিশ ক্রিকেটার নিল ফেয়ারব্রাদারকে সঙ্গে নিয়ে। প্রতিবারই যা শুনে ইলিংওয়ার্থ বলেন, ‘সে তো অনেক দিন আগের কথা।’
ভারতীয় ফ্যান, শন পোলক, রিচার্ড ইলিংওয়ার্থ…তাঁদের কল্যাণে তা-ও বোঝা যাচ্ছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালটা এই শহরেই। আসলেই কি হচ্ছে? ক্রিকেটের দেশ ত্রিনিদাদের সেই সেমিফাইনাল নিয়ে কোনো হেলদোলই তো নেই। সোমবার দুপুরে কুইন্স পার্ক ওভালে পরিচয় হওয়া তরুণ ক্রিকেটার বললেন, ‘এই সেমিফাইনালটা যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া হতো, তাহলে বুঝতেন সেমিফাইনাল মানে কী!’
সেটি হবে বলেই আশা করে ছিল ত্রিনিদাদ। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বদলে দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়ার বদলে আফগানিস্তান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়ার বদলে দক্ষিণ আফ্রিকা-আফগানিস্তান সেমিফাইনাল। যা দেখতে স্টেডিয়ামে কেমন দর্শক হয়, তা নিয়ে খুব কৌতূহল হচ্ছে। হয়তো ভালোই হবে। হলে তা হবে ‘টিকিট যথন কেটেই ফেলেছি, দেখেই আসি’ মনোভাবাপন্ন দর্শকের কারণেই।
সেমিফাইনাল যে মাঠে হবে, সেটিও দর্শকের জন্য বড় বেকায়দার জায়গা। পোর্ট অব স্পেন শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের ব্রায়ান লারা স্টেডিয়ামে। সান ফার্নান্দো নামে একটা উপশহরে। ত্রিনিদাদ মানেই ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে যে কুইন্স পার্ক ওভাল, সেটি শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। কলকাতায় যেমন ময়দান, পোর্ট অব স্পেনে তেমনি সাভানা। ঘাসে ঢাকা বিস্তীর্ণ সেই প্রান্তরের পাশেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সবচেয়ে বিখ্যাত টেস্ট ভেন্যু। সিএলআর জেমস তাঁর ‘বিয়ন্ড আ বাউন্ডারি’ বইয়ে যে মাঠের অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন। জানালা দিয়ে এক বালকের দেখা এই মাঠ যেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটকে দেখা। সেই মাঠে এখন আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয় না। মাঠের মালিক কুইন্স পার্ক ক্লাব। সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে স্টেডিয়ামের আধুনিকায়ন করা নিয়ে মতবিরোধের জেরে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই মাঠকে বিসর্জন দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট। সরকারি অর্থায়নে বানানো হয়েছে ব্রায়ান লারার নামে নতুন স্টেডিয়াম।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে সাবেক ক্রিকেটারদের নামে তিনটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। টেস্ট খেলুড়ে আর কোনো দেশে যা নেই। তবে এখানে তো তা তিনটি ভিন্ন দেশে। অ্যান্টিগায় ভিভ রিচার্ডসের নামে, ড্যারেন স্যামির নামে সেন্ট লুসিয়ায় আর ত্রিনিদাদে অবশ্যই ব্রায়ান লারা। কুইন্স পার্ক ওভালেও ব্রায়ান লারা আছেন। জাদুঘরে তাঁর অটোগ্রাফ দেওয়া ব্যাট আছে। পার্কিং লটেও লেখা আছে তাঁর নাম। মানে ওই পার্কিংটা লারার গাড়ির জন্য সংরক্ষিত আরকি। এমন আছে ত্রিনিদাদের আরও তিন ক্রিকেটারের জন্যও—ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ড ও সুনীল নারাইন। যা বদলে যাওয়া ক্রিকেট সংস্কৃতিরও প্রমাণ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অর্জনের বিচারে লারার কাছে এই তিনজন কোথায়! ওই ত্রিনি-ত্রয়ী বিখ্যাত হয়েছেন বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি খেলে। তিনজনই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের বড় তারকা। ত্রিনিদাদের সবচেয়ে বিখ্যাত নাম হিসাবে এখনো লারার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এরপর যদি কারও নাম বলতে হয়, তাহলে সম্ভবত ডোয়াইন ব্রাভো। সেটির কারণ যত না ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে পারফরম্যান্স, তার চেয়ে বেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট।
সেই ব্রাভোর মাধ্যমেই প্রথম সেমিফাইনালে ত্রিনিদাদের প্রতিনিধিত্ব থাকছে। এই বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বোলিং কোচ। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে টেনশন আর উত্তেজনার প্রকাশে যাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন শুধু সেই দলের প্রধান কোচ জোনাথন ট্রট। আন্ডারডগের প্রতি সহজাত ভালোবাসার কারণে ব্রায়ান লারা স্টেডিয়ামে দর্শক সমর্থন হয়তো আফগানিস্তানের দিকেই থাকবে। ডোয়াইন ব্রাভোর কারণে যা আরও বাড়ার কথা।
দক্ষিণ আফ্রিকা-আফগানিস্তান সেমিফাইনাল নিয়ে ত্রিনিদাদের নির্লিপ্ত হয়ে থাকার কথা বলছিলাম। আরও অনেক দিক থেকেই তো এই সেমিফাইনালকে মোটেই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো লাগছে না। ভারত-ইংল্যান্ড দ্বিতীয় সেমিফাইনাল কাভার করতে গায়ানায় সাংবাদিকদের ভিড়। আর এখানে সোমবার বিকালে দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ রব ওয়াল্টারের সংবাদ সম্মেলনে মনে হয় একটা ‘রেকর্ড’ই হয়ে গেল। ক্রিকেট ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম সাংবাদিকের চেয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসা লোকের সংখ্যা বেশি। ওয়াল্টারের সঙ্গে মিডিয়া ম্যানেজার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা মিলে তিনজন। আর সাংবাদিক? মাত্র একজন!
অদ্ভূত এক সূচি করেছে আইসিসি। যে কারণে সেমিফাইনালের আগে আফগানিস্তান প্র্যাকটিসই করতে পারল না। আগের দিন সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ শেষ হয়েছে রাত একটারও পর। আফগানিস্তান দল সেখান থেকে ত্রিনিদাদে এসে পৌঁছেছে পরদিন। অমন স্নায়ুক্ষয়ী একটা ম্যাচের পর ভ্রমণক্লান্তি—এরপর আর প্র্যাকটিস হয় কীভাবে!
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগে ভেন্যুতে শুধুই এক দলের সংবাদ সম্মেলনও সম্ভবত এবারই প্রথম। আফগানিস্তানেরটা সেরে ফেলা হয়েছে সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের পরই। কোচ জোনাথন ট্রটের সেই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও পরে আইসিসির মিডিয়া জোনে আপলোড করা হয়েছে সাংবাদিকদের জন্য।
আফগানিস্তানের প্রথম বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আরও কত ‘প্রথম’ যোগ হয়, কে জানে!