বুমরা–সিরাজদের সঙ্গে মরকেলও মুশফিকদের প্রতিপক্ষ
‘ভারতের সঙ্গে অসাধারণ এক অভিযাত্রার অপেক্ষায় আছি।’
কথাটা মরনে মরকেলের। ভারতের বোলিং কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর বলেছেন বিসিসিআইয়ের একটি ভিডিওতে। চেন্নাইয়ে ভারতের অনুশীলন ক্যাম্পেও যোগ দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই পেসার। ভারতের বোলিং কোচ হিসেবে মরকেলের প্রথম পরীক্ষা বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ। চেন্নাইয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর শুরু প্রথম টেস্ট। এরপর কানপুরে ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হবে সিরিজের দ্বিতীয় এবং শেষ টেস্ট।
মরকেলের কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, যে অসাধারণ অভিযাত্রার অপেক্ষায় তিনি আছেন, তার শুরুটা হবে বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়ে। বাংলাদেশ কি পারবে? না, অভিযাত্রায় সহায়তা নয় বরং উল্টোটা। পণ্ড করতে পারবে?
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ৮৬ টেস্টে ৩০৯ উইকেট নেওয়া সাবেক এই পেসার। ১১৭ ওয়ানডেতে ১৮৮ এবং ৪৪ টি–টোয়েন্টিতে ৪৭ উইকেটও নিয়েছেন মরকেল। এই বাংলাদেশ দলের অনেকেই এর আগে মরকেলের মুখোমুখি হয়েছেন। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার দীর্ঘদেহ, হাই আর্ম অ্যাকশন, অতিরিক্ত বাউন্স ও গতি—এসব গুণের কারণে খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছেন মরকেল।
২০২০ সালের এপ্রিলে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় বাংলাদেশের তারকা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান মরকেলকে তাঁর খেলা সবচেয়ে কঠিন ফাস্ট বোলারের তালিকায় শীর্ষে রেখেছিলেন। জাতীয় দলের বাইরে থাকা ওপেনার তামিম ইকবালও ২০১৫ সালে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সবচেয়ে কঠিন বোলারের মুখোমুখি হওয়া প্রসঙ্গে ‘মরনে মরকেল। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য ভয়ংকর বোলার’—কথাটা বলেছিলেন। তবে এসব কথা শুনতে ভাবতেই পারেন ধান ভানতে শিবের গীত কেন? মরকেল তো এখন আর খেলেন না, আর সাকিব থাকলেও তামিম দলে নেই। তাহলে অযথাই কেন এই আতঙ্ক ছড়ানো?
উত্তর হলো, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা ভালোই জানা আছে মরকেলের। ৩৯ বছর বয়সী এই সাবেক বাংলাদেশের বিপক্ষে একদম কম ম্যাচও খেলেননি। সে অভিজ্ঞতাই যশপ্রীত বুমরা ও মোহাম্মদ সিরাজদের সঙ্গে নিশ্চয়ই ভাগাভাগি করবেন মরকেল। ভাবার মতো বিষয় আছে আরও একটি। ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের জন্য ঘোষণা করা বাংলাদেশের স্কোয়াডে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে পাঁচজনই বাঁহাতি—সাদমান ইসলাম, জাকির হাসান, নাজমুল হোসেন, মুমিনুল হক ও সাকিব আল হাসান।
পাকিস্তান সফরে সিরিজ জেতায় উইনিং কম্বিনেশন ধরে রাখতে এই পাঁচজনেরই খেলার সম্ভাবনা খুব বেশি। ভারত শিবিরও নিশ্চয়ই তা হিসাব–নিকাশ করে বের করে ফেলেছে। এবার মরকেলকে নিয়ে তামিমের ওই কথাটি স্মরণ করুন, ‘বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য ভয়ংকর’—স্বাভাবিকভাবেই এই পাঁচ বাঁহাতির বিপক্ষে কোন চ্যানেল ধরে বোলিং করতে হবে, কোন সময় বাউন্স মারতে হবে, এসব নিশ্চয়ই বুমরা–সিরাজদের এই অল্প সময়ের মধ্যেই শিখিয়ে–পড়িয়ে দেবেন মরকেল। বুমরা–সিরাজরা যে এই কাজে দক্ষ নন, তা নয় মোটেও। কিন্তু এই কথাটাও তো সত্য, ধারালো অস্ত্র যত ধার দেবেন, ততই ধারাল হবে। রূপকভাবে বুমরা–সিরাজদের জন্য মরকেল সেই ধার দেওয়ারই জায়গা।
সেটির একটি কারণও আছে। অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৭) টেস্ট খেলেছেন মরকেল। মাখায়া এনটিনি (৮ ম্যাচে ৩৫ উইকেট) ও ডেল স্টেইনের (৬ ম্যাচে ২৮ উইকেট) পর দক্ষিণ আফ্রিকার পেসারদের মধ্যে মরকেল টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। তিন সংস্করণ মিলিয়ে সংখ্যাটা ১৩ ম্যাচে ২৬ উইকেট। এর মধ্যে সর্বশেষ খেলেন ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। মাত্র ৬ বছর আগের সেই মরকেলের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশের এই দলের মুমিনুল–মুশফিকরা। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষ শিবিরে মরকেলকে দেখে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের প্রস্তুতিতে আরও জোর হাওয়া লাগার কথা।
মরকেলও বসে নেই। গত ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের বোলিং কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর চেন্নাইয়ে যোগ দিয়েছেন সিরাজ–অশ্বিনদের সঙ্গে। তবে দায়িত্বটি পেয়ে আবেগাক্রান্তও হয়েছিলেন এবং সেসব কথাই বলেছেন ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রামে প্রকাশিত এক ভিডিওতে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) পক্ষ থেকে এ ভিডিও করা হয়। মরকেল বলেন, ‘ফোন (বিসিসিআইয়ের) রাখার পর নিজের কক্ষে বসে প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। এরপর প্রথম ফোনটি দিয়েছি বাবাকে। তার সঙ্গে কথা হয়েছে। স্ত্রীকেও ফোন দিইনি তখন। সাধারণত সবাই স্ত্রীকেই আগে ফোন দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু আমি বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। ওই মুহূর্তটি আমার জন্য বিশেষ কিছু ছিল। নিজেই ৫ থেকে ৭ মিনিট ওই সময়টা উপভোগ করেছি। অবশ্যই পরিবারকেও বলেছি যে এটা একটা সুযোগ।’
মরকেল নিজের লক্ষ্যের কথাও বলেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে অসাধারণ এক অভিযাত্রার অপেক্ষায় আছি। আমার জন্য (দলের) সবার সঙ্গে যোগাযোগটা জরুরি। কিছু খেলোয়াড়ের সঙ্গে অনেক খেলেওছি। লক্ষ্যটা হলো খেলোয়াড়দের বোঝা, তাদের দুর্বলতা ও শক্তির জায়গাগুলো চিহ্নিত করা...আমি জানি, জয়ের প্রত্যাশাটা থাকবে। সৌভাগ্যজনকভাবে নিজের খেলোয়াড়ি সময়ে তা অনেক উপভোগ করেছি এবং সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারি।’
মরকেলের সেসব অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি বাংলাদেশ দলের জন্য যে মোটেও ভালো হবে না, তা না বললেও চলে। তবে যে কথাটি বলতেই হবে, ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে বাইশ গজে নাজমুলরা লড়বেন সিরাজ–অশ্বিনদের বিপক্ষে। মরকেল তখন মাঠের বাইরে থেকে ‘ছায়া প্রতিপক্ষ’ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মনে জেঁকে বসলেই সমস্যা। তাতে তাঁর ‘অসাধারণ অভিযাত্রা শুরু’র স্বপ্নকে পণ্ড করতে গিয়ে নিজেদের সর্বনাশ হতেই পারে!