‘পায়রা’ ধরার অভিযানে স্টার্ক
‘ওকে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিন ও কয়েক সাইজ বড় ট্রাউজার পরে এসেছিল, জুতাও ছিল অস্বাভাবিক বড়। মনে হচ্ছিল, ও হয়তো ভুলে অন্য কারও পোশাক পরে এসেছে। দেখতে অদ্ভুত লাগছিল’—গ্লেন ম্যাকগ্রাকে ‘প্রথম দর্শনে’র স্মৃতিচারণে স্টিভ ওয়াহর অভিব্যক্তি ছিল এমনই।
ওয়াহ নিশ্চয় তখন জানতেন না ‘অদ্ভুত’ পোশাক পরে আসা সেদিনের লিকলিকে ম্যাকগ্রাই ফাস্ট বোলিংয়ে অবিশ্বাস্য সব কীর্তি করে বসবেন, হয়ে উঠবেন তাঁর ও পরবর্তীতে রিকি পন্টিংয়ের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া দলের ‘তুরুপের তাস, ক্যারিয়ারজুড়ে ব্যাটসম্যানদের জন্য হবেন দানবতুল্য এক আতঙ্কের নাম।
কিংবদন্তি ম্যাকগ্রার বোলিংয়ের মূল শক্তি ছিল তাঁর নিখুঁত লাইন আর লেংথের মিশ্রণ, সঙ্গে ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার আশীর্বাদে পিচ থেকে পাওয়া বাড়তি বাউন্স। ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্ত করার নিত্য-নতুন কৌশল রপ্তও করতেন ম্যাকগ্রা। বল দুই দিকেই সুইং করাতে পারতেন। একের পর এক স্টাম্প লক্ষ্য করে বল করাটা তাঁর জন্য ছিল সহজাত ব্যাপার। সেসব করতে করতেই ম্যাকগ্রা অনেক রেকর্ডের ভিড়ে হয়ে গেছেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিও (৭১)।
মিচেল স্টার্কও তো ম্যাকগ্রার মতোই! লিকলিকে শরীরের এক ফাস্ট বোলার হিসেবেই আন্তর্জাতিক আঙিনায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। নিখুঁত লাইন-লেংথ, ব্যাটসম্যানের শরীর তাক করা বাউন্সার, বলকে দুই দিকেই সুইং করানো, টানা বোলিং করে যাওয়া—সবই পারেন। বাড়তি পাওনা হিসেবে পিন পয়েন্ট ইয়র্কারগুলো তো আছেই। স্টার্কের উচ্চতাও দেখুন না, ম্যাকগ্রার সমান ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি! দুজনের জন্মও অস্ট্রেলিয়ার একই রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসে।
ভাবছেন, স্টার্ককে হঠাৎ ম্যাকগ্রার সঙ্গে তুলনায় আনা কেন? কারণ, বিশ্বকাপ। কাল থেকে ভারতে শুরু হয়েছে ক্রিকেট মহাযজ্ঞ। এ আসর দিয়েই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট পাওয়া বোলারদের তালিকায় শীর্ষে থাকা ম্যাকগ্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন স্টার্ক। ম্যাকগ্রার রেকর্ড ৭১ উইকেটের কথা আগেই বলা হয়েছে। তাঁর পরেই আছেন লঙ্কান কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরন (৬৮)। তিনে মুরালির স্বদেশি লাসিথ মালিঙ্গা (৫৬), চারে পাকিস্তানের ‘সুলতান অব সুইং’ ওয়াসিম আকরাম (৫৫)। স্টার্ক ৪৯ উইকেট নিয়ে আছেন পাঁচে। ম্যাকগ্রাকে ছাড়িয়ে যেতে স্টার্কের দরকার আরও ২৩ উইকেট।
প্রশ্ন একটাই, পূর্বসূরিকে টপকে কি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হতে পারবেন স্টার্ক? এখন তাঁর বয়স ৩৩, ফাস্ট বোলার হওয়ায় অনেকেই হয়তো তাঁকে ২০২৭ বিশ্বকাপে দেখছেন না। বয়স বিবেচনায় এটাই হতে পারে তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। তাই যা করার এবারই করতে হবে। বিশ্বকাপে স্টার্কের উইকেটশিকারের ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ অবশ্য তাঁর হয়েই কথা বলছে। ২০১৫ সালে নিজের প্রথম বিশ্বকাপে ব্যাটসম্যানকে বিদায় করেছেন ২২ বার, ২০১৯ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপে ২৭ বার; দুই আসরেই তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। সে হিসেবে তো এবার আরও বেশি উইকেট পাওয়ার কথা তাঁর।
এ বছর মাত্র চারটি ওয়ানডে খেললেও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে হ্যাটট্রিকে গা গরম করেছেন। তাঁকে নিয়ে ওঠা প্রশ্নে যেন পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন! হয়তো বোলিং দিয়েই বোঝাতে চেয়েছেন, আগের দুবার পারলে এবার নয় কেন? ২২ আর ২৭ উইকেটের মাঝামাঝি কিছু একটা করলেই তো ম্যাকগ্রার রেকর্ডটা অনায়াসে নিজের করে নেবেন। ‘ক্রিকেটের বাইবেল’ খ্যাত উইজডেনের ওয়েবসাইট তো এবারও স্টার্ককে শীর্ষ উইকেটশিকারির সংক্ষিপ্ত তালিকায় রেখেছে। উইজডেন লিখেছে, স্টার্ককে তালিকায় না রাখা হবে হাস্যকর।
বিশ্বকাপে ঊর্ধ্বগামী উইকেটশিকারের গ্রাফেও ম্যাকগ্রার সঙ্গে স্টার্কের কী মিল! ১৯৯৬ থেকে ২০০৭—চার বিশ্বকাপ খেলে তিনটিই জিতেছেন ম্যাকগ্রা। ’৯৬-এ শ্রীলঙ্কার কাছে ফাইনালে না হারলে চারে-চার হয়ে যেত। সেটা না হলেও একের পর এক বিশ্বকাপে উইকেট সংখ্যায় নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। ১৯৯৬ সালে নিজের প্রথম বিশ্বকাপে ৬ উইকেট, ১৯৯৯-এ ১৮, ২০০৩-এ ২১ আর ২০০৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপটা রাঙিয়েছেন ২৬ উইকেট নিয়ে। ২০০৩-এ নামিবিয়ার বিপক্ষে ১৫ রানে ৭ উইকেট বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সেরা বোলিং ফিগার।
সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় স্টার্ক ম্যাকগ্রাকে ছাড়িয়ে যাবেন কি না, সেটা সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে একটা রেকর্ডে তিনি গত বিশ্বকাপেই ম্যাকগ্রাকে পেছনে ফেলেছেন। ২০০৭ সালে ম্যাকগ্রার ২৬ ছাড়িয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপে স্টার্কের ২৭; যা এক বিশ্বকাপে কোনো বোলারের সর্বোচ্চ উইকেট। ইনিংসে সবচেয়ে বেশি তিনবার ৫ উইকেট নেওয়ার বিশ্বকাপ রেকর্ডটাও স্টার্কের।
এবারের বিশ্বকাপ কোন দল জিততে পারে, ম্যাকগ্রা এ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তবে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি কে হতে পারেন, সে ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মনে মনে তিনি ঠিকই চাইবেন, তাঁর রেকর্ডটা ভেঙে ফেলুক স্টার্কের মতো যোগ্য উত্তরসূরি। ম্যাকগ্রা তো স্টার্কের শুভানুধ্যায়ীদেরও একজন। গত অ্যাশেজে স্টার্কের একটি ক্যাচকে আম্পায়ার বৈধতা না দেওয়ায় সবার আগে উচ্চবাচ্য করেছিলেন ম্যাকগ্রাই। বোলিং নিয়ে স্টার্ককে মাঝেসাজে পরামর্শও দিতে দেখা গেছে তাঁকে। একবার বলেছিলেন, ‘স্টার্কের এক্স-ফ্যাক্টরের কারণে অস্ট্রেলিয়া কিছুটা হলেও এগিয়ে থাকে।’
ম্যাকগ্রা-স্টার্কের আরেকটি মিল দিয়ে শেষ করা যাক। চিকন-লম্বা পায়ের কারণে সতীর্থদের দেওয়া একটা ডাকনাম জুটে গিয়েছিল ম্যাকগ্রার—‘দ্য পিজিয়ন’ (পায়রা বা কবুতর)। ২০১৫ বিশ্বকাপজয়ী স্টার্কের আবার ডাকনাম জুটেছে দুটি। ওভার দ্য উইকেট থেকে ইয়র্কারে টেলএন্ডারদের স্টাম্প এলোমেলো করে দেওয়ায় আগে তাঁকে ডাকা হতো ‘দ্য মপ’ (ঝাড়ুদার) নামে। ২০১৯ বিশ্বকাপের সময় ওয়ানডেতে দ্রুততম ১৫০ উইকেট শিকারের পর হয়ে গেছেন ‘ফ্লট’; যে নামটি দিয়েছেন সতীর্থ নাথান লায়ন। ফ্লট বা এফএলওএটি মানে ‘ফাস্টেস্ট লেফট আর্মার অব অল টাইম!’
ম্যাকগ্রার সঙ্গে যাঁর এত মিল, তিনি তো ম্যাকগ্রাকে ছাড়িয়ে যেতে চাইবেনই। এবার না হলে হয়তো পরেরবার। তা কারও কারও চোখে স্টার্কের বয়স যতই বাধা হোক না কেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০২৭ আসরেও খেললে সেটা হবে স্টার্কের চতুর্থ বিশ্বকাপ, সে সময় তাঁর বয়স হবে ৩৭। ম্যাকগ্রাও তো নিজের নিজের চতুর্থ ও শেষ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন ৩৭ বছর বয়সে। কী আশ্চর্য, এখানেও মিল!