ইরফান ‘টাওয়ার’ দেখার দিন...
ক্রিকইনফোয় মোহাম্মদ ইরফানের পরিচিতির শুরুটাই মজার—‘মোহাম্মদ ইরফানের আসল উচ্চতা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। পিসিবি তাঁর উচ্চতা একেক সময় একেকরকম জানিয়েছে, ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি, ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি ও ৭ ফুট ১ ইঞ্চি। তবে সত্যিই ৭ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতা হলে জানাশোনার মধ্যে সে-ই সবচেয়ে লম্বা (ক্রিকেটার)। নিজের আদর্শ জোয়েল গার্নারকেও টপকে গিয়েছেন।’
গার্নার? সত্তর দশকের শেষ ভাগ ও আশির দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ংকর ‘পেস চতুষ্টয়ে’র একজন ‘বিগ বার্ড’ ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার জোয়েল গার্নার। ইংল্যান্ডের সাবেক ওপেনার জিওফ্রে বয়কট একবার বলেছিলেন, ‘নো বডি হিটস জোয়েল...আইদার হি কামস টু ইয়োর টো ও চেস্ট।’
অর্থাৎ জোয়েলকে কেউ মারে না (ভয় না শ্রদ্ধা?)। সে হয় তোমার পায়ের পাতায় মারবে কিংবা বুকে। মাঝামাঝি কিছু (লাইন) নেই! ইরফানও কি তেমন? প্রায় সবাই জানেন, জোয়েলের সঙ্গে ইরফানের মিল শুধু এক জায়গাতেই। দুজনেই তাকিয়ে দেখার মতো লম্বা। আর এই ভীম উচ্চতাই সেদিন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ইরফানকে সবার মধ্যমণিতে পরিণত করেছিল।
বিপিএলে এবার সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে এক ম্যাচ খেলেছেন ইরফান। গত ৪ ফেব্রুয়ারি রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ৩৫ রানে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। উইকেটটি ছিল ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার রংপুরের ব্যাটসম্যান রনি তালুকদারের। ইরফানের বল খেলার সময় রনির কি মনে হয়েছিল দুই কিংবা তিনতলা উচ্চতা থেকে ধেয়ে আসা বল খেলছেন?
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরফান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার পর কিন্তু একটি রসিকতা শোনা গেছে, ‘ইরফান বল করলে মনে হয় দুই কিংবা তিন তলা ভবনের উচ্চতা থেকে বলটা ধেয়ে আসছে!’ একে তো তালগাছের মতো উচ্চতা, তারওপর বোলিং করার হাত যেহেতু আরও ওপর থেকে আসে, তাই অমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না!
গার্নারের ক্ষেত্রেও কিন্তু এমন মনে হতো ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু ‘বিগ বার্ড’-এর মতো নিখুঁত লাইন-লেংথ (ওয়ানডেতে সবচেয়ে ইকোনোমিক্যাল বোলার) ইরফানের নেই। সে কারণেই আন্তর্জাতিক অভিষেকের প্রায় ১৩ বছর পরও ইরফানের পাশে মাত্র ৪ টেস্ট, ৬০ ওয়ানডে ও ২২ টি-টোয়েন্টির ক্ষুদ্র পরিসংখ্যান। এই তিন সংস্করণের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৩ উইকেট নিয়েছেন ওয়ানডেতে। ৪.৯১ ইকোনমি রেটও গার্নারের (৩.০৯) ধারেকাছে নেই।
পাঞ্জাবের গ্রাম গাগো মান্দি থেকে উঠে আসা ইরফান ক্রিকেটার হয়ে ওঠার আগে স্থানীয় এক প্লাস্টিক-পাইপ কারখানায় কাজ করতেন। পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে কোচদের নজরে আসার পরই ইরফানের পেসার হয়ে ওঠার শুরু। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তাঁকে ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’ হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। গতি ও বাউন্স দিয়ে সেখানে টেস্টে সিরিজে ভালো করে পায়ের নিচে ভিত শক্ত করেছিলেন ইরফান। সেটি ১০ বছর আগে এই ফেব্রুয়ারিতেই!
কিন্তু এই এক দশকে পৃথিবীর অনেক কিছু পাল্টে গেছে। ইরফানও পাল্টেছেন। দুর্নীতির কাছে ২০১৭ সালে পিসিবি তাঁকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেছিল। ছয় মাস পর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলেও ইরফান বলেছিলেন, ‘এই ছয় মাস তার কাছে ছয় বছরের মতো লেগেছে।’ পাঁচ বছর পর সেই ইরফানের বয়স এখন ৪০। কথায় আছে, লোকে ‘চল্লিশে নাকি চালসে’ হয়, তবে খেলাধুলায় কথাটা খুব একটা খাটে না। নইলে ইরফান এই বয়সেও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলতে পারতেন না।
বোলিংয়ে আগের সেই গতি ও ধার হয়তো নেই, তবে পাকিস্তানি পেস ঐতিহ্যের ধারাটা ঠিকই আছে তাঁর শরীরে। এর সঙ্গে আইফেল টাওয়ারের মতো উচ্চতা যোগ হওয়ায় ইরফান এই বয়সেও নজর কেড়েছেন বিপিএলে ২ ফেব্রুয়ারি সিলেটের অনুশীলনে।
ঘটনাটা বলেছেন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী শামসুল হক। সেদিন তিনি শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর ভাষায়, সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে সেদিন প্রথম অনুশীলন ছিল ইরফানের। মাঠে আসতেই সবাই যেন তাঁকে ছেকে ধরল! ছবি তুলবে। ইরফানের ভীম উচ্চতা যে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তা বুঝে নিতে কারও কষ্ট হয়নি। সিলেট স্ট্রাইকার্সের মুশফিকুর রহিম, নাজমুল হোসেন থেকে জাকির হাসান—সবাই ইরফানের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে। ওহ, আরেকটি বিষয়—ছবি তোলার সময় প্রায় সবার মুখেই হাসির আভা ছিল। কেন?
এই প্রতিবেদনের ভেতরে ব্যবহার করা ইরফানের সঙ্গে জাকির হাসানের ছবিটাই দেখুন। ফিক করে হেসে ফেললে পাছে লোকে কী বলবে, কিংবা ইরফানকে খাটো করা হবে—এমন কিছু ভেবেই সম্ভবত অদৃশ্য মুগ্ধতার ছাপ জাকিরে মুখে। ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরে তাকিয়ে ইরফানকে দেখেওছেন। লোকে যেভাবে ভূপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে আইফেল টাওয়ার দেখে সেভাবে!
বেশির ভাগ ক্রিকেটারই হয়তো ছবি তোলার সময় তেমন চাহনিতেই দেখেছেন ইরফানকে। ক্রিকেটে পেস বোলারদের উচ্চতা এমনিতেই লোভনীয় ব্যাপার। ইরফানের মতো কাউকে পেলে তাই ছবি না তোলাটাই তো অস্বাভাবিক।
ঠিক যেভাবে ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কোর্টনি ওয়ালশ ও কার্টলি অ্যামব্রোসকে একসঙ্গে পেয়ে গিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। ওয়ালশ তখন বাংলাদেশের পেস বোলিং কোচ আর অ্যামব্রোস ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচিং স্টাফে ছিলেন। ওয়ালশের উচ্চতা ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি আর অ্যামব্রোসের ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি। আর মুশফিকের উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।
দুই ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মুশফিকের তোলা ছবিটি দেখে কি মনে হয়েছিল? ক্রিকেটীয় বৈচিত্র্য! সেই বৈচিত্র্যে ছিল মুগ্ধতা, সম্মান ও শ্রদ্ধা। মাঠের লড়াইয়ে যে সবাই সমান! উচ্চতা সেখানে কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা এনে দিলেও মুশফিক কিন্তু নিজের ওই ছোটখাটো গড়ন দিয়েই কিংবদন্তি হয়েছেন বাংলাদেশের।
অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি পাওয়া জাকির পারবেন তো?