বিশ্বকাপে পাকিস্তানের এমন দুর্দশা যে ৪ কারণে
‘পাকিস্তানের বিশ্বকাপ না জেতার কোনো কারণ নেই। বিশ্বকাপ জিততে আমাদের ছয়টা ম্যাচ জিততে হবে।’
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কাল হেরে যাওয়া ম্যাচের আগে সমর্থকদের এভাবেই আশা দেখিয়েছিলেন পাকিস্তান দলের পরিচালক মিকি আর্থার। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ১ উইকেটে হারার পর পাকিস্তানের সমর্থকদের কাছে এটাকে মনে হতে পারে ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে...নিয়তি আমার ভাগ্য লয়ে যে...নিশিদিন খেলা করে।’ সত্যিই তো, নিয়তি পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ে খেলা করে! আর না হলে কাল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অমন দুর্দান্ত লড়াইয়ের পরও ১ উইকেটে হারেন বাবর আজমরা!
এর চেয়েও বড় ব্যাপার পাকিস্তানের জয়খরা। নেদারল্যান্ডস ও শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করা পাকিস্তানের কাছে জয়ের রূপটা এখন যেন জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার উপমা ‘বিদিশার নিশা’ ও ‘শ্রাবস্তীর কারুকার্য’-এর মতোই! কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তা। প্রথম দুই ম্যাচ জেতা পাকিস্তান হেরেছে টানা চার ম্যাচে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে এই প্রথম টানা চার ম্যাচে হারল ১৯৯২-এর চ্যাম্পিয়নরা। ‘বনলতা সেন’ কবিতায় বিদিশা ও শ্রাবস্তী নগরীকে খুঁজতে গিয়ে নাবিকের যে অবস্থা, জয়ের খোঁজে থাকা পাকিস্তানেরও যেন তা–ই! কেবলই ‘হাল ভেঙ্গে হারায়েছে দিশা’!
কিন্তু হঠাৎ করেই পাকিস্তানের কী হলো যে বিশ্বকাপে এমন দুর্দশার আবর্তে পড়ে গেছে তারা? বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত এ বছর পাকিস্তান ওয়ানডে খেলেছে ১৬টি। এর মধ্যে ১০টিতেই জিতেছে বাবর আজমের দল। ৫টি ম্যাচ হেরেছে তারা, অন্য ম্যাচটি ফল হয়নি। জয়ের এ ধারা বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচেও ধরে রেখেছিল পাকিস্তান। কিন্তু ছন্দটা হঠাৎ করেই হারিয়ে ফেলেছে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে ভারতে পা রাখা পাকিস্তান। এখন তাদের সেমিফাইনালে ওঠাই হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। হাতে আছে তিনটি ম্যাচ, সব কটি ম্যাচ জয়ের পর তাকিয়ে থাকতে হবে অন্য দলগুলোর দিকে।
পাকিস্তানের হঠাৎ করে ছন্দ হারিয়ে ফেলার কী কারণ থাকতে পারে, খুঁজে দেখা যাক তা।
নাসিমের অভাব, আফ্রিদির ছন্দহীনতা
শাহিন শাহ আফ্রিদি চোটে থাকার সময় পাকিস্তানের পেস বোলিং আক্রমণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মূলত নাসিম শাহই। বিশ্বকাপের আগে পর্যন্ত এ বছর পাকিস্তানের খেলা ১৬ ওয়ানডের ১১টিতে ছিলেন নাসিম। ১৯.৫৩ গড়ে নিয়েছেন ২২ উইকেট। সেরা বোলিং ৫৭ রানে ৫ উইকেট। নতুন বলে দুই দিকেই সুইং করাতে পারা নাসিম করাতে পারেন রিভার্স সুইংও। কিন্তু এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে সুপার ফোরের ম্যাচে চোট পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছেন নাসিম। এদিকে চোট থেকে ফেরা আফ্রিদিও সেরা ছন্দ খুঁজে পেতে কিছুটা সময় নিয়েছেন। ১৩ উইকেট নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে অ্যাডাম জাম্পা ও মার্কো ইয়ানসেনের সঙ্গে যৌথভাবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি থাকলেও আফ্রিদি প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের মনে শুরু থেকেই সেভাবে আতঙ্ক ছড়াতে পারছেন কই! হারিস রউফ-হাসান আলীরাও নেই তেমন ছন্দে। সব মিলিয়ে পেস আক্রমণে নাসিমের অভাবটা ভালোভাবেই টের পাচ্ছে পাকিস্তান।
বাবরের জ্বলে উঠতে না পারা
বিশ্বকাপের আগে এ বছর যে ১৬টি ওয়ানডে খেলেছে পাকিস্তান, সেখানে ব্যাট হাতে বাবরের পারফরম্যান্স ছিল অসাধারণ। সেই ১৬ ম্যাচে ২টি শতক ও ৬টি অর্ধশতকে ৪৯.৬৬ গড়ে ৭৪৫ রান করেছেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। তাঁর অসাধারণ সেই ফর্ম দেখে বিশ্বকাপের আগে ভারতের সাবেক ওপেনার গৌতম গম্ভীর বলেছিলেন, ‘এবারের বিশ্বকাপে আগুন লাগিয়ে দেবে বাবর আজম।’ বাবরের ব্যাট বিশ্বকাপে আগুন ঠিকই লাগিয়েছে, কিন্তু সেটা তাঁর দিকে ধেয়ে আসা সমালোচনার তিরে! এখন পর্যন্ত খেলা ৬ ইনিংসে ৩৪.৫০ গড়ে করেছেন ২০৭ রান। দুটি অর্ধশতক আছে, তবে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি ৭৪ রানের। মোহাম্মদ রিজওয়ান ৬ ম্যাচে ৬৬.৬০ গড়ে ৩৩৩ রান করলেও টপ অর্ডারে বাবরের অনুজ্জ্বল থাকার ঘাটতি পোষাতে পারছে না পাকিস্তান। এ ছাড়া মিডল অর্ডারে একমাত্র সৌদ শাকিল ছাড়া সেভাবে রান পাচ্ছেন না অন্য কেউ।
অকার্যকর স্পিন আক্রমণ
শাদাব খান ও উসামা মির—এবারের বিশ্বকাপে দুজন লেগ স্পিনার নিয়ে খেলছে পাকিস্তান। এর সঙ্গে আছেন বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ নেওয়াজ ও অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার ইফতিখার আহমেদ। চার স্পিনারের কেউই সেভাবে ছন্দে নেই। তিনজন মিলিয়ে এখন পর্যন্ত নিয়েছেন ৮ উইকেট। নেওয়াজ ও শাদাব ৫ ম্যাচে ২টি করে, উসামা ৩ ম্যাচে ৩টি ও ইফতিখার ৬ ম্যাচে নিয়েছেন ১ উইকেট। এবারের বিশ্বকাপের কোনো কোনো উইকেট স্পিন-সহায়ক হলেও সেগুলোর সুবিধা সেভাবে নিতে পারছে না পাকিস্তানের স্পিনাররা। এটাও ভোগাচ্ছে বাবরদের।
অপরিচিত মাঠ
এই বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ছন্দহীনতার আরেকটি কারণের কথাও অনেকে বলছেন—পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা বিশ্বকাপটা খেলছেন তাঁদের কাছে একদমই অচেনা এক জায়গায়! ভারত বাবর আজমদের প্রতিবেশী দেশ হলেও এখানে এই বিশ্বকাপের আগে একজন ছাড়া পাকিস্তানের আর কেউ কখনোই কোনো ম্যাচ খেলেননি। পাকিস্তানের এই দলের একমাত্র মোহাম্মদ নেওয়াজই ভারতের মাটিতে খেলেছেন। সেটাও আজ থেকে ৭ বছর আগে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। অজানা ও অচেনা মাঠ এবং কন্ডিশনে নিজেদের ঠিক যেন মেলে ধরতে পারছেন না বাবর আজম-শাদাব খানরা।